ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এখন শুধুই শিল্পকর্ম

গাজী পীর দেবী দুর্গার বন্দনা হতো ধর্মীয় পটে

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ৪ অক্টোবর ২০২২

গাজী পীর দেবী দুর্গার বন্দনা হতো ধর্মীয় পটে

নড়াইলের পটশিল্পী নিখিল চন্দ্র দাসের পটচিত্রে দেবী দুর্গা

বর্তমান চিত্রকলা প্রতিনিয়তই নতুন ভাষা পাচ্ছে। পৃথিবীজুড়ে চলছে নিরীক্ষা। শিল্পীরা মডার্ন আর্ট নিয়ে বেশি কাজ করছেন। তবে ফোক আর্টের আছে আলাদা আবেদন। বিশেষ করে পটচিত্রে বাঙালী তার অতীত জীবন ও লোক সংস্কৃতির ধারণা নিতে পারে। তবে এই ধারার চিত্রকলার প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য গড়ে দিয়েছিল ধর্মীয় পট। আদিতে গাজী পীর বা দেবী দুর্গার ছবি এঁকে তাদের বন্দনা করা হতো। এখন পটচিত্রের চর্চা অনেক কমে গেছে। একই কারণে কম আঁকা হয় ধর্মীয় পট। এসব পটে ধর্মীয় বিষয়াদি থাকলেও, সংগ্রাহকরা মূলত ফোক আর্ট হিসেবে সংগ্রহ করেন।
পটচিত্র মানে, পটে আঁকা চিত্র বা ছবি। পট শব্দের অর্থ কাপড়। কাপড়ের ওপর দেশী রং দিয়ে এ ছবি আঁকা হয়। পট সাধারণত দু-ধরনের হয়। একটি চৌকাপট। অন্যটি বহুপট বা দীর্ঘপট। যখন কোন রীতিসিদ্ধ শিল্পকলার অস্তিত্ব ছিল না তখন এ পটচিত্র প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যকে সযতেœ ধারণ করেছিল। বারো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত চর্চাটি বিশেষ জোরালো হয় বলে জানা যায়। যারা পট আঁকেন তাদের বলা হয় পটুয়া। স্বশিক্ষিত শিল্পীরা বংশানুক্রমিকভাবে পটচিত্র আঁকার কাজ করতেন। চিত্র দেখিয়ে গান করতেন। গানে গানে কিচ্ছা-কাহিনী বর্ণনা করতেন তারা। এখন গান করতে তেমন দেখা না গেলেও, কমবেশি পট আঁকা হয়। নতুন প্রজন্মের শিল্পীরাও আঁকছেন।  
পটের বিষয়বস্তু বিচিত্র। বিষয়ভেদে পটকে ছয় ভাগে ভাগ করা যায়। এই যেমন সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, পরিবেশগত, বিষয় নিরপেক্ষ এবং ধর্মীয় পট। যতদূর জানা যায়, চর্চার শুরুটা হয়েছিল ধর্মীয় পট দিয়ে। ধর্মীয় বিশ্বাসকে টেকসই করে এমন গল্প ও পৌরাণিক কল্প-কাহিনী আলাদা গুরুত্ব পেত তখন। গাজীর পটের কথা তো সবার জানা। খুবই বিখ্যাত। মুসলমানদের গাজীর পটে গাজীকালু-চম্পাবতীর কাহিনী, গাজী পীরের বীরত্বগাথা অলৌকিক কর্মকা- তুলে ধরা হতো।

আর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য ছিল রামকাহিনী, কৃষ্ণকাহিনী। মহাভারত ও রামায়ণ উপাখ্যান থেকে চরিত্র খুঁজে নিয়ে উজ্জ্বল রঙে আঁকা হতো। পটে আঁকা হতো দুর্গাপট ও লক্ষ্মীপট। মাটির প্রতিমা গড়ে পূজা করার সাধ্য ছিল অল্প লোকের। তারা পটের আশ্রয়ে দেব-দেবীর পূজা করতেন। রঙিন দুর্গোৎসব সম্ভব না হলেও, শতভাগ ভক্তি নিয়েই দুর্গাপটে পূজা দিতেন ভক্তরা। আঁকা ছবি সামনে রেখে দেবী লক্ষ্মীর পূজা অর্চনা করা হতো।

বর্তমানে পূজার জন্য না হলেও কেউ কেউ ধর্মীয় পট আঁকেন। ঐহিত্য মেনেই আঁকা।
এ প্রসঙ্গে মুন্সীগঞ্জের শিল্পী শম্ভু আচার্যের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে ধর্মীয় পট এঁকেছেন তিনি। কিছু আগে আঁকা ছিল। সব মিলিয়ে সংগ্রহটা মন্দ নয়। তার ধর্মীয় পট হাতে নিয়ে দেখা গেল এসবে পৌরাণিক কাহিনী। রামায়ণের বিভিন্ন চরিত্র পটে এঁকেছেন তিনি। পটের কেন্দ্রে তিনি দৃশ্যমান করেছেন রাবণবধের আলোচিত মুহূর্তটি। এর চারপাশে আলাদা আলাদা ফ্রেমে আরও বেশ কিছু ছবি।

খণ্ডচিত্রে ঘটনাবলী ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরার শিল্পীত প্রয়াস। অপর পটচিত্রে মহাভারতের উপাখ্যান। এখানে কুরুক্ষেত্রের অর্জুনকে তুলে ধরা হয়েছে। পঞ্চপা-বের অন্যতম অর্জুন তার রথে চড়ে ছুটে চলেছেন। সঙ্গী হয়েছেন কৃষ্ণ। শম্ভুর পটের মূল রংটি লাল। এর পর চোখে পড়ে সবুজ আর নীল রঙের ব্যবহার। প্রাকৃতিক রং আর ফর্মের ভিন্নতার কারণে ছবি দুটি আলাদা আবেদন সৃষ্টি করে।
কথা প্রসঙ্গে শম্ভু আচার্য বলছিলেন, এক সময় রামায়ণপট, মহাভারতপট খুব জনপ্রিয় ছিল। দুর্গাপূজার সময় রামায়ণ গান করা হতো। ম-পের মঞ্চের দৃশ্যমান কোন স্থানে পট ঝুলিয়ে রেখে রামায়ণ গান গাওয়া হতো। এ পট দেখিয়ে বর্ণনা করা হতো রাবণবধের কাহিনী। পটে আঁকা দেব-দেবীর মধ্যে থাকতেন মনসাও। প্রধানত বাংলা অঞ্চল এবং উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে তার পূজা প্রচলিত আছে। সর্পদংশনের হাত থেকে রক্ষা পেতে, সর্পদংশনের প্রতিকার পেতে, প্রজনন ও ঐশ্বর্যলাভের উদ্দেশে তার পূজা করা হয়।

দেবী মনসার পট দেখিয়ে বেহুলা লক্ষিন্দরের সেই চিরচেনা কাহিনী তুলে ধরা হয়। শম্ভু এঁকেছেন সে ছবিও। শীতলা দেবীর কথাও অনেকের জানা। পটে শীতলা দেবীর চিত্র প্রচুর পরিমাণে অঙ্কন করা হতো। কারণও আছে। অতীতে মহামারী থেকে বাঁচার স্বীকৃত কোন পথ জানা ছিল না এ অঞ্চলের মানুষের। রোগব্যাধির কাছে সবাই ছিল অসহায়। সুস্থতার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতেন তারা। একই প্রার্থনা হতো পটের ভাষায়। পটুয়ারা বিশেষ করে শীতলা দেবীর ছবি এঁকে তা নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখাতেন।
এ সম্পর্কে জানতে ফোনে কথা হয় নড়াইলের পটশিল্পী নিখিল চন্দ্র দাসের সঙ্গে। তিনিও পূজা উপলক্ষে দেবী দুর্গার পট এঁকেছেন।
এ প্রসঙ্গে শিল্পী বলেন, ধর্মীয় পটেরও একটা ঐতিহ্য আছে। সে ঐতিহ্য বিবেচনায় এখনও মাঝে মাঝে আঁকি। শুধু দেবী দুর্গা নয়, বাসন্তী দেবীর ছবি আঁকার ঐতিহ্য ছিল বলে জানান তিনি। বলেন, বসন্ত দেখা দিলে শীতলা দেবীর ছবি এঁকে একটি বাক্সের ওপর বসিয়ে সে বাক্স গলায় ঝোলানো হতো। পরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেবীর পট দেখানো হতো।

এভাবে চাল ইত্যাদি সংগ্রহ করা হতো। পরে ছবির সামনে পূজার আয়োজন করে রোগমুক্তির প্রার্থনা করা হতো। এভাবে যুগে যুগে কালে কালে বহু দেব-দেবীর ছবি আঁকা হয়েছে পটে। গাজী বাবার পট আঁকা হয়েছে। তবে এখন গাজী বাবার পট হাতেগোনা কয়েকজন আঁকেন। দুর্গাপট লক্ষ্মী পটও কম হয়। যেগুলো আঁকা হয় সেগুলো মূলত শিল্পকর্ম হিসেবেই বিবেচনা করা হয় বলে জানান তিনি।

×