![মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আয়োজনে বিজয় উৎসব শুরু মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আয়োজনে বিজয় উৎসব শুরু](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2023May/b3-2312091837.jpg)
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের বিজয় উৎসবে ভয়েস অব কনসায়েন্স শীর্ষক প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শনী শেষে কথা বলেন শাহরিয়ার কবির
চলছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। বাঙালির বীরত্বগাথার উদ্যাপনে শহরজুড়ে শুরু হয়েছে নানা আয়োজন। সেই ¯্রােতধারায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আয়োজনে শুরু হলো বিজয় উৎসব। চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নাচ-গান ও আবৃত্তি পরিবেশনা, শিশু-কিশোরদের আনন্দানুষ্ঠান, বিশিষ্টজনদের কথনসহ নানা আনুষ্ঠানিকতায় সজ্জিত হয়েছে এ উৎসব। বাংলাদেশের গণহত্যা বিষয়ে পাকিস্তানি ভিন্ন মতালম্বীদের ধারাভাষ্যময় ভয়েস অব কনসায়েন্স শীর্ষক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে ছয় দিনব্যাপী উৎসবের সূচনা হয় শনিবার। এদিন বিকেলে আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে শাহরিয়ার কবির নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রটির উদ্বোধনী প্রদর্শিত হয়।
৪৫ মিনিট ব্যাপ্তির প্রামাণ্যচিত্রে একাত্তরের বাংলাদেশে সংঘটিত পাকিস্তানের গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের বয়ান উঠে এসেছে দেশটির বিবেকবান কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকারকর্মীদের বয়ানে। তাদের মধ্যে রয়েছেন কবি হাবিব জালিব, আহমাদ সেলিম, আসমা জাহাঙ্গীর, সাংবাদিক হামিদ মীর, নৃত্যশিল্পী সীমা কিরমানি, বিচারক সৈয়দ আসিফ শেখার প্রমুখ। তাদের অনেকেই ১৯৭১ সালে এই গণহত্যার প্রতিবাদ করে কারা নির্যাতনসহ নানা ধরনের নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন।
এই ছবিতে তারা একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার বিবরণ দিয়েছেন। পাশাপাশি পাকিস্তানের বর্তমান প্রজন্মের লেখক ও গবেষকরা কীভাবে এই গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য পাকিস্তানে জনমত সৃষ্টি করছেন সে সব বিষয় বর্ণিত হয়েছে প্রামাণ্যচিত্রে। গণহত্যার প্রতিবাদকারী কয়েকজন পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী সরকারি নির্যাতনের কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়ার তথ্যও রয়েছে এই প্রামাণ্যচিত্রে। একাত্তরে পাকিস্তানি বর্বরতায় ক্ষুব্ধ দেশটির তেমনই এক বিবেকবান রাজনীতিবিদ নাসিমা আখতার মালিককে বলতে শোনা যায়, আমাকে একটা বোমা এনে দাও, পাকিস্তানের আর্মি হেডকোয়ার্টারে মেরে দিই।
এর পর তিনি বলেন, যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হলো তখন পাকিস্তানজুডে কবরের নীরবতা নেমে এসেছিল। ওই প্রামাণ্যচিত্রে জানা যায়, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আমন্ত্রণে পাকিস্তানের তিনজন প্রবীণ ও নবীন লেখক আহমাদ সেলিম, আনাম জাকারিয়া ও হারুণ খালেদ বাংলাদেশে এসেছিলেন ’৭১ এর গণহত্যা সম্পর্কে জানার জন্য। তারা গণহত্যার ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি কয়েকটি বধ্যভূমি পরিদর্শন করেছেন এবং বিভিন্ন সেমিনারে এ বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করেছেন। দেশে ফিরে আনাম জাকারিয়া এ বিষয়ে ‘নাইন্টিন সেভেন্টি ওয়ান’ নামের একটি বিশাল গ্রন্থ লেখেন, যেটি পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত হয়। এই বই লেখার কারণে লেখক দম্পতি আনাম জাকারিয়া ও হারুণ খালিদকে পাকিস্তান ত্যাগ করতে হয়েছে। এসব ঘটনা তুলে ধরার পাশাপাশি প্রামাণ্যচিত্রে পাকিদের নারী নির্যাতনের বিষয়ে মর্মস্পর্শী বক্তব্য দিয়েছেন ঘটনার স্বীকার ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী।
প্রদর্শনীর পূর্বে বিশ্বের নানা প্রান্তের জাদুঘর, ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দ্য ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন অব সাইটস অব কনসায়েন্সের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান ইসরায়েলি বর্বরতার প্রতিবাদ জানানো হয়। প্রতিষ্ঠানটি ওই বক্তব্যের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সংহতি প্রকাশ করে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জাদুঘরের ট্রাস্টি সারা যাকের। ওই বক্তব্যে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি, গাজাবাসীকে মানবিক সাহায্য প্রদান, ইসরায়েলিদের কাছে বন্দি ফিলিস্তিনিদের মুক্তি, হামাসের কাছে বন্দি থাকা ইসরায়েলিদের মুক্তি এবং ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের সমঅধিকারের দাবি জানানো হয়।
প্রদর্শনী শেষে আলোচনায় অংশ নেন শাহরিয়ার, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও চলচ্চিত্র নির্মাতা নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আরেক ট্রাস্টি আসাদুজ্জামান নূর।
অনুভূতি প্রকাশে, শাহরিয়ার কবির বলেন, এই ছবিটি করতে দশ বছর সময় লেগেছে। পাকিস্তানে শুটিং করতে গিয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়েছে। হোটেল থেকে আইএসআই তুলে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ দূতাবাসে আশ্রয় নিতে হয়েছে। এসব বিবেচনায় বলা যায়, যতদিন পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষ বাংলাদেশে গণহত্যার বিষয়টি না মানবে ততদিন পর্যন্ত জেনোসাইডের স্বীকৃতি পাওয়া কঠিন।
এই জন্যই পাকিস্তানে জনমত গঠন করা প্রয়োজন। এখনো পাকিস্তানে কিছু মানুষ আছেন যারা দেশটির যুদ্ধাপরাধের জন্য ক্ষমা চাওয়ার পাশাপাশি একাত্তরের বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার স্বীকৃতি চায়। এ কারণে ২০১৩ সালে ৩.৬ শতাংশ থেকে বর্তমানে ৩১ শতাংশ পাকিস্তানি জনগণ এই স্বীকৃতি চান। আর যখন স্বীকৃতি পাবে তখন গণহত্যার অস্বীকারকারীদের জন্য একটা বড় জবাব হবে এই প্রামাণ্যচিত্র।