ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

লাল সাদা ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে বিস্তীর্ণ জলাশয়

বাফলা বিলে সাদা শাপলা চাকিরপাশায় ফুটেছে গোলাপি পদ্ম

তাহমিন হক ববী ও রাজু মোস্তাফিজ

প্রকাশিত: ০১:২৭, ৩ অক্টোবর ২০২২

বাফলা বিলে সাদা শাপলা চাকিরপাশায় ফুটেছে গোলাপি পদ্ম

বারো বছর পর নীলফামারীর বাফলার বিলে ফুটেছে সাদা শাপলা। কুড়িগ্রামে চাকিরপাশা পদ্ম বিলে বাহারি পদ্ম ফুল

বিশাল বিল বাফলা। পানি কমলেই ফসল আবাদে মেতে উঠত কৃষক। মানুষের নানামুখী কর্মকান্ড ও কৃষিতে অতিমাত্রায় আগাছানাশক প্রয়োগের কারণে দীর্ঘ বারো বছর ধরে সাদা বা গোলাপি শাপলা জন্মানোর সুযোগ পাচ্ছিল না। চলতি বছরের শুরুতেই বাফলা বিলটি মৎস্য বিভাগের পক্ষে খনন করা হয়। খননের পর এবার বর্ষা মৌসুমে দেখা মিলেছে সারি সারি সাদা ও গোলাপি শাপলার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। মজার বিষয়, বিলের একপ্রান্তে সাদা শাপলা সালুক ফুল বাফলার বিলকে যেন রঙের তুলিতে আঁকা ক্যানভাসে পরিণত করেছে।
 শাপলার সাদা রং আত্মাকে পরিশুদ্ধ আর পাপড়িগুলোর মতো দেশের মানুষকে একত্রিত করে বলেই সাদা শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় ফুল ও জনগণের প্রতীক। যার ইংরেজী নাম ওয়াটারলিলি।
এবার দীর্ঘদিন পর নীলফামারীর বাফলার বিলে দেখা মিলেছে সেই সাদা শাপলা শালুক ফুল। এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উদাসী করে তুলেছে সব বয়সী মানুষকে। সাদা শাপলার রূপ দেখতে সেখানে সকাল-বিকেল ছুটছে প্রকৃতিপ্রেমীরা। সারি সারি সাদা শাপলার সৌন্দর্য মুগ্ধ করছে। বর্ষাকালে পানিতে ভরে থাকা বিল এখন সাদা শাপলার সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিচ্ছে বাফলার বিলকে।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সৃষ্টিতে ফুলের অবদান রয়েছে। অন্যান্য ফুলের মতো সাদা শাপলা শালুক সেই সৌন্দর্যের অংশীদার। শাপলা ফুলের সৌন্দর্য বাংলাদেশের সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিল এক সময়। কিন্তু জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে সাদা শাপলা শালুক ফুলের সেই সমারোহ দিন দিন কমে আসে।
নীলফামারী জেলা সদর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে কিশোরীগঞ্জ উপজেলা রণচ-ি ইউনিয়নে এই বাফলার বিল। বিলটির নামেই এখানে গড়ে উঠেছে একটি গ্রাম। প্রায় ৩৫০ বিঘা খাস জমিভুক্ত এ বিল। গ্রামের অনেক কৃষক সরকারীভাবে চাষের জন্য ইজারাও নিয়েছেন। এবার বর্ষাকালে ফুটেছে সাদা শাপলা শালুক। শুধু সৌন্দর্যের বেলাভূমি নয়, বিলের তলদেশে বছরজুড়ে থাকে পানি। শুষ্ক মৌসুমে বিলের পানি কিছুটা শুকিয়ে গেলে সেখানে বোরো ধান আবাদসহ নানা রবিশস্যের চাষাবাদ করেন স্থানীয় কৃষক। বাকি সময় টইটম্বুর পানিতে বিলে থাকে হরেক প্রজাতির দেশীয় মাছের প্রাচুর্য।
শনিবার সরেজমিনে গেলে এলাকাবাসী জানায়, বিলটি খননে দীর্ঘ ১২ বছর পর শাপলা শালুক ফুল এবার ফুটেছে। ওই সময় বাফলার বিলের বুকজুড়ে সাদা শাপলা শালুক ফুলের দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য ছিল চোখে পড়ার মতো। শরৎকালে বিলের বুকজুড়ে প্রকৃতি অন্যরকম সাজে সেজে উঠত। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখা যেত চারদিকে ফুটন্ত সাদা শাপলার সমারোহ। মনে হতোÑ এ যেন শাপলা ফুলের জগৎ। শাপলা ফুল শুধু পরিবেশ ও প্রকৃতির সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে, তা নয়Ñ এর রয়েছে অনেক পুষ্টিগুণ।
 এছাড়া এ ফুলের গাছ, শিকড় ও মাথা কিছুই ফেলে দেয়ার মতো নয়। শাপলার নরম ডাঁটা, মাথা ও গোড়ায় জন্ম নেয়া ঢ্যাপ এবং শালুক সবই মুখরোচক, পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য উপাদান। রান্নায় উৎকৃষ্ট তরকারি হিসেবে এর ডাঁটা বেশ জনপ্রিয়। শালুক আগুনে পুড়িয়ে কিংবা সেদ্ধ করে খাওয়া হয়। আগের দিনে শরতের শেষে বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিলজুড়ে শালুক তোলার ধুম পড়ে যেত। শালুক পোড়া গন্ধ এখনও প্রবীণদের শৈশবের কথা মনে করিয়ে দেয়। শাপলা, পদ্ম সাধারণত দীঘি বা বিলে ফুটে থাকে। তখন গ্রামের ছেলেমেয়েরা সাঁতার কেটে এই ফুল তুলে আনত। এখন আর আগের মতো এই ফুল চোখে পড়ে না। কারণ হিসেবে দেখা গেছে- আগের সব পুকুর, নদী, খাল ভরাট করে মানুষের নানামুখী কর্মকান্ড ও কৃষিতে অতিমাত্রায় আগাছানাশক প্রয়োগের কারণে শাপলার জন্মস্থলগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। কথা বলছিলাম রৌমারী বাফলা গ্রামের ৭৫ বছর বয়সের সাহাদাৎ হোসেনের সঙ্গে। এর সঙ্গে তিনি বলেন, এক সময় এই সকল এলাকাং মঙ্গা বা আমরা যখন অভাব-অনটনে পরতাম তখন ঢ্যাপের (শাপলার) ফল ভেতরের যে বীচিগুলো থাকত সেগুলো ভাতের মতো রান্না করে খেতাম; খুবই ভাল লাগত। শুধু তাই নয়, শাপলার ফল (ঢ্যাপ) দিয়ে চমৎকার সুস্বাদু খৈ তৈরি করেও খেতাম। তিনি আরও জানালেন, শাপলা ফুলের মাটির নিচের মূল অংশকে শালুক বলা হয়। বর্তমানে দেশে বাড়তি জনগণের চাপের কারণে আবাদি জমি ভরাট করে বাড়ি, পুকুর, মাছের ঘের বানানোর ফলে বিলের পরিমাণ কমে গেছে। যার ফলে শাপলা জন্মানোর জায়গাও কমে আসছে। এখন দিন বদলিয়েছে। মানুষজনের আয়-রোজগার বৃদ্ধি পেয়েছে। অভাব-অনটন নেই। তাই, কেউ এখন শাপলা শালুকের ঢ্যাপ সংগ্রহ করে খায় না। তবে পুষ্টিগুণের জন্য আমরা এখনও সংগ্রহ করে তরকারি রান্না করে খাই বলে এই বৃদ্ধ যোগ করলেন। তিনি বললেন, চাঁদনি রাতে আমাদের বাফলার বিলে যখন একসঙ্গে অনেক ফুল ফুটে থাকত, তখন সেখানে এক অপরূপ সৌন্দর্যের সৃষ্টি হতো, যা ছিল দেখার মতো একটি অপূর্ব দৃশ্য। এবার বিলটি খনন করায় ১২ বছর পর এই বিলে পুনরায় শাপলা শালুক ফুটেছে। আমাদের মন- প্রাণ ভরিয়ে দিয়েছে।
কুড়িগ্রাম ॥ সবুজ-শ্যামল আর চারদিকে সারি সারি নানা গাছÑ অপরূপ সৌন্দর্যম-িত চাকিরপাশা পদ্ম বিল। লেকের পদ্মফুলের স্নিগ্ধ ঘ্রাণ মানুষকে বিমোহিত করবে। চারদিকে গাছগাছালি,পাখি আর আবহাওয়া যে কোন মানুষকে আকৃষ্ট করে। আশপাশের গ্রামের মানুষ সহজ-সরল। তাদের পুরাতন ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সেই সঙ্গে আধুনিক সমাজের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে চলার অনুপম চেষ্টা সকলের নজর কাড়ে। বিলের যেদিকে তাকাই শুধু গোলাপি আর সাদা পদ্মফুলের সমাহার। এই পদ্মফুলের শ্যামল নীলিমায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের হাজারও অপরূপ দ্যুতি। যা উপমার অতীত।
কুড়িগ্রামের চাকিরপাশা বিলে গোলাপি আর সাদা পদ্মফুলের চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখে যে কারোই মন ভাল হয়ে যাবে। অনেকেই লাল শাপলা আর পদ্মফুলের মধ্যে মিল থাকার কারণে চিনতে ভুল করেন। কিন্তু এর বীজপত্র ভালভাবে দেখলেই পার্থক্য বোঝা যায়। পদ্মফুল সাধারণত শরৎকালে ফোটে। তবে বর্ষাকালেও পদ্মের দেখা পাওয়া যায়। কুড়িগ্রামের দুটি উপজেলায় এই পদ্মফুলের সমারোহ দেখা যায়। একটি রাজারহাট উপজেলার চাকিরপাশা ইউনিয়নের প্রায় ১শ’ ৩৯ একরের বিলের মধ্যে ৪০ একর জমিতে পদ্মবিল। চাকিরপাশা বিলটি পদ্মবিল নামেই পরিচিত। অপরদিকে রৌমারী উপজেলার সদর ইউনিয়নের নীলেরকুঠি গ্রামের পাটাধোয়া বিলে প্রায় ১৫ একর জমিতে লাল পদ্ম ফুলের দেখা মেলে। দু’চোখ যত দূরে যায়, শুধু পদ্ম আর পদ্ম। আর এ কারণে বিল দুটি পদ্মবিল নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছে জেলার মানুষের কাছে। প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া এই পদ্মফুল বাড়তি সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে এই দু’ জনপদে। প্রচুর পাখি আসে এই পদ্মবিল দুটিতে। প্রতিবছর সারাদেশ থেকে পদ্মবিলে সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন দর্শনার্থীরা। গোলাপি ও সাদা রঙের পদ্ম দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। এমন অপরূপ দৃশ্য যেন ভ্রমণ পিপাসুদের হাতছানি দেয়। এ বিলের সৌন্দর্য ও পদ্ম দেখতে নৌকায় ঘুরে সৌন্দর্য উপভোগ করেন ভ্রমণ পিপাসুরা। আর বর্ষাকালে কোন কাজ না থাকায় পদ্মফুল তুলে বাড়তি আয় করেন অনেকেই। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা উৎসবে এই ফুলের বেশি চাহিদা পড়ে। পূজারিরা পদ্মফুল সংগ্রহ করে এ দুটি এলাকা থেকে। তবে পদ্মফুলের চাহিদা থাকলেও নেই বাণিজ্যিক চাষাবাদ। স্থানীয়রা বিল থেকে পদ্ম ফুল তুলে ১০০ টাকা হতে ১০০০ টাকা পর্যন্ত আয় করে। তবে অনাদর-অযত্নে ফুটে থাকা এসব পদ্মফুল হতে পারে কৃষকদের বাড়তি আয়ের উৎস। রাজারহাট ও রৌমারীর পদ্মবিলের আশপাশের মানুষ জানায়, সরকারীভাবে এখানে যদি পর্যটন এলাকা ঘোষণা করত এবং পদ্ম ফুলের মধুর চাষ করার ব্যবস্থা করত তাহলে অনেক মানুষের মধু বিক্রি করে কর্মসংস্থান হতো।

 

 

×