ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

দু’শ’ বছরে ২০ লাখ লোকের মৃত্যু

বঙ্গোপসাগরেই সব প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি

কাওসার রহমান

প্রকাশিত: ২২:৫৫, ২৬ মে ২০২৪

বঙ্গোপসাগরেই সব  প্রলয়ঙ্করী  ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তি

.

প্রতিবছরই একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যন্ত উপকূলের মানুষ। বিশেষ করে মে মাস এলেই তাদের আতঙ্ক বেড়ে যায়। আতঙ্ক চলে নভেম্বর পর্যন্ত। ঘূর্ণিঝড় সিডর, ইয়াস, আইলা, মহাসেন, বুলবুলের আঘাতের ক্ষত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি উপকূলীয় এলাকার মানুষ। এরই মধ্যে এই মে মাসেই উপকূলের মানুষ আবার মুখোমুখে হলেন প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তিস্থল হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। গত ২০০ বছরে বঙ্গোপসাগরের এসব ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ গেছে বাংলার ২০ লাখ মানুষের। মূলত বঙ্গোপসাগরের ত্রিভুজ আকৃতি এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের সবচেয়ে বড় শিকারে পরিণত হয়ে আসছে বাংলাদেশ।

বিশ্বের আবহাওয়া পরিস্থিতির ওপর নজর রাখে এমন একটি ওয়েবসাইটওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড তাদের বিগত দিনের পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের ইতিহাসে প্রতি দশটি ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের আটটি সৃষ্টি হয় বঙ্গোপসাগরে। নথিবদ্ধ ইতিহাসে ৩৬টি ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ২৬টিরই জন্মস্থান এই সমুদ্র। এমন বাস্তবতায় সর্বশেষ আরেকটি ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়রেমালআঘাত করে বাংলাদেশ উপকূলে। 

এবারের ঘূর্ণিঝড়ের নাম হবেরেমাল নামটি ওমানের দেওয়া। এর অর্থ বালি। উপকূলের মানুষ গত বছর (২০২৩) মোখা, তার আগের বছর আম্ফানের ভয়ংকর রূপ দেখেছে। আর এবার দেখল রিমালের। তবে এর আগেও বিভিন্ন সময় বাংলায় জানমালের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ঘূর্ণিঝড়ে। প্রাকৃতিক এসব দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ। প্রাণহানির পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও ভীষণ ক্ষতি হয়। যা পুষিয়ে নিতেও সময় লাগে বছরের পর বছর।

বিশ্বের মোট মহাসাগরীয় অঞ্চলের মাত্র শূন্য দশমিক ছয় শতাংশ স্থান অধিকার করে আছে বঙ্গোপসাগর। কিন্তু এর তটরেখা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ, সমুদ্র উপকূলে বাস করে প্রায় অর্ধশত কোটি মানুষ। তাই ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যুতে বেশি হয় সমুদ্রকে ঘিরে।

ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ডের তথ্যানুযায়ী, বঙ্গোপসাগরে তৈরি সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়টি ছিল ১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড়। ওই ঝড়ে দেশের থেকে লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। দ্বিতীয়টি ভয়াবহ বড়টি হয় ১৭৩৭ সালে। ভারত-বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ক্ষতি করা ওই ঘূর্ণিঝড়কে বলা হয়হুগলী নদীর ঘূর্ণিঝড় ওই ঘূর্ণিঝড়ে লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।

বঙ্গোপসাগরে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হওয়ার কারণ জলোচ্ছ্বাস। কখনো কখনো জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ১০ মিটারের বেশি হয়। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, বঙ্গোপসাগরের ত্রিভুজাকৃতি এবং এর অগভীর তলদেশই ঘূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হওয়ার কারণ।

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড়টি০২ইনামে পরিচিতি। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় উপকূলীয় এলাকা। প্রায় এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যায়। কোটি মানুষ তাদের সর্বস্ব হারায়। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সময় যে জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল তার উচ্চতা ছিল ১০ দশমিক মিটার বা ৩৪ ফুট।

দেশের ইতিহাসের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এসব ঘুর্ণিঝড় শুধু প্রাণহানিই ঘটায়নি, ব্যক্তিগত সম্পদেরও প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতি করেছে। তবে অতীতের মতো এত প্রণাহানি এখন আর ঘটেনি। বাংলাদেশ ঘুর্ণিঝড় মোকাবিলায় আগের চেয়ে অনেক দক্ষ হয়েছে, বেড়েছে সক্ষমতা। ফলে একানব্বইয়ের ঘূর্ণিঝড়ের পর আর বাংলাদেশে ব্যাপক প্রণাহানি ঘটেনি। কিন্তু বেচে যাওয়া মানুষগুলোর সহায়-সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে। প্রায় সময়ই দেখা যায়, বড় বড় ঘূর্ণিঝড়ের হাত থেকে উপকূলের মানুষকে আগলে রাখছে বিশ্বের বৃহত্ত্বম ম্যানগ্রোভ- সুন্দরবন। কিন্তু উপকূলের মানুষকে বাঁচাতে তাদের সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে সুন্দরবনবে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। এই ক্ষত কাটিয়ে উঠতেও অনেক সময় লাগবে। আবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপকূল রক্ষাকারী বেড়িবাধসহ সকরারি-বেসরকারি অবকাঠামো।  রেমারেল আগে বাংলাদেশে আঘাত হানা প্রবল ঘূর্ণিঝড়গুলোর কথা এখানে তুলে ধরা হলো।  

ঘূর্ণিঝড় মোখা ২০২৩ সালের ১৪ মে স্থানীয় সময় বেলা ৩টার দিকে বাংলাদেশ মিয়ানমারের উপকূলে আঘাত হানে, যার প্রভাবে ভারি বৃষ্টি ঝড় হয় এবং প্রতি ঘণ্টায় ১৭৫ মাইল পর্যন্ত বেগে প্রবল বাতাস বয়ে যায়। কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে একজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে সেন্ট মার্টিন, টেকনাফ আর শাহ পরীর দ্বীপের মানুষ। বিশেষ করে গরিব নিম্নবিত্তদের কাঁচা ঘরবাড়ি একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে এই ঘূর্ণিঝড়ে। সব মিলিয়ে ঝড়ের প্রভাবের শিকার হয়েছেন তিন লাখ ৩৪ হাজার মানুষ। যার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছে উপকূলীয় মানুষের। এমনকি এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি সেন্ট মার্টিন, টেকনাফ আর শাহ পরীর দ্বীপের মানুষ।

ঘূর্ণিঝড় আসানি ২০২২ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আসানিতে প্রাথমিকভাবে অন্ধ্রপ্রদেশ প্রভাবিত হয়েছে। বাংলাদেশে কম ক্ষতি হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর বাংলাদেশ ভারতকে প্রভাবিত করেছিল এই সাইক্লোন। ২২ অক্টোবর আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের উপকূল থেকে কিছুটা দূরে সমুদ্রে এটি গঠিত হয়ে ধীরে ধীরে তীব্রতর হতে হতে ২৫ অক্টোবর প্রথম প্রহরে উচ্চ-প্রান্তের ঘূর্ণিঝড় হিসেবে বরিশালের কাছে বাংলাদেশের ওপর আছড়ে পড়ে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে দেশের ১৪ জেলায় ৩৩ জন মারা যান। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তান্ডবে দেশের ১০ হাজার ঘরবাড়ি এবং হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘূর্ণিঝড়টি ভোলা, নোয়াখালী চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়ে ৪১৯ ইউনিয়নের ১০ হাজার ঘরবাড়ি এবং হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট করে। প্রায় ৮০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ২০২১ সালের ২৬ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। তবে এটি বাংলাদেশে তেমন কোনো ক্ষয়-ক্ষতি করেনি।

ঘূর্ণিঝড় আম্পান ২০২০ সালের ২০ মে বাংলাদেশে আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন আম্পান। এটি একটি ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়, যা বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী ভারতের পূর্বাংশে এবং বাংলাদেশে আঘাত হানে। বাংলাদেশের মূলত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতেই আম্পানের আঘাত ছিল তীব্র। বাঁধগুলো ভাঙার ফলে পটুয়াখালী জেলার অন্তর্গত গলাচিপা, কলাপাড়া, এবং রাঙ্গাবালীসহ ১০টি গ্রাম ডুবে যায়। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে ১০ কোটিরও বেশি লোক বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েছিল। প্রায় ,০০০টি চিংড়ি এবং কাঁকড়া খামার জলোচ্ছ্বাসে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে যায়। সাতক্ষীরা জেলার, পূর্ব দুর্গাবতীতে, একটি বাঁধের কিছু অংশ মিটার (১৩ ফুট) উঁচু বন্যার জলে ভেসে যায়, যার ফলে ৬০০ টি বাড়িঘর ডুবে যায়।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুল বার বার দিক বদল করে ২০১৯ সালের নভেম্বর অতিপ্রবল এই ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাগর দ্বীপ উপকূলে আঘাত হানার পর স্থলভাগ দিয়ে বাংলাদেশে আসায় ক্ষয়ক্ষতি আশঙ্কার চেয়ে কম হয়। ঝড়ে মারা যায় ২৪ জন। ৭২ হাজার ২১২ টন ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়, যার আর্থিক মূল্য ২৬৩ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। ক্ষতি হয় সুন্দরবনেরও।

ঘূর্ণিঝড় ফণী ২০১৯ সালের মে বঙ্গপোসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে বাংলাদেশে জনের মৃত্যু হয়। তবে প্রাণহানি কম হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। সরকারি হিসাব মতে, ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে ঘরবাড়ি, বাঁধ, সড়ক কৃষিতে ৫৩৬ কোটি ৬১ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়।

ঘূর্ণিঝড় মোরা ২০১৭ সালের ৩০ মে ১৪৬ কিলোমিটার বাতাসের গতিতে কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড় মোরা আঘাতে কক্সবাজার উপকূলের শতাধিক বাড়ি-ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। বেশকিছু গাছপালা উপড়ে পড়েছে। তবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। তবে মোরার প্রভাবে উপকূলে মারাত্মক ক্ষতি হয়।

ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হেনেছিল ২০১৬ সালের ২১ মে। এতে চট্টগ্রামে ২৪ জনের মৃত্যু হয়। - ফুট উঁচু ঝড়ের ঢেউয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় লক্ষাধিক পরিবার।

ঘূর্ণিঝড় মহাসেন ২০১৩ সালের মে মাসের শুরুর দিকে বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণাংশে নিম্নচাপজনিত কারণে উৎপত্তি ঘটে মহাসেনের। কার্যত স্থির থাকলেও ১০ মে তারিখে ঘণিভূত অবস্থায় চলে যায়। পরবর্তীতে এটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে মৌসুমের প্রথম নামাঙ্কিত ঘূর্ণিঝড় মহাসেনে রূপান্তরিত হয়। ১৪ মে এটি উত্তর-পূর্বাংশের দিকে অগ্রসর হয়ে নোয়াখালী-চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানে ২০১৩ সালের ১৬ মে থাকে। এতেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এতে ১৭ জনের মৃত্যু হয়। কার্যত জনজীবন অচল হয়ে পড়ে।

ঘূর্ণিঝড় আইলা ২০০৯ সালে উত্তর ভারত মহাসাগরে জন্ম নেওয়া দ্বিতীয় ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে আইলা। ঘূর্ণিঝড়টি জন্ম নেয় ২১ মে ভারতের কলকাতা থেকে ৯৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে। ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে ২৫ মে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে। এর ব্যাস ছিল প্রায় ৩০০ কিলোমিটার, যা ঘূর্ণিঝড় সিডরের থেকে ৫০ কিলোমিটার বেশি। সিডরের মতোই আইলা প্রায় ১০ ঘণ্টা সময় নিয়ে উপকূল অতিক্রম করে, তবে পরে বাতাসের বেগ ৮০-১০০ কিলোমিটার হয়ে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি, সিডর থেকে তুলনামূলক কম হয়েছে। ঘুর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে ১৯৩ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে প্রায় লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।

ঘূর্ণিঝড় সিডর আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ২০০৭ সালের নভেম্বর একটি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়। ১১ নভেম্বর আবহাওয়ায় সামান্য দুর্যোগের আভাস পাওয়া যায়। এর পরের দিনই এটি ঘূর্ণিঝড় সিডরে পরিণত হয়। বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশিতে এটি দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করে এবং বাংলাদেশে একটি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি করে। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রীয় অংশ ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টার পর বাংলাদেশের পাথরঘাটায় বালেশ্বর নদীর কাছে উপকূল অতিক্রম করে। ঝড়ের তা-বে উপকূলীয় জেলাসমূহে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ঝড়ো হাওয়াসহ বিপুল পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়।

সরকারী তথ্যানুসারে, ১৯৬০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৩৬টি বড় ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের হদিস পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক পাঁচটি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে অন্যতম সিডর। সরকারী হিসেব মতে, ১৫ নভেম্বর সিডরের তান্ডবে দক্ষিণ উপকূলের বিশাল জনপদের প্রায় চার লাখ ঘরবাড়ী সম্পূর্ণ প্রায় ১০ লাখ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিন হাজার ১৯৯ জনের মৃত্যু হাজার ৭২৬ জন নিখোঁজ হওয়ার কথা বলা হলেও বেসরকারি হিসেবে এসংখ্যাও আরো অনেক বেশি। ঝড়ে প্রায় লাখ ৪২ হাজার গৃহপালিত পশু এবং হাঁস-মুরগি মারা যায়।

ঘূর্ণিঝড় নার্গিস ঘূর্ণিঝড় নার্গিস ২০০৮ সালের মে মিয়ানমার উপকূলে আঘাত হানে। সময় বাংলাদেশে খুব একটা প্রভাব পড়েনি।

উরিরচর সাইক্লোন চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী এবং উপকূলীয় অঞ্চলে ১৯৮৫ সাইক্লোন (উরিচর সাইক্লোন) আঘাত হেনেছিল ২৪ ২৫ মে। যার বাতাসের সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ১৫৪ কিমি, সন্দ্বীপে ১৪০ কিমি কক্সবাজারে ১০০ কিমি। উপকূলের ১১ হাজার ৬৯ জন বাসিন্দা প্রাণ হারান। লাখ ৩৫ হাজারের বেশি গবাদি পশু মারা যায়। সেই সময় আনুমানিক ৯৫ হাজার ঘরবাড়ি, ৭৪ কিলোমিটার রাস্তা এবং বাঁধ ধ্বংস হয়েছিল।

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় নিহতের সংখ্যা বিচারে স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে একটি। এটি ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে সংঘটিত হয়। ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে আঘাত করে ঘূর্ণিঝড়টি। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে মিটার (২০ ফুট) উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত করে এবং এর ফলে প্রায় লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যায়। এছাড়া প্রায় কোটি মানুষ তাদের সর্বস্ব হারায়। ঘূর্ণিঝড়টি স্থলভাগে আক্রমণের পর এর গতিবেগ ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং ৩০ এপ্রিল এটি বিলুপ্ত হয়। এতে সন্দ্বীপ, মহেশখালী, হাতিয়া দ্বীপে নিহতের সংখ্যা সর্বাধিক। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল শিশু বৃদ্ধ। ধারণা করা হয়, প্রায় ২০ লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে বিপজ্জনক স্থানে অবস্থানের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেসময় প্রায় ১০ লাখ ঘর-বাড়ির ক্ষতি হয়। এতে কোটি মানুষ বাস্তুহারা হয়ে পড়ে।

ভোলার ঘূর্ণিঝড় ১৯৭০ ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়। পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড়সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ এবং সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ংকরতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি। ঝড়ে প্রায় লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। যার অধিকাংশই গাঙ্গেয় -দ্বীপের সমুদ্র সমতলের ভূমিতে জলোচ্ছ্বাসে ডুবে মারা যান। এটি সিম্পসন স্কেলেক্যাটাগরি মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল।

ঘূর্ণিঝড়টি নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয় এবং ক্রমশ শক্তিশালী হতে হতে এটি উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১১ নভেম্বর এর গতিবেগ সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে (১১৫ মাইল) পৌঁছায় এবং সে রাতেই উপকূলে আঘাত হানে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়। এতে ওইসব এলাকার বাড়িঘর, গ্রাম শস্য স্রোতে তলিয়ে যায়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ছিল তজুমদ্দিন উপজেলা। সেখানে লাখ ৬৭ হাজার অধিবাসীর মধ্যে ৭৭ হাজার জনই প্রাণ হারায়।

১৯৭৫ সালের ঘূর্ণিঝড় ১৯৭৫ সালে ভোলা, কক্সবাজার খুলনা অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল থেকে ১২ মে। যার বাতাসের সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘণ্টায় ৯৬ দশমিক থেকে ১১২ দশমিক কিমি. এই ঘূর্ণিঝড়ে জন মারা গিয়েছিল।

১৯৬৫ সালের ঘূর্ণিঝড় ১৯৬৫ সালের ঘূর্ণিঝড় বরিশাল বাকেরগঞ্জ এলাকায় আঘাত করেছিল ১১ ১২ মে। এই ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসের সর্বোচ্চ গাতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬২ কিমি. জোয়ারের স্তর ছিল . মিটার। ১৯ হাজার ২৭৯ জনের প্রাণহানি হয়েছিল ঝড়ে।

১৯৬৩ সালের ঘূর্ণিঝড় ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার এবং উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় বয়ে গিয়েছিল ২৮ ২৯ মে। সে সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল প্রতি ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ২০৩ কিমি কক্সবাজারে ১৬৪ কিমি। জোয়ারের স্তর ছিল .-. মিটার। প্রাণহানি হয়েছিল ১১ হাজার ৫২০ জনের।

১৯৬১ সালের ঘূর্ণিঝড় ১৯৬১ সালে বাগেরহাট খুলনা অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসের সর্বোচ্চ গতি ছিল প্রতি ঘণ্টা ১৬১ কিমি। প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। মৃত্যু হয়েছিল ২৫ হাজার গবাদি পশুর।

১৯৫৮ সালের ঘূর্ণিঝড় ১৯৫৮ সালের ১৬ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত চলা ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান ছিল পূর্ব বরিশাল নোয়াখালী, মেঘনা নদীর মোহনা। এই দুর্যোগে ওসব এলাকার ৮৭০ জনের প্রাণহানি, হাজার ৪৫০টি গবাদি পশুর মৃত্যু হয়েছিল। নষ্ট হয়েছিল মাঠের ফসল।

১৯৪৮ সালের ঘূর্ণিঝড় ১৯৪৮ সালের থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান ছিল চট্টগ্রাম নোয়াখালীর মধ্যবর্তী -দ্বীপ। প্রায় হাজার ২০০ মানুষ ২০ হাজার গবাদি পশুর মৃত্যু হয়েছিল সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে।

১৯৪১ সালের ঘূর্ণিঝড় ১৯৪১ সালের মে মাসে ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান ছিল মেঘনা নদীর পূর্ব মোহনা। এই ঘূর্ণিঝড়ে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা এখনও অজানা।

বাকেরগঞ্জ ঘূর্ণিঝড় ১৮৭৬ প্রাণহানি ভয়ংকরের দিক থেকে পৃথিবীর ঘূর্ণিঝড়ের ইতিহাসে ষষ্ঠ স্থান দখল করে আছে বাকেরগঞ্জ ঘূর্ণিঝড়। ১৮৭৬ সালের ৩১ অক্টোবর বাকেরগঞ্জের উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যায় এই প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়। এটিদ্য গ্রেট বাকেরগঞ্জ ১৮৭৬নামেও পরিচিত। সময় মেঘনার মোহনা এবং চট্টগ্রাম, বরিশাল নোয়াখালী উপকূলে তীব্র ঝড়ো জলোচ্ছ্বাস প্লাবন সংঘটিত হয়। ঘূর্ণিঝড়ে বাকেরগঞ্জের নিম্নাঞ্চল সম্পূর্ণভাবে প্লাবিত হয়ে যায়। ঝড়ে আক্রান্ত ছাড়াও ঝড় পরবর্তী বিভিন্ন অসুখ অনাহরে মানুষ মৃত্যুবরণ করে। আনুমানিক লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে এই ঘূর্ণিঝড়ে। এরও বেশি মানুষ মারা যায় ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী মহামারি এবং দুর্ভিক্ষে।

×