ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

পাকি সেনাদের বিরুদ্ধে অপারেশন

একটি বটগাছ ঘিরে মুক্তিযুদ্ধের অনন্য স্মৃতি

​​​​​​​তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ২২:০২, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩

একটি বটগাছ ঘিরে  মুক্তিযুদ্ধের অনন্য  স্মৃতি

নীলফামারীর ডিমলার শোভানগঞ্জ গ্রামের এই বটগাছটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বাতিঘর

রক্তঝরা সেই দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসে। এই সাগরেই মিশে আছে তাঁরও এক ফোঁটা রক্ত। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছেন পরবর্তী প্রজন্ম। কঠিনের বিপরীতে সহজ-সরলতার, ঝড়-ঝাপটায় অদম্য শক্তি নিয়ে টিকে থাকার প্রতীক একটি বটগাছ হয়ে উঠেছে জীবন্ত ইতিহাস। এই বটগাছ নিয়ে যে কাহিনী আছে তা মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য স্মৃতি। বটগাছটিই ছিল তখন খানসেনাদের বিরুদ্ধে অপারেশনে যাওয়া ফিরে আসার মুক্তিযোদ্ধাদের নিশানা বা ঠিকানা। তাই মুক্তিযোদ্ধারা ৭১ সালে বটগাছটিকেও তাদেরসহযোদ্ধাহিসেবে মনে করতেন। 

নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের শোভানগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে এই বটগাছের অবস্থান।  বটগাছটিও ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন বৈঠকের সাথী। দেড়শবছরের এই বটগাছটি৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পথ দেখানোর সাক্ষ্য বহন করছে।৭১-এর যুদ্ধে ছয় নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ওই গাছটি ঘিরে আজও তুলে ধরেন স্মৃতির ঝাঁপি। পাকি সেনাদের বিরুদ্ধে অপারেশন আগে অপারেশন শেষে ক্যা¤েপ ফেরার সময় বটগাছের তলায় একে একে জড়ো হতেন মুক্তিযোদ্ধারা। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা গোনা, কে ফিরলেন কে ফিরলেন না। সংখ্যা মিলিয়ে আবার ক্যা¤েপ ফিরতেন তারা।

ছয় নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই। ডিমলা উপজেলার শোভানগঞ্জ বালাপাড়া স্থানীয় বাসিন্দা। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত নীলফামারী জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার ক্রমিক নম্বর ১৪৯তে তার নাম ঠিকানা স্পষ্ট। তার বেসামরিক গেজেট নম্বর ৭১৩। স্মার্ট কার্ড পরিচিতি নম্বর ০১৭৩০০০০১৯৩, লালমুক্তিবার্তা নম্বর ০৩১৫০২০১০৭ এবং  মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকা নম্বর ৪০৫৮২। বর্তমানে তার বয়স ৭১ বছর। পেশায় শিক্ষক ছিলেন। ২০১৪ সালে অবসরে যান। সংসারে রয়েছে স্ত্রী ছেলে মেয়ে। তিনি জানালেন, আমাদের নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন এম খাদেমুল বাশার। প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন মোসলেম উদ্দিন (পীরগাছা) পঞ্চগড়ের ভোজনপুর ক্যাম্প থেকে আমাদের স্থানান্তর করা হয় লালমনিরহাটের বুড়িমারী। তখন বুড়িমারী কাম্পে ছিল ৪০০ মুক্তিযোদ্ধা। সেখানে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এবং ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। সে সময় পাকিস্তানের জেলে বন্দি বঙ্গবন্ধু। তাজউদ্দীন আহমদ আমাদের বলে গেলেন, বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পেতে আমাদের যুদ্ধে জয়লাভ করতে হবে। আমরা শপথ নিলাম বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনতে জীবন দিয়ে হলেও দেশ স্বাধীন করবই। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযোদ্ধাদের গাইডলাইন দিলেন। সকল মুক্তিযোদ্ধা আরও বেশি সোচ্চার হয়ে উঠলেন। পরিকল্পনা মাফিক বুড়িমারী থেকে আমরা গীতালদহ ক্যাম্পে আসি। সেখান থেকে  তিস্তা নদী পার হয়ে আমরা কৈমারী অপরারেশনে যাই।

তিস্তাপাড়ে কাঁশবনের আঘাতে আমাদের হাত-পা শরীর থেকে প্রচুর রক্তপাত হয়েছিল। ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে  যুদ্ধে আমরা ১৭ জন পাকসেনাকে গুলি করে মারতে পারি। তবে আমাদের সহযোদ্ধা ডাউয়াবাড়ির মোজাফফর হোসেন মঞ্জু পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হন। ডিমলা বালাপাড়া টুনিরহাট শোভারগঞ্জ এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেই।

ওই বটগাছটি নিয়ে মেলে ধরেন তার  স্মৃতির ঝাঁপি। গাছটি ছিল বাতিঘরের মতো। ডিমলার ছাতনাই আর বালাপাড়া। সম্মুখযুদ্ধের রণক্ষেত্র। অনেক সহযোদ্ধা হারিয়েছি। ডাঙ্গারহাট এবং টুনিরহাট এলাকায় ছিল পাকিস্তানি সেনাদের বড় ক্যা¤প। অন্যদিকে ঠাকুরগঞ্জ এলাকার আশপাশে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ছয়টি ক্যা¤প। আমরা প্রতিদিনই চেষ্টা চালাতাম সামনে এগোতে। আর পাকিস্তানি সেনারা তৎপর থাকত আমাদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করতে। অবশেষে আমরা বিজয়ী হই। পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি সেনা আর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মাঝামাঝি এক জায়গায় এই বটগাছ। এই গাছের নিচে আমরা একত্র হতাম, আক্রমণের কৌশল নির্ধারণ করতাম। যুদ্ধ শেষে আবার এই বটের তলেই সমবেত হতাম। সংখ্যা মেলানোর কাজ শেষ হলে মুক্তিযোদ্ধারা নিজ নিজ ক্যাম্পে ফিরে যেতেন।

আব্দুল হাইয়ের সঙ্গে ডিমলার ঠাকুরগঞ্জ এলাকার ওয়ালিউর কবীর চৌধুরী (৭২) ছিলেন। ওয়ালিউর কবীর চৌধুরী নীলফামারীর জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ক্রমিক নম্বর ৫৫২। বেসামরিক গেজেট নম্বর ৭০০। স্মার্ট কার্ড পরিচিতি নম্বর ০১৭৩০০০০৮০৯, লালমুক্তিবার্তা নম্বর ০৩১৫০১০০৪৭ এবং  মুক্তিযোদ্ধার ভারতীয় তালিকা নম্বর ৪১৩৬২। তিনি জানান, দেশের বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন এই এলাকার বিভিন্ন ক্যা¤েপ। সবাই সব জায়গা চিনে উঠতে পারত না, কিন্তু বটগাছটি সবাই চিনত। ওটাই ছিল নিশানা। সামনে ছিল জঙ্গল। স্কুল ঘরটি ছিল বাঁশের চাটাইয়ে ঘেরা। বর্তমানে বিল্ডিং হয়েছে। বটগাছের গোড়াটি পাকা করে সেখানে টাইলস দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ৭১ এর যুদ্ধোর সময় বটগাছটিতে প্রচুর পাতা জঙ্গল থাকায় আমরা মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে নিরাপদে অবস্থান করতাম। খান সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার আগে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে এখানে সময় মতো হাজির হতাম পরে অপারেশন শেষ করে আমরা এখানে এসে সকলে মিলিত হতাম। অনেক সহযোদ্ধাকে হারাতে হয়। এর মধ্যে ছিল আরশাদ আলী। তিনি শায়িত আছেন নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পশ্চিম ছাতনাই ইউনিয়নে। তার নামেই গ্রামের নামকরণ করা হয় আরশাদগঞ্জ। ওয়ালিউর রহমান চৌধুরী  বলেন, ভারত থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত আমরা মুক্তিযোদ্ধারা ডিমলাকে ৬টি কোম্পানি বা অঞ্চলে ভাগ করে নিয়েছিলাম। সেগুলো স্থান হলো দক্ষিণ বালাপাড়া অঞ্চলে মাহাবুব কোম্পানি, ঠাকুরগঞ্জ অঞ্চলে মনির কোম্পানি, টুনির হাট গীতালদাহ অঞ্চলে সিদ্দিক কোম্পানি, কলোনী দোহলপাড়া অঞ্চলে রওশন কোম্পানি, রহমানগঞ্জ টেপাখড়িবাড়ি অঞ্চলে হারেছ কোম্পানি তিস্তা নদীর তীর অঞ্চল মতিন কোম্পানি।

এই ৬টি কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা যে সকল অস্ত্র ব্যবহার করেছিল তা হলো এসএলআর থ্রি নট থ্রি রাইফেল, এলএমজি টুইন্স মটার, শর্টমেশিন গান, এন্টি পারসোনাল ১৬ মাইন, এন্টিপারসোনাল ১৪ মাইনসহ আরও বেশকিছু অস্ত্র। ১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবর। ভোর ৪টা ৪০ মিনিট থেকে আমরা ডিমলার টুনিরহাটে পাক সেনাদের পিছু হটাতে প্রস্তুতি নেই। সেখানে মাহাবুব কোম্পানি, মনির কোম্পানি, সিদ্দিক কোম্পানি রওশন কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা পজিশন নিয়ে থাকি। পাকি সেনারা ভারি অস্ত্রে সজ্জিত। আমরা ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ শুরু। দুই দিক হতে শুধু গুলি আর গুলির আওয়াজ। মাহাবুব কো¤পানির সাহসী দুই মুক্তিযোদ্ধা ছিল আরশাদ আলী সামছুল হক। তারা পাকি সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে চালাতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তাদের গুলিতে দশজন পাকি সেনা মারা যায়।

ওই সময় পাকি সেনাদের বৃষ্টির মতো গুলিতে আরশাদ আলীর পেটে গুলিবিদ্ধ হয়। পাকি সেনারা তাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টার সময় আমরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে তারা গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। ওই সময় অন্য মুক্তিযোদ্ধারা আরশাদ আলীতে আহত অবস্থায় কাঁধে করে তুলে নিয়ে যায় মুক্ত অঞ্চল বাদিয়াপাড়া গ্রামে (বর্তমান আরশাদগঞ্জ) কিন্তু পেটে গুলি লাগায় তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়ালিউর রহমান চৌধুরী আরও জানান, ওই সময় পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়ে মুক্তিযোদ্ধা শামছুল হক। তাকে আমরা উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হলে পাকসেনারা শামছুল হককে ধরে নিয়ে যায় ডিমলা বাবুরহাটের রামডাঙ্গা পুরান থানা ক্যাম্পে তাঁকে তিনদিন অমানুসিক নির্যাতন করে হত্যা করে পাকি সেনারা। পরে তাঁর লাশ পুরাতন থানা চত্বরে পুঁতে রাখে খান সেনারা। এর আগে ১৮ অক্টোবর একই উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের ব্রিজের ডাঙ্গায় শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী। তাঁর বাড়ি ছিল খুলনা জেলায়। তাঁকে আরশাদগঞ্জের পাশের ঠাকুরগঞ্জ বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে দাফন করা হয়। তাঁর স্বজনদের পরিচয় এখনো অজানা।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়ালিউর রহমান চৌধুরী আরও জানান, ঠাকুরগঞ্জ বাজারের মধ্যস্থলে পশ্চিম ছাতনাই কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে শ্বেতপাথরে বাঁধাই করা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর কবর। সেখান থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার উত্তরে মধ্য ছাতনাই গ্রামে একটি গণকবরের স্থান। এর পাশেই আরেকটি সমাধি। ছয় বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা না গেলেও একজনের নাম ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বপন। স্বপনের বাড়ি দিনাজপুরে। গ্রেনেডের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ আলাদাভাবে কবর দেওয়া সম্ভব না হওয়ার কারণে তাঁদের সেদিন গণকবর দেয়া হয়েছিল।

তিনি আরও বলেন, ১১ ডিসেম্বর আমরা ডিমলা উপজেলাকে হানাদারমুক্ত করতে সক্ষম হই। কিন্তু যুদ্ধকালীন আমাদের হারাতে হয় ডিমলা অঞ্চলে প্রায় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধাকে। যা আমরা যুদ্ধ করে ফিরে সেই বটগাছের নিচে গুনতির সময় তাদের আর দেখা পাইনি। কিন্তু আজও আমরা সেই বটগাছটির দিকে তাকালে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের চেহারাটি মনের হৃদয়ে ভেসে উঠে। মনে হয় জীবিত বটগাছটি যেন বলছে তোমাদের সহযোদ্ধারা শহীদ হলেও আমি তাদের স্মৃতি হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছি।

 

×