ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৭ জুন ২০২৪, ৩ আষাঢ় ১৪৩১

বগুড়ায় শতবর্ষী নিশানের মেলা

ঘুড়ি উৎসব, বর্ণালি চিত্রপটে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বন্ধন

মাহমুদুল আলম নয়ন, বগুড়া অফিস

প্রকাশিত: ২২:০৪, ২৬ মে ২০২৪

ঘুড়ি উৎসব, বর্ণালি  চিত্রপটে ঐতিহ্য ও  সংস্কৃতির বন্ধন

ঐতিহ্যবাহী দাড়িয়াল ঘুড়ির মেলায় ছিল মানুষের কঙ্কাল আকৃতির ঘুড়ি

মাঠের এক কোণে কয়েক জোড়া তালগাছ। আর তালগাছের দুই পাশে বিশাল খোলা মাঠ। সদ্য ধান কাটা মাঠে এখনো ধানের গোড়ালি রয়ে গেছে। সে মাঠেই দুরন্ত গতিতে ঘুড়ির সুতা নিয়ে দৌড়াচ্ছে শিশু-কিশোররা। এটি বাড়ির পাশের কোনো খেলার মাঠ নয়, বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী ঘুড়িমেলার দৃশ্য। গ্রামবাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর সম্প্রীতির বন্ধন নিয়ে রবিবার বগুড়ার নুনগোলা ইউনিয়নে হয়ে গেল শত বছরের প্রাচীন নিশানের মেলা। এক সময়ের নিশানের মেলা বা এলাকার নামানুসারে দাড়িয়াল মেলা হলেও এটি এখন সবচেয়ে বেশি পরিচিত ঘুড়ির মেলা হিসেবে। লাল, নীল বা হলুদ, সবুজ যে রঙেরই হোকÑ রকমারি নাম রঙের ঘুড়ি, সুতা, নাটাই মেলার মূল আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কঙ্কাল থেকে মানুষ ঘুড়ি, বাক্স বিমান ঘুড়িসহ নানা বাহারি নামের ঘুড়ির রং যেন পুরো মেলা আবিরে ভাসিয়ে দিয়েছে। মেলা পরিণত হয় ঘুড়ির উৎসবে। ঘুড়ির মেলা এক প্রজন্মের হাত ধরে আরেক প্রজন্মের বন্ধনের প্রতীক হয়ে ওঠে। তবে কাগজের ঘুড়ির পরিবর্তে এখন মেলা জমেছে পলিথিন দিয়ে তৈরি নানা আকার বাহারি নামের ঘুড়ি দিয়ে। মেলায় মাছ না থাকলেও মাছ আকারের ১২ কেজির মিষ্টিও মেলার আকর্ষণ এবার বাড়িয়ে দিয়েছে।

এক সময় এই মেলার নাম ছিল নিশানের মেলা। তখন মেলা প্রাঙ্গণের এক পাশে উঁচু ঢিবির ওপর উড়ত লাঠির মাথায় লাল নিশান। নিয়ে নানা ইতিহাস থাকলেও তা এখন সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া উপাখ্যানের মতো। মেলায় লাল কাপড় ওড়ানোর কারণে এটির নামকরণ নিশানের মেলা হলেও পরে এলাকার নাম অনুসারে দাড়িয়ালের  মেলা হিসেবেও সাধারণের নিকট পরিচিতি লাভ করে। তবে ধীরে ধীরে মেলার এক পাশে এক অংশ ঘুড়ির কেনা-বেচা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকলে এটি এখন ঘুড়ির মেলা বলেও অনেকে জানেন। সদরের নুনগোলা ইউনিয়েনের দাড়িয়াল দাখিল মাদ্রাসা মাঠে মেলার মূল আয়োজন। তবে এটি আশপাশের এলাকাজুড়ে বিস্তার লাভ করেছে। এর মধ্যে মেলায় আগতদের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ মেলার প্রাচীর পেরিয়ে খোলা মাঠ। নানা নামের নানা রঙের ঘুড়ি-নাটাই নিয়ে সেখানে বিক্রেতারা পসরা সাজিয়ে বসেছেন। ঘুড়ি থেকে নানা ধরনের ঘুড়ি ওড়ানোর সুতা, নাটাই কোনো কিছুরই কমতি নেই  সেখানে।

কাহালু উপজেলার উত্তরাই গ্রামের কিশোর জিন্নার মুখে হাসি আর ধরছে না। ভ্যানে চড়ে বাবা সাইফুল ইসলাম মা জান্নাতি বেগমসহ পরিবারের অন্যদের সঙ্গে বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের এই মেলায় এসেছে। উদ্দেশ্যে ছিল ঘুড়ি কেনা। একশটাকায় পলিথিন দিয়ে তৈরি একটি চং ঘুড়ি কিনেছে। এতেই সে মহাখুশি। রকম খুশি মেলায় আগত শিশু-কিশোরদের সবার মুখে। টম টম, খেলার একতারা বা স্থানীয় নাম করকরি কিনলেও ঘুড়ি না কিনলে মেলায় আসা যেন শিশু-কিশোরদের পরিপূর্ণতা পায় না। কলেজছাত্র পিয়াস ইসলাম প্রতি বছরই মেলায় আসেন ঘুড়ি কিনতে। স্কুলে পড়ার সময় বাড়ির বড়দের সঙ্গে আসতেন। এখন আসেন বন্ধুর সঙ্গে। প্রিয় ঘুড়ি কিনেছেন  দেড়শটাকায়। মেলাপ্রাঙ্গণে দেখা সত্তর বছরের বৃদ্ধ আফজালের সঙ্গে। জানালেন শিশু বয়স থেকে মেলায় আসেন। এটির নাম কাটাচাপড়ের মাঠ। কবে থেকে মেলা শুরু হয়েছে তা বলতে পারেন না। জানালেন পিতামহের সময়ও মেলা ছিল।  এটি নিশানের মেলা নামেই পরিচিত। ছোটবেলার মেলায় আসার অভ্যাস এখনো রয়েছে। মেলা  থেকে কিছু কেনেন না। তবে এখনো মেলায় আসেন। তিনি জানালেন, মেলায় ঘুড়ি আগেও ছিল, তবে এখন ঘুড়ির বেচা-কেনা বেড়ে যাওয়ায় অনেকে শুধু ঘুড়ির উৎসব দেখতেই মেলায় আসেন।

মেলার মূল অংশের বাইরে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের মাঝে পটে আঁকা চিত্রের মতো ঘুড়ি বা গুড্ডি কেনা-বেচার পসরা। অর্ধশতাধিক বিক্রেতা বর্ণালি ঘুড়ি নিয়ে বসেছেন তালগাছতলায় সবুজের আবহে। একেকজন ঘুড়ির নাম দিয়েছেন এক একটি। কোনোটির নাম কঙ্কাল ঘুড়ি, কোনোটির নাম মানুষ ঘুড়ি, কোনোটি আবার বাক্স ঘুড়ি। ছাড়া রয়েছে চিলা ঘুড়ি, ফেঁচা ঘুড়ি, বিমান ঘুড়ি, চং ঘুড়ি, ঈগল ঘুড়িসহ নানা নামের ঘুড়ি। ৫০ বছর ধরে মেলায় ঘুড়ি বিক্রি করেন বৃদ্ধ আফজাল। সাহায্যের জন্য মোস্তফাকে নিয়ে এসেছেন। মোস্তাফা এক সময় পিতার সঙ্গে মেলায় আসতেন। এখন পিতাকে নিয়ে মেলায় এসেছেন। তাদের নিকট রয়েছে একমাত্র বাক্স ঘুড়ি।

প্রায় চার ফুট উচ্চতার এই ঘুড়ি তৈরি করা হয়েছে ছোট ছোট আটটি বাক্স বাঁশের কাঠির সঙ্গে জোড়া দিয়ে। আরেক বিক্রিতা প্রায় সত্তর বছরের সুমন মালি জানান, ১০ বছর থেকে তিনি মেলায় আসছেন। জানালেন, যে ঘুড়ি যত উচ্চতায় উড়িয়ে দেখানো যায় তার দাম বেশি। ঘুড়ি বিক্রিতারা জানালেন, আগেও মেলায় তারা বিক্রি করেছেন, তবে তা ছিল কাগজের ঘুড়ি। এখন ক্রেতারা টেকসই ঘুড়ি খোঁজেন বলে তারা রঙিন নানা পলিথিন দিয়ে ঘুরি তৈরি করছেন। এগুলো সহজে ছেঁড়ে না। তাই মেলা থেকে হারিয়ে গেছে  সেই কাগজের ঘুড়ি। ঘুড়িতে অভিনবত্ব আসলেও কাগজের ঘুড়ি আর নেই। তবে নিয়ে ঘুড়ি ক্রেতা শিশু-কিশোর বা তরুণদের কোনো আক্ষেপ নেই। মেলায় ঘুড়ি আগের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়েছে বলে বিক্রেতারা বলে জানান। শিশু ছামিউল বাবা-মার সঙ্গে মেলায় বেড়াতে এসে বায়না ধরেছে ঘুড়ি কিনবে। তার পিতা মেহের ছেলের আব্দার  মেটাতে এসেছেন ঘুড়ি কিনতে। তার হাতেও উঠবে পলিথিনের ঘুড়ি, কাগজের নয়। মেলার এক একটি ঘুড়ির দাম একশথেকে আটশটাকা পর্যন্ত। দাম যাই হোক, শিশু-কিশোরদের বায়না মেটাতেই হচ্ছে বড়দের। মেলার মূল অংশে আসবাবপত্র, কসমেটিকস, চুরি-ফিতা, খেলনাসহ নানা ধরনের দই-মিষ্টির দোকান রয়েছে। এবার মেলায় সর্বোচ্চ ১২ কেজি ওজনের মাছ আকারের মিষ্টি এনেছেন গাবতলীর অনিপ মিষ্টান্ন ভা-ার। এক একটি মিষ্টির দোকনে ৫০ থেকে দুশমণ মিষ্টি এনেছেন বিক্রেতারা। নাম দিয়েছেন জামাই মিষ্টিসহ নানা আকর্ষণীয় নামে।

×