ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান 

প্রকাশিত: ০০:০৬, ৮ ডিসেম্বর ২০২৩

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

ঢাকার বঙ্গবাজারে অযতœ-অবহেলার শিকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাস্কর্য।

বিজয় দিবস সামনে। মহান এই দিবস উদ্যাপনের প্রস্তুতি চলছে এখন। কিন্তু এইসব উদ্যাপনে, মানতেই হবে, আনুষ্ঠানিকতা বেশি। মুক্তিযুদ্ধটাকে বোঝার, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করার লোকের ভীষণ অভাব। যত দিন যাচ্ছে এ অভাব তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। চারপাশের পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করুন, খুব উদ্বেগজনক কিন্তু। একটা অংশ ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ‘জয় বাংলা’ বিশেষ করে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটির অপব্যবহার করছে। এর প্রভাব পড়ছে সমাজে। অন্যদিকে রাজাকার আলবদরদের প্রজন্ম একাত্তরের সমস্ত অর্জনকে অস্বীকার করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই অপশক্তি মারাত্মক সক্রিয়। যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে বাংলাদেশ হলো সেই স্লোগান নিয়ে রীতিমতো তামশা করছে এরা।

জাতীয় সংগীতের বিরোধিতা করতেও দ্বিধা করছে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেওয়া বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অসম্মান করা, ছোট করা, বাজেভাবে উপস্থাপন করা এদের নিত্যদিনের কাজ। ভয়ানক দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, দিন রাত মোবাইলে ফোনে মজে থাকা প্রজন্মটিকে এরা সহজেই বিভ্রান্ত করতে পারছে। ক’দিন আগে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট বিশ্বকাপের কথাই যদি বলি, ক’দিন আগে আমরা কি ফাইনাল ম্যাচ দেখেছি? মোটেও না। বরং দেখেছি ভারত-বিদ্বেষ। বর্তমান প্রজন্মের বহু ছেলে মেয়ে ভারতের হার উদ্যাপন করেছে। উদ্যাপনের ছবিটা, এক কথায় বললে, কুৎসিত ছিল।

অস্ট্রেলিয়াকে সমর্থন করার নামে ভারতকে তারা হেয় করেছে। ভারতীয়দের নোংরা ভাষায় আক্রমণ করেছে। কিন্তু কেন? কী আছে এর পেছনে? উত্তরটি খুব সহজ। ১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। বাংলাদেশের বিপদগ্রস্ত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল তারা। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছিল। তাঁদের অস্ত্রের জোগান দিয়েছিল। এমনকি ডিসেম্বরে এসে সরাসরি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল ভারতীয় সেনারা। এর ফলে পাকিস্তানি বর্বর সেনা বাহিনী মাথা নত করে বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। এ দেশের হয়েও তখন যারা পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়েছিল, যারা যুদ্ধাপরাধী তারা মহা এই সত্য মেনে নিতে পারেনি কোনোদিন। তারা এবং তাদের প্রজন্ম সুযোগ পেলেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় নেমে যায়। একই কারণে চরম ভারত বিদ্বেষী তারা।

আরেকটি অংশ সাম্রাজ্যবাদের নামে ভারত বিরোধিতা করে। অথচ আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদের গোলাম হতে বাধে না! কখনো কোনকালে এরা একাত্তরের ভূমিকার জন্য পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রটিকে ধন্যবাদ জানায় না। বরং নিন্দা মন্দ করাটাকেই দায়িত্ব মনে করে। মূলত এসবের প্রভাব পড়েছে ক্রিকেটে। খেলাটিকে রীতিমতো হিংসা ও সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে মৌলবাদী গোষ্ঠী। অনেকে না জেনে বুঝে এদের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার কার্যকর উদ্যোগ নেই। কোন প্রক্রিয়ায় এগোলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সফল বাস্তবায়ন ঘটবে, কেউ সেটি নিয়ে ভাবছে না। যে যার মতো করে মুখস্থ ইতিহাস বলছেন। চলছে বক্তৃতাবাজি।

এই যে বিজয় দিবস আসছে, আলোচনাগুলো খেয়াল করুন। ইতিহাস চর্চা সেখানে পাবেন না। বড় বড় আলোচনাসভা হবে। সেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাউকে দেখবেন না। মঞ্চে বসে থাকতে দেখবেন মন্ত্রী এমপি সচিব ডিসি এসপিসহ পয়সাওয়ালাদের। সব শেষের চেয়ারে কখনো সখনো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে দেখতে পাবেন। এসব সভা থেকে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগে কথা বলা হচ্ছে। ধর্ষণের শিকার নারীদের কথা বলা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু মহান এই নেতার অনুপস্থিতিতে তাঁরই যোগ্য উত্তরসূরি তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন।

কিন্তু এ নামটি নেয়া হচ্ছে কি? কী সমস্যা? যারা অস্ত্র হাতে লড়াই করে দেশ উপহার দিলেন সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা বক্তৃতার শুরুতে কেউ কি বলেন? কত বীর সম্মুখ সমরে শেষ পর্যন্ত লড়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন! তাঁদের আলাদাভাবে স্মরণ করার কোন দিবস কি আছে? সব মিলিয়ে এক ধরনের অনাচার চলছে, বলতে হবে। বিজয় দিবস মানে ভবনে আলোকসজ্জা করা নয় শুধু। ঠেলাঠেলি করে স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়াও মুক্তিযুদ্ধ নয়। আরও গভীরে যেতে হবে। প্রকৃতি চেতনায় জেগে উঠতে হবে। এবারের বিজয় দিবসে আসুন সে চেষ্টা করি। বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকা থেকেই এর সূচনা হোক। হতে পারে না?

×