ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

সম্প্রীতির বারতায় একুশের অনুষ্ঠানমালা শুরু

সংস্কৃতি প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০০:০৬, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

সম্প্রীতির বারতায় একুশের অনুষ্ঠানমালা শুরু

একুশের চেতনায় গড়তে হবে অসাম্প্রদায়িক স্বদেশ

একুশের চেতনায় গড়তে হবে অসাম্প্রদায়িক স্বদেশ।  সে লক্ষ্যে গড়ে তুলতে হবে সাংস্কৃতিক জাগরণ। সই সাংস্কৃতিক শক্তির কাছে পরাজিত হবে সাম্প্রদায়িক শক্তি। থাকবে না অশুভ শক্তির সৃষ্ট ধর্মীয় বিভাজন। ঘুচে যাবে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ। বিনির্মিত হবে  মানবিক বাংলাদেশ। এভাবেই সাংস্কৃতিক জাগরণের মাধ্যমে সম্প্রীতির বারতা ছড়িয়ে শুরু হলো  ১৪ দিনব্যাপী একুশের অনুষ্ঠানমালা।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে ‘চাই সাংস্কৃতিক জাগরণ ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ’ স্লোগানে বুধবার থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের এ অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। নাচের নান্দনিকতা, কবিতার শিল্পিত উচ্চারণ, সুরের ঐশ্বর্য, শিশু সংগঠনের পরিবেশনা, পথনাটকসহ বহুমাত্রিক পরিবেশনায় সজ্জিত হয়েছে এ আয়োজন। 
বিকেলে শহীদ মিনারের বেদিতে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণের মাধ্যমে ভাষাশহীদদের নিবেদিত অনুষ্ঠানের শুরু হয়।  জোট নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানান কবি, আবৃত্তিশিল্পী, নাট্যকর্মীসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। এর পর ভাষা আন্দোলন,  মুক্তিযুদ্ধসহ সকল আন্দোলন-সংগ্রামের শহীদদের স্মরণে পালন করা হয় নীরবতা। মৌনতা শেষে গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের শিল্পীদের কণ্ঠ ভেসে বেড়ায় ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানের সুর।

জাতীয় সংগীতের পর গাওয়া হয় একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। এর পর একুশের  অঙ্গীকারে সকল অনাচারের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার দৃঢ়তায় শিল্পীরা কণ্ঠে তুলে নেয়Ñ জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা/ শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা ... শীর্ষক সঙ্গীত। 
জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী আলোচনায় অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি মুহাম্মদ সামাদ, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আকতারুজ্জামান, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট, পথনাটক পরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট, নৃত্যশিল্পী সংস্থার পক্ষে ড. নিগার চৌধুরী, জোটের সহ-সাধারণ সম্পাদক আহাম্মদ গিয়াস, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিম-লীর সদস্য রেজিনা ওয়ালী লীনা প্রমুখ।  

হাবীবুল্লাহ সিরাজী রচিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ শীর্ষক কবিতা পাঠ করেন স্বাধীন বাংলা বেতারের কণ্ঠযোদ্ধা আশরাফুল আলম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আবৃত্তিশিল্পী আজহারুল হক আজাদ। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে ছিল গান, কবিতা, নৃত্য পরিবেশনা ও পথনাটকের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। 
আলোচনায় মুহাম্মদ সামাদ বলেন, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়েও বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। বিশেষ করে বদরুদ্দীন উমরের কিছু লেখায় এ ধরনের বিকৃত ইতিহাস উপস্থাপন করা হয়েছে। মূলত ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্রলীগের ডাকা হরতালের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামী অধ্যায়ের সূচনা হয়। সেদিনের হরতালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাজনৈতিক নেতা যিনি ভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে গ্রেপ্তার হন।

এর পর একুশের রক্তঝরা পথরেখাতেই উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। তবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও সাম্প্রদায়িকতা বিরাজমান রয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রে। এই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাজিত করতে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাঠামোতে পরিবর্তন ঘটাতে হবে। পাশাপাশি সংস্কৃতির শক্তিকে ছড়িয়ে দিতে হবে দেশের তৃণমূলে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দেশব্যাপী সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটছে না। এই জাগরণ ঘটাতে সংস্কৃতিকর্মীরা বার বার সংস্কৃতি খাতের বাজেট বৃদ্ধির দাবি জানালেও সেটি উপেক্ষিত হচ্ছে। এসন বাস্তবতায় সংস্কৃতিচর্চাকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় নীতিমালার পরিবর্তন ঘটিয়ে রুখে দিতে হবে সাম্প্রদায়িকতাকে।

অন্য বক্তারা বলেন, একুশের চেতনাস্রোত পথেই  বেড়ে উঠেছে এদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি। কিন্তু  সংস্কৃতির সেই সৌহার্দ্যপূর্ণ চরিত্রটি নষ্ট করছে সাম্প্রদায়িক শক্তি। প্রায়শই হিন্দু সম্প্রদায় হামলার শিকার হচ্ছে। সম্প্রীতি পূজাম-পে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এই অশুভ শক্তিকে রুখতে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। তৃণমূলে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিনাশ ঘটাতে হবে। পাশাপশি একুশের  রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন ঘটাতে হবে। 
আলোচনা শেষে ছিল সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হে পরিবেশন করে শিশু সংগঠন সীমান্ত খেলাঘরের খুদে লা বলীদান’ এবং ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ’ শীর্ষক সংগীত শিল্পীরা। বহ্নিশিখার শিল্পীরা গেয়ে শোনায় ‘অপমানে তুমি  জ্বলে উঠেছিলে সেদিন বর্ণমালাসহ বেশ কয়েকটি গান। সমবেত নৃত্য পরিবেশন করে স্পন্দনের শিল্পীরা। একক সংগীত পরিবেশন করেন জয়িতা খান, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রী ও ফয়জুল বারী। দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করেন স্বরশ্রুতি ও কণ্ঠশীলন। 
আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল সাড়ে চারটায় শহীদ মিনারে চলবে একুশের অনুষ্ঠানমালা। পরবর্তীতে ১৭ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আয়োজন স্থানান্তরিত রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ মঞ্চে। 

×