ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কৈশোর-বন্ধু আলী ইমাম

টুটুল মাহফুজ

প্রকাশিত: ২৩:১৩, ২ ডিসেম্বর ২০২২

কৈশোর-বন্ধু আলী ইমাম

.

আলী ইমাম এবং শিশুসাহিত্য- দুটোই সমার্থক। প্রায় ৫০ বছর ধরে নিরন্তর স্বপ্নবিলাসী শিশুসাহিত্য রচনার এক দক্ষ রাজকুমার তিনি। কেবলই শিশুমানস, শিশুজগত, শিশুকল্পনাকে ধারণ করে বহু বিচিত্র রচনা সম্ভারে সমৃদ্ধ করেছে তিনি বাংলা শিশুসাহিত্য। চিরায়ত রচনাভঙ্গি, ধ্রুপদ কাহিনী নির্মাণ এবং ক্লাসিকাল শিশুসাহিত্যের মর্মকে তিনি কর্মে রূপান্তর করেছেন। দেড় শতাধিক গ্রন্থের আয়নায় আলী ইমামকে প্রতিবিম্বিত করলে বিস্মিত হতে হয়। শিশুসাহিত্য জগতের যাবতীয় অনুষঙ্গ ও কলকব্জাকে সযতনে তিনি আত্মস্থ করেছেন। শব্দজালে বন্দি করেছেন মধুর ও বিধুর রূপকল্পনাকে। বৈচিত্র্যময় বিষয় তার সুলিখিত রচনাগুলো হয়ে উঠল শিশুসাহিত্যের সম্পদ। এই সম্পদ আঁকড়ে ধরে আমরা আলী ইমামকে নিয়ে খুলছি শোক বইয়ের পাতা। তিনি নেই। চিরতরে বিদায় নিলেন ২১ নভেম্বর ২০২২। সেদিনের সন্ধ্যা স্তব্ধ করে দিল আমাদের চারপাশ। কী বিষণœ এক মুহূর্ত আমাদের জাপটে ধরল খবরটা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে।

১৯৭৫ সালে প্রকাশিত তার গল্পগ্রন্থ ‘দ্বীপের নাম মধুবুনিয়া’, ১৯৭৮ সালে উপন্যাস ‘অপারেশন কাঁকনপুর’ প্রকাশিত হয় এবং ধারাবাহিকভাবে আরও কিছু উপন্যাস লিখেছেন। তারমধ্যে রহস্য উপন্যাস ‘তিরিমুখীর চৈতা (১৯৭৯)’, গল্পগ্রন্থ ‘রুপোলী ফিতে (১৯৭৯)’, ‘শাদা পরী (১৯৭৯)’, কিশোর উপন্যাস ‘ভয়ঙ্করের হাতছানি (১৯৯০)’ উল্লেখযোগ্য।
গল্প, কবিতা, উপন্যাস, গবেষণা, প্রকৃতি, পশুপাখি, চলচ্চিত্র প্রতিটি বিষয় তিনি শিশু সাহিত্যের পাতায় ভরিয়ে দিয়েছেন। সমৃদ্ধ করেছেন শিশুসাহিত্যের ভা-ার। যা কখনোই ফুরোবার নয়। দৃঢ়চিত্তে বলতে দ্বিধা নেই বাঙালির যে ঘরে শিশুকিশোর রয়েছে সেই ঘরে আছেন আলী ইমাম। বুকসেলফের কোনো এক তাকে শোভা পায় তারই গ্রন্থ। আলী ইমাম এমনই একজন অনিবার্য শিশুসাহিত্যিক হয়ে উঠেছিলেন, যাকে পাঠ করতেই হবে। তার রচনার জাদুকরি শব্দ বুননের স্পর্শে বাংলার প্রকৃতি হেসে ওঠে। বৈশাখ, নবান্ন, হেমন্ত, শিশির, ঘাসবিচালি, পাখ-পাখালি, আকাশ-চন্দ্র-সূর্য, তারা-নক্ষত্র-গ্রহ কোনো কিছুই এড়ায়নি আলী ইমামের চোখ থেকে।
আলী ইমামের সমগ্র শিশুসাহিত্যের গতিরেখা সামান্য আলোচনায় তুলে ধরা অসম্ভব। তবে জসীমউদ্দীন, হাবীবুর রহমান, ফয়েজ আহমদ, রোকনুজ্জামান খান, আতোয়ার রহমান, মোহাম্মদ নাসির আলী, হোসনে আরা, বন্দে আলী মিয়ারা যে ভিত্তিভূমি রচনা করেছেন আলী ইমাম তারই সার্থক উত্তরাধিকার। প্রায় নিঃসঙ্গ পথিক আলী ইমাম। বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে, অন্তর্নিহিত ভাবের দ্যোতনায় তার অধিকাংশ রচনাই সার্থক প্রয়াস। তার শিল্পিত মানস পরিস্ফুট হয়েছে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের মাধ্যমে।
শিশুর জগত হচ্ছে উত্তঙ্গ কল্পনার জগত। শিশু মানস অস্থির ও চঞ্চল। তার কৌতূহল আকাশের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত।
আলী ইমামও অসীমের পানে কল্পনার অভিযাত্রী। তাই যখন যা খুশি, যা নতুন, যা আগ্রহী করে তোলে শিশুদের সেসব প্রায় প্রতিটা বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেন। তিনি পাখিদের প্রতি মমতা ও দরদি মনে লিখেছেন প্রায় ২০টি বই। অপর পরিবেশ, সাহিত্য, বিখ্যাত মানুষদের জীবন কথা, পদার্থ, চলচ্চিত্র, রসায়ন, জীববিজ্ঞানের জটিল বিষয়সমূহকে উত্থাপন করেছেন সহজ ও অনাড়ম্বরভাবে।
কেবল শিশুদের জন্য আনন্দনগর নির্মাণেই ব্যস্ত রয়েছেন। সোনার কাঠি, রূপার কাঠি নিয়ে রূপকথার বন্ধ অর্গল যিনি খুলেছেন। যিনি বঙ্গোপসাগরের ধুধু বাতাসকে প্রবেশ করিয়েছেন আমাদের দূষিত ফুসফুসে।
আলী ইমাম আমাদের মানসিক বিকাশে সাহায্য করেছেন। জুগিয়েছেন মনের পুষ্টি। আমাদের অবহেলিত উপেক্ষিত শিশুসাহিত্যের মরুভূমে তিনি বারিবর্ষণ। আলী ইমামের রচনাশৈলী অসংখ্য বলেই মনোযোগ পাঠকদের কাছে কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ রচনা উপেক্ষিত থেকেছে। সমালোচকদের মনোভঙ্গিও তিনি জ্ঞাত হননি।
অনাদর এবং উপেক্ষা থাকলেও গত ৩০ বছর শিশুকিশোর পাঠকরা তার হৃদয়ের কাছাকাছি আছে। এখানেই তিনি সার্থক।
পাঠকরা তাকে বঞ্চিত করেনি। শিশু পাঠকরা সমালোচক নয় তারা আত্মপ্রচার সার্থক নয়। এ কারণেই শিশুসাহিত্যিকরা সামাজিকভাবে উপেক্ষিত হন। কারণ তাদের ভালোবাসার সন্তানেরা নবীন ও শিশু।
আলী ইমামের ভালোবাসার সন্তানেরা তাকে হৃদয় ও মন দিয়ে চিরদিন গ্রহণ করেছে। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখেও প্রমাণ করা যাবে না যে, আলী ইমাম কত বড় সাহিত্যিক। আবার এক কলম না লিখেও সহজেই বোঝা যাবে আলী ইমাম কত বড় লোক। কারণ তার সমগ্র রচনার মধ্যেই দীপ্যমান হয়ে আছেন তিনি। বইগুলো তার কথা কয়।
অঙ্কন : জাহিদ

×