ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এ কেমন জলবায়ু পরিবর্তন!

ঋতুগুলোয় জট পেকে গেছে- সকাল দুপুর সন্ধ্যায় গরমিল

সমুদ্র হক

প্রকাশিত: ২৩:৩৬, ৭ অক্টোবর ২০২২

ঋতুগুলোয় জট পেকে গেছে- সকাল দুপুর সন্ধ্যায় গরমিল

বগুড়ায় শুক্রবার সকালে ছিল ঘন কুয়াশা

শুক্রবার সকালে ভূমির ওপরে ভেসে আসা মেঘ যা কুয়াশা ও আগের রাতের ঘন শিশির জানিয়ে দিল শীত বুঝি আগাম নেমেই গেল। একটু পড়েই তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে শরীর ঘামতে থাকে। দুপুরে এক পশলা ভারি বৃষ্টি ও মেঘের গর্জন যেন বর্ষা। বিকেলের সময়টায় নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা বলে দিচ্ছে এ তো শরত। গোধূলি বেলায় ছাতিম তলায় ফুলের ম ম গন্ধ আভাস দিচ্ছে আরে হেমন্ত নাকি! জলবায়ু পরিবর্তনে প্রকৃতি এতটাই বিরূপ যে বাংলার কয়েকটি ঋতুকে একসঙ্গে জটে ফেলে দিয়েছে।
এতকাল যানজটের কথা শোনা গেছে। ঋতুও যে জটের ফেরে পড়ে তা বলে দিচ্ছে প্রকৃতি। গ্রীষ্ম বর্ষা শরত হেমন্ত সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে শরতের শেষের বেলা জট পাকিয়ে ফেলেছে। বাঙালীর ঋতুবৈচিত্র্যে বলা হয় ‘আশ্বিন গা করে শিন শিন।’ অর্থাৎ আশ্বিন মাসের শেষে শীতের একটু আভা চলে আসে। কার্তিক তো হেমন্তের শুরু। যা ঠেকে অগ্রহায়ণ পর্যন্ত। পৌষ মাঘ তো শীত। কিন্তু হলো টা কী!
কোন ঋতু তার অধিকার ছাড়তে রাজি নয়। এবারের  বৈশাখের গ্রীষ্মে বসন্ত কিছুটা অধিকার ফলিয়েছিল। জ্যৈষ্ঠে তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তবে তা কাঁঠাল পাকার মতো ছিল না। আষাঢ়ে বৃষ্টি তেমন ছিল না। শ্রাবণে বৃষ্টি ঝরেছে তবে তা রুটিন মেনে নয়। বর্ষার রেশ এসে পড়ে ভাদ্র-আশি^নে। বাঙালীর প্রবাদে আছে ভাদ্র মাসে তাল পাকাতে প্রকৃতি অন্য ধরনের গরম এনে দেয়। এবার তা ছিল, তবে কম। তাল তালগোল পাকিয়ে আপনা আপনি পেকেছে। আশ্বিন মাস ঠিক বোঝা যাচ্ছে না এটা শরত হেমন্ত না শীতের আভাস না গরম।
ঋতুর এমন জটে কৃষককুল দিশেহারা। সময়ে বৃষ্টি না হওয়াতে কৃষক আমনের সময় পরের দিকে রেখে সবজির আবাদে নেমে পড়ে। যেই না সবজি আবাদ একটু বেড়ে গেল অমনি বৃষ্টি আঘাত করে সব বরবাদ করে দিল। যাদের সবজি আগাম ফলেছে তারা কিছুটা ফলন পেয়েছে। প্রকৃতির সেচনির্ভর আমন আবাদ পরে করবে বলে যারা মাঝের সময়টুকু কেউ আউশ কেউ সবজি ফলিয়েছিল তাদের কোনটিই ঠিকমতো হয়নি। একেবারে যে মার গেছে তাও নয়। তবে যতটা আশা করেছিলেন ততটা হয়নি।
এদিকে আমনের আবাদটিও অনেকটা বেকায়দার মধ্যে পড়েছিল। সময়মতো বৃষ্টি না হওয়া অন্যতম কারন। তার পরও সেচের মাধ্যমে যেটুকু আবাদ হয়েছে তা ভালই হবে বলে মনে করছেন কৃষক। এর মধ্যে আমন চারা রোপণের অপটিমাম টাইম ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে যারা চারা রোপণ করেছিলেন তাদের ভাবনাটা বেশি। কারণ এই সময়ে লেট ভ্যারাইটির আমনে দানাদার ধানের চেয়ে খড় বেশি হয়। তবে কৃষি বিভাগ এই কথা মানতে নারাজ। তাদের কথা বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ভর বছর ধান চাষের নানা ধরনের জাত উদ্ভাবন করেছে। ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কোন একটি নির্দিষ্ট ভ্যারাইটির আমন ধানের চারা রোপণ করলে ফলন ভালই মিলবে। এই বিষয়ে কৃষক কিছুটা বিপাকে আছে!
বগুড়ার সোনাতলার কৃষক বাসেত আলী জানালেন কোন ধানের চারায় লেট ভ্যারাইটর আমন ভাল ফলে তা তারা জানেন না। আবাদের সময় নির্দিষ্ট চারাতেই তারা যেটুকু ফলন পান তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন। তবে এবারের আবহাওয়া নিয়ে তাদের ভাবনা একই। এই সময়ে আশি^ন মাসের আবহাওয়া ফসলের অনুকূলে আছে কি না তা বুঝতে পারবেন কার্তিক অগ্রহায়ণে। ওই সময়ে আমন ঘরে উঠে নবান্নের উৎসব হবে। এই নবান্নে বোঝা যাবে আমন কতটা ভাল হয়েছে। উল্লেখ্য, বাঙালীর আমন আবাদটিই নবান্নের অনুষজ্ঞ। এবার আমন আবাদটি সরাসরি প্রকৃতির ঋতু জটে পড়েছে।
এই সময়টায় গ্রামের পথে নদীর তীরে দেখা যায় বাতাস জলীয়বাষ্প দ্বারা সম্পৃক্ত হয়ে ধানগাছের মধ্যে শিশির বিন্দু বা হিমজল জরো করে দিয়েছে। বিকেলের মধ্যেই চারদিকে সবুজ বেষ্টনী। আকাশের মেঘ নিচে নেমে এসে মাটির ওপরে ভেসে বেড়াচ্ছে। যা আসলে কুয়াশা। এ রকম দৃশ্য চোখে পড়ে সাধারণত কার্তিকের মধ্যভাগে ও অগ্রহায়ণে। এবার আশ্বিনেই তা দৃষ্টিতে আসছে। রাতের কুয়াশা আরও ঘন হয়ে শিশির বিন্দুকে ভরাট করে দিচ্ছে। এটা যে কি ধরনের প্রকৃতি তা ভেবে পাচ্ছেন না গ্রামের মানুষ।
ঋতুর জটে ফসলের সময়গুলো বিপাকে ফেলে দিয়েছে। নিকট অতীতে কৃষক ঋতুবৈচিত্র্য দেখে ফসল আবাদ করতেন। বর্তমানে ঋতুর জটে তা ঠাহর করতে পারেন না। যে কারণে ঋতুর আবাদগুলো প্রকৃতির ওপর ছেড়ে দিয়েছেন তারা। তার পরও বাঙালীর ঋতু বলে কথা। কৃষক তারিখ মেনে ফসলের চাষ মেলায় না। প্রকৃতি দেখে আবাদ করে।
এদিকে শহরের অবস্থা আরও কিছুটা গোলমেলে। কখনও দিনের গরমে গা ঘামছে। মধ্য রাতে কাঁথা চরাতে হচ্ছে। ভোরের দিকে শরীরে গরম ও শীতলের জট পেকে সর্দিজ্বর লেগেই থাকছে। লোকজন এখন করবে টা কি! ওই এক কথা জলবায়ুর পরিবর্তন। এই পরিবর্তনে মানুষের জীবন চলার গতির পরিবর্তন!

×