
শিল্পকলায় জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীর ছবি দেখছেন দর্শনার্থীরা
শিল্পানুরাগীদের জন্য শুরু হলো চমৎকার এক আয়োজন। সেই সুবাদে শিল্পরসিকদের গন্তব্য এখন শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা। এখানে চলছে জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীর ২৫তম আসর। চিত্রশালার সাতটি গ্যালারিজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বহুমাত্রিক শিল্পসম্ভার। বিবিধ বিষয়ের দেখা মিলছে চিত্রকর্ম থেকে ভাস্কর্য কিংবা স্থাপনাশিল্পের শরীরে। সেসবে ধরা দিয়েছে নিসর্গের নান্দনিকতা থেকে জীবন বাস্তবতা। মুগ্ধতার হাতছানি ছড়াচ্ছে সমকালীন সময় থেকে বৈশ্বিক সংকট কিংবা বিভিন্ন ইস্যুনির্ভর শিল্পকর্ম। প্রচলিত ধারার কাজের সমান্তরালে উপস্থাপিত হয়েছে নিরীক্ষাধর্মী কাজ। বৈভবময় আয়োজনটিতে চিত্রকলা, ছাপচিত্র, আলোকচিত্র, ভাস্কর্য, প্রাচ্যকলা, মৃৎশিল্প, কারুশিল্প, নিউ মিডিয়া আর্ট, স্থাপনাশিল্প, পারফরমেন্স আর্টসহ ১১টি মাধ্যমের কাজে সম্মিলন ঘটেছে। দেশের নানা প্রান্তের ২৬১ শিল্পীর সৃজিত ৩০১টি শিল্পকর্মে সেজেছে এ শিল্পযজ্ঞ। এসব শিল্পকর্মের সঙ্গে শিল্পরসিকদের হৃদয় রাঙাচ্ছে ছয়টি কিউরেটেড কাজ। এগুলোর মধ্যে শিল্পপ্রেমীদের নজর কাড়ছে পথিকৃৎ চিত্রকর এস এম সুলতানের চিত্রকর্ম এবং তার আলোকচিত্র ও ব্যবহার্য পণ্য নিয়ে ৫ নং গ্যালারির প্রদর্শনীটি।
বর্ণিল রং আশ্রিত তিনটি ছবির একটি কোলাজ ফ্রেমে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর এক নারীর ছবি এঁকেছেন জয়তু চাকমা। পাহাড়বাসী ওই নারীর শরীরে শোভা পাচ্ছে তাদের নিজস্ব নানা গহনা। চুলের বেণি ধরে ঝুলে আছে দু’টি রক্তজবা। সুদূরের পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ তার একটি চোখ। আর অপর নয়নটি ঢেকে গেছে ছাই রংয়ের ধোঁয়ায়। একইভাবে ঠোঁট থেকে বের হচ্ছে ধোঁয়ার কু-লী। এভাবেই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের সংকটসহ ওই জনপদের প্রাণ ও প্রকৃতিবিনাশী অপতৎরপরতার ধারাভাষ্য হয়ে উঠেছে নির্বাপিত সত্তা শীর্ষক চিত্রকর্মটি। ক্যানভাসে শীতল পাটির মাঝে হাতপাখা ও হ্যাজাক বাতি এঁকে শৈশবের স্মৃতি খুঁজে ফিরেছেন সামিনা নাফিজ। সবুজের চিতা শিরোনামের ছবিতে বৃক্ষ ও তার ডালাপালার মাঝে মানব শরীরের অবয়ব মেলে ধরেছেন আশরাফুল হাসান। অসংখ্য পাইপ জুড়ে সৃষ্ট স্বাধীনতার মৃত্যুঞ্জয়ী কবি শীর্ষক স্থাপনাশিল্পে নিপুণ দক্ষতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি মেলে ধরেছেন এস এম মিজানুর রহমান। লিভিং ইন ওয়াটার শিরোনামের আরেকটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাশিল্পে জলে ভেসে থাকা জীবনের গল্প বলেছেন বিলাস মন্ডল। প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত এমন অনেক শিল্পকর্ম যেন দেশের চারুশিল্পের নতুন দিনের বারতা দিচ্ছে।
রবিবার সন্ধ্যায় জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত ২৫তম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীর সূচনা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সবগুলো মাধ্যম থেকে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের মধ্যে একজনকে দুই লাখ টাকা মূল্যমানের গ্র্যান্ড পুরস্কার প্রদান করা জহয়। এছাড়া ১১টি মাধ্যমের প্রত্যেকটি থেকে একটি করে এক লাখ টাকা মূল্যমানের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দেয়া হয়। প্রদান করা হয় ২৫ হাজার টাকা মূল্যমানের পাঁচটি সম্মানসূচক পুরস্কার। স্থাপনাশিল্প গড়ে সকল মাধ্যমের শ্রেষ্ঠ হিসেবে শিল্পকলা একাডেমির নামাঙ্কিত গ্র্যান্ড পুরস্কারটি জিতেছেন জেসমিন আকতার। চিত্রকলা বিভাগে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছেন জয়তু চাকমা। এছাড়া ভাস্কর্য মাধ্যমে সৈয়দ তারেক রহমান, স্থাপনাশিল্পে সঞ্জীব কুমার দেম, ছাপচিত্রে নুসরাত জাহান, গ্রাফিক ডিজাইনে জিহাদ রাব্বি, কারুকলায় ফারহানা ফেরদৌসী, মৃৎশিল্পে অসীম হালদার, আলোকচিত্রে মো. আসাদুর জামান আসলাম মোল্লা ও পারফরমেন্স আর্টে মাহাবুবুর রহমান শ্রেষ্ঠ পুরস্কার জয় করেন। পুরস্কার হিসেবে তাদের অর্থমূলের সম্মানী এবং স্মারক ও সনদ প্রদান করা হয়। সম্মানসূচক পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেন আব্দুস সাত্তার, নাঈমা আখতার, রাউফুন নাহার রিতু, মো. তরিকুল ইসলাম ও আশরাফুল হাসান। পাঁচটি স্পন্সরশীল পুরস্কারের মধ্যে ফারেহা জেবা পেযেছেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশন পুরস্কার, অনুকূল চন্দ্র মজুমদার পেয়েছেন শিল্পী কালিদাস কর্মকার পুরস্কার, মোহাম্মদ হাসানুর রহমান পেয়েছেন শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন পুরস্কার, তানভীর পারভেজ পেয়েছেন ভাষা শহীদ গাজিউল হক পুরস্কার ও গোবিন্দ পাল পেয়েছেন চিত্রশিল্পী কাজী আনোয়ার হোসেন পুরস্কার।
প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী হাশেম খান ও সংস্কৃতি সচিব খলিল আহমদ। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির চারুকলা বিভাগের পরিচালক সৈয়দা মাহবুবা করিম। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে নৃত্য পরিবেশন করে জনপ্রিয় নৃত্য সংগঠন নৃত্যাঞ্চল।
শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার ৭টি গ্যালারিতে দেড় মাসব্যাপী এ প্রদর্শনী চলবে আগামী ১৫ জুলাই পর্যন্ত। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা এবং শুক্রবার বিকাল ৩টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকবে প্রদর্শনী।