ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ফোটানো গেছে মরুর দেশেও

ডিএনএর জিন বদল, ফুল ফুটছে সারা বছর...

সমুদ্র হক

প্রকাশিত: ২৩:২৫, ৩ অক্টোবর ২০২২

ডিএনএর জিন বদল, ফুল ফুটছে সারা বছর...

বগুড়ার গ্রামে ফুলের চাষ

ভর বছর ফুল ফুটবে, বলছেন বিজ্ঞানীরা। ফুল ফুটছেও। ফুল ফোটানো গেছে মরুর দেশেও। ফুল ফুটছে বগুড়ার মহাস্থানগড়ে গাবতলী শিবগঞ্জ সোনাতলার কয়েকটি গ্রামে। বছর কয়েক আগে রাজশাহী ও বগুড়ায় এ্যাডেনিয়াম নামের যে ফুল ফুটেছে তা পরিচিতি পেয়েছে মরু গোলাপ নামে। প্রাচীন কালের সাক্ষ্য : দ্বিগি¦জয়ী বীর নেপোলিয়ান রাজ্য জয় করে যেখানে ফুল ফুটত না সেখানও ফুল ফুটিয়েছেন। বলেছেন, যে ভূমিতে ফুল ফোটে না সেখানে মানুষ বাস করতে পারে না। ফাল্গুনে ঋতুর রানী ফুল তো ফোটাবেই! বাকি সময়ও ফুল ফুটবে। দেশের বিভিন্ন গ্রামে কৃষক ফুলের চাষ করছেন।
উদ্ভিদ ডিএনএর বিশেষ ধরনের প্রোটিন ফুল ফোটায়। নার্সারির মালিকরা দেশে অনেক ধরনের ফুল ফুটিয়েছেন। যেমন গ্লাডিওলাস। এই ফুলের গন্ধ নেই। ফুলের তোড়া (বুকে) বানাতে গ্লাডিওলাসের সৌন্দর্যের মোড়কে গোলাপ রজনীগন্ধা গাঁদা ও অন্যান্য ফুল ভরে দেয়া হয়। বিশেষ দিন, অভিষেক ফেয়ারওয়েল, সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে ফুলের কদর আছে। প্রণয়ে ফুলের ভালবাসা আদিকালের। মিসরে অনেক মমির পাশে ঝরা ফুল পাওয়া যায় আজও।

দেশের প্রতিটি এলাকায় ভর বছর কোন না কোন অনুষ্ঠানে ফুলের কদর লেগেই আছে। ফুলের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে গেছে। কৃষক এখন ফুলকে বেছে নিয়েছে কৃষি উপকরণে রোজগারের বড় অংশ হিসাবে। বগুড়া অঞ্চলে ফুলের অর্ধেক চাহিদা মেটায় বিভিন্ন গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে ফুলচাষে। বাকি ফুল আসে যশোরের গ্রাম থেকে। বগুড়া শহরের ফুলের কয়েক দোকানি জানান প্রতিদিন গড়ে ৫০ হাজার বিভিন্ন জাতের ফুল বিক্রি হয়। ফুলের চাহিদা নিত্যদিনই বাড়ছে।    
দেশে ভর বছর কোন না ফুল ফুটছে তার বড় প্রমাণ বনফুল। গ্রামের পথে প্রান্তরে ঝাউবনে নদী তীরে অনাদরে কত ফুল ফুটে ঝরে যায় তার খবর রাখে ক’জনা! নদী তীরের কোন ছোট বনের ধার দিয়ে হাঁটলে দূর থেকে ভেসে আসে কেয়া কামিনী ফুলের সুবাস। এই ফুলগুলো আমরা সহজে দেখি না। জবা ফুলের অনেক জাত। শুধু লাল জবা চিনি। মহুয়া ফুল এখন শুধু কাব্যে। মহুয়া বৃক্ষে পড়েছে কুঠারের কোপ। কাঁঠালচাঁপা ফুল কোথায় ফুটছে জানা যায় না। এমনই বহু ফুল এই দেশেই ফুটছে ভর বছর। নার্সারি মালিকরা হাতেগোনা কয়েকটি ফুল নিয়েই পড়ে আছেন। ফুলের গবেষণা করছেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা কয়েকটি দেশের সঙ্গে গবেষণা করে ফুল ফোটার নতুন তথ্য ও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেমন পাখিরা শীত প্রধান এলাকা থেকে উড়ে কম শীতের এলাকায় যায় পরিযায়ী হয়ে। উদ্ভিদ অন্য স্থানে যেতে পারে না। এরা পরিবেশগত চাপ সামলে ঋতু অনুযায়ী শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া প্রকৃতি থেকেই সম্পন্ন করে। ডিএনএ এই পরিবর্তনের এপিজেনেটিকস কাজ করে। উদ্ভিদের জেনেটিকস বিষয়গুলো ফুল ফুটতে বেশি গুরুত্ব বহন করে। জেনেটিকস গুণাবলির পরিবর্তনে একই ফুলের ভিন্ন রং হয়। যেমন গোলাপের কয়েকটি রং মেলে- লাল, গোলাপি, সাদা, হলদেটে এবং কালো। এইসব গোলাপ ফোটে বছরের বিভিন্ন সময়ে।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, উদ্ভিদই জিন পরিবর্তনের কৌশল তৈরি করেছে। যা ওই ফুল ফোটানোর সময় নিয়ন্ত্রন করে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানী জসীম উদ্দিন লিখেছেন, গাছের কোষে উৎপন্ন জৈব রাসায়নিক পদার্থ নিজে পরিবর্তিত না হয়ে অন্য পদার্থের পরিবর্তন ঘটিয়ে ক্যাটলিস্ট (অনুঘটক) হয়ে ফুল ফোটায়। এই এনজাইম প্রক্রিয়া সক্রিয় হয় বিশেষ তাপমাত্রায়। ফলে ভর বছর ফুল ফোটনো যায়। উদ্ভিদের এমন এনজাইম প্রক্রিয়া বেশি সক্রিয় থাকে বসন্তকালেই। যে কারণে বসন্তবেলায় বেশি ফুট ফোটে বিশে^র সকল দেশে। তারপর ভর বছর ফুল ফোটনো যায় বিকল্প প্রক্রিয়ায়।
যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিজ্ঞানীরা পথের ধারে অনাদরে জন্মানো ইউরোশিয়ার সাদা রঙের আগাছা ধরনের এরাবিডোপসিস থালিয়ানো নামের একটি ফুল নিয়ে গবেষণা করেন। এই ফুলের চারটি বৃত্তাংশ চারটি পাপড়ি ও ছয়টি পুংকেশর। দেখলেন এপিজেনেটিক বিষয় ফুল ফোটার সময় নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে। এই পরিবর্তন হয় ডিএনএ এবং সংযুক্ত প্রোটিনের কেমিক্যাল মডিফিকেশনে। ডিএনএর পরম্পরা পরিবর্তন হয় না, জিনের অভিব্যক্তি প্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করে।
মরুভূমিতে ফোটা মরু গোলাপ গাছ বেশ শক্ত। মাটি ছাড়াও পাথরকুচি মধ্যে বেঁচে থাকতে পারে। খুব বেশি পানির দরকার হয় না। মরুভূমির মতো আবহাওয়ার টিকে থাকতে পারে। বছর কয়েক আগে রাজশাহীর উপশহরে কৃষিবিদ শাহীন সালাহউদ্দিনের ছাদ বাগানে এই ফুল ফুটেছিল। তিনি এ্যাডেনিয়ামের একটি চারা কিনে শখ করে টবে লাগান। তিন চার মাস পর কলকের মতো লাল গোলাপি ফুল ফোটে। এই ফুলের বীজ ও চারা বগুড়ার কয়েকটি নার্সারিতে বিক্রি করেছেন। তার সংগ্রহে অনেক জাতের গোলাপ আছে।

মরুগোলাপের বোটানিক্যাল নাম এ্যাডিনিয়াম ওবেসাম। গাছটি ক্যকটাস নয়। এক ধরনের সাকুলেন্ট বা রালো প্রকৃতির গাছ। ভর বছর লাল, গোলাপি, ঘিয়ে, সাদা, হলদে, নীলাভসহ অনেক রঙের ফুল ফোটে। ফুলের আকর্ষণে অনেকেই এখন ছাদে টবে ফুলের চারা রোপণ করেন। বৃক্ষ ও ফুলের প্রতি মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হয় নানা জাতের বাহারি ফুল। নাম না জানা অনেক ফুল আমাদের দেশের বনে ঝাউবনে অনাদরে ফুটছে। বনফুলের পরিচিতিতে প্রকৃত ফুল ঢাকা পড়ে থাকছে। কেউ কি বলতে পারেন আমাদের দেশে বনফুলের পরিচিতিতে কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতার ‘ড্যাফোডিল’ ফুল লুকিয়ে নেই!

×