
টিএসসিতে জমিয়ে আড্ডা বন্ধুদের
তুমি আমার পাশে বন্ধু হে/বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো...। আহা, কী আকুতি! শুধু এ গানে নয়, প্রাণেও এভাবে বেঁচে থাকে বন্ধু। এক জীবনে কত কিছুই না চায় মানুষ! অর্থ বিত্ত বাড়ি গাড়ি- প্রকাশ্যে ও গোপনে আরও কত চাওয়া। চাওয়ার পেছনে রাত দিন ছোটাছুটি। তবে যে চাওয়াটি খুব নীরবে বুকের ভেতর ঘুমিয়ে থাকে সেটি ‘বন্ধু।’ খুব সচেতনভাবে কিংবা নিজের অজান্তেই একটা ভাল বন্ধু প্রত্যাশা করে মানুষ। প্রাচীন সে চাওয়া, পাওয়ার আনন্দ কিংবা না পাওয়ার বেদনা আজ নতুন করে জেগে ওঠবে। কারণ আজ বন্ধুতা উদ্যাপনের দিন। বিশ্ব বন্ধু দিবস।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দিন তারিখ অনুযায়ী দিবসটি উদ্যাপিত হয়। বাংলাদেশসহ অনেক দেশ আগস্টের প্রথম রবিবারকে বেছে নিয়েছে বন্ধু দিবস হিসেবে। এই বিবেচনায় আজ রবিবার বন্ধুতার বিশেষ দিন, বন্ধু দিবস। নানা আয়োজনে দিবসটি উদ্যাপিত হবে।
কে আসলে বন্ধু? বন্ধুতা কাকে বলে? না এর নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা নেই। হয় না। তবে রবীন্দ্রনাথের একটি লেখা বন্ধু চিনতে নিশ্চিত সহায়তা করবে। বন্ধুত্ব ও ভালবাসার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পার্থক্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি লিখছেন, ‘বন্ধুত্ব বলিতে তিনটি পদার্থ বুঝায়। দুই জন ব্যক্তি ও একটি জগৎ। অর্থাৎ দুই জনে সহযোগী হইয়া জগতের কাজ সম্পন্ন করা। আর, প্রেম বলিলে দুই জন ব্যক্তি মাত্র বুঝায়, আর জগৎ নাই। দুই জনেই দুই জনের জগৎ।’
কবিগুরুর মতে, ‘বন্ধুত্ব নাড়াচাড়া টানাছেঁড়া তোলাপাড়া সয়, কিন্তু ভালবাসা তাহা সয় না। আমাদের ভালবাসার পাত্র হীন প্রমোদে লিপ্ত হইলে আমাদের প্রাণে বাজে, কিন্তু বন্ধুর সম্বন্ধে তাহা খাটে না; এমনকি, আমরা যখন বিলাসপ্রমোদে মত্ত হইয়াছি তখন আমরা চাই যে, আমাদের বন্ধুও তাহাতে যোগ দিক! প্রেমের পাত্র আমাদের সৌন্দর্যের আদর্শ হইয়া থাক এই আমাদের ইচ্ছা- আর, বন্ধু আমাদেরই মতো দোষে গুণে জড়িত মর্ত্ত্যরে মানুষ হইয়া থাক এই আমাদের আবশ্যক। আমাদের ডান হাতে বাম হাতে বন্ধুত্ব। আমরা বন্ধুর নিকট হইতে মমতা চাই, সমবেদনা চাই, সাহায্য চাই ও সেই জন্যই বন্ধুকে চাই।’
একই প্রসঙ্গে কবিগুরু লিখেছেন, ‘অনেকে বলিয়া থাকেন বন্ধুত্ব ক্রমশ পরিবর্তিত হইয়া ভালবাসায় উপনীত হইতে পারে, কিন্তু ভালবাসা নামিয়া অবশেষে বন্ধুত্বে আসিয়া ঠেকিতে পারে না। একবার যাহাকে ভালবাসিয়াছি, হয় তাহাকে ভালবাসিব নয় ভালবাসিব না; কিন্তু একবার যাহার সঙ্গে বন্ধুত্ব হইয়াছে, ক্রমে তাহার সঙ্গে ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপিত হইতে আটক নাই। অর্থাৎ বন্ধুত্বের উঠিবার নামিবার স্থান আছে।
কারণ সে সমস্ত স্থান আটক করিয়া থাকে না। কিন্তু ভালবাসার উন্নতি অবনতির স্থান নাই। যখন সে থাকে তখন সে সমস্ত স্থান জুড়িয়া থাকে, নয় সে থাকে না।’ এর চেয়ে চমৎকার ব্যাখ্যা আর কী হতে পারে? একই বিষয়ে জানতে আমরা আশ্রয় করতে পারি নজরুলকেও। দ্রোহ ও প্রেমের কবি বন্ধুর প্রয়োজন ভীষণভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা কবির বিখ্যাত চিঠি তার প্রমাণ।
সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘বন্ধু, তুমি আমার চোখের জলের মতিহার, বাদল রাতের বুকের বন্ধু। যেদিন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর আর সবাই আমায় ভুলে যাবে, সেদিন অন্তত তোমার বুক বেঁধে উঠবে। তোমার ঐ ছোট্ট ঘরটিতে শুয়ে, যে ঘরে তুমি আমায় প্রিয়ার মতো জড়িয়ে শুয়েছিলে, অন্তত এইটুকু সান্ত¦না নিয়ে যেতে পারব, এই কি কম সৌভাগ্য আমার।’
অর্থাৎ বন্ধু সে, যাকে প্রিয়ার মতোই জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকা যায়। তবে চিঠির পরের অংশ আরও গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখ করে লিখেছেন, ‘বন্ধু আমি পেয়েছি যার সাক্ষাত আমি নিজেই করতে পারব না। এরা সবাই আমার হাসির বন্ধু, গানের বন্ধু, ফুলের সওদার খরিদ্দার এরা। এরা অনেকেই আমার আত্মীয় হয়ে উঠেছে, প্রিয় হয়ে উঠেনি কেউ।’
অর্থাৎ চারপাশের সবাই বন্ধু হয় না। প্রাত্যহিক জীবনে অনেকের সঙ্গেই আমরা সময় কাটাই। গল্প করি। আড্ডা জমাই। হৈ-হুল্লোড় মৌজ মাস্তি চলে। কিন্তু এদের সবাই বন্ধু হয় না। সকলের বন্ধু হওয়া যায় না। ফেসবুক টুইটারের এ যুগে লগইন করলেই হলো, বন্ধুর হাতছানি। একজনের পাঁচ হাজার বন্ধু জোটে যাচ্ছে। কিন্তু পাঁচজনও কি প্রকৃত বন্ধু? বড় বিপদের দিনে, সমস্যা সঙ্কটের দিনে, মন খারাপের দিনে পাওয়া যাচ্ছে তাদের? উত্তর অধিকাংশের ক্ষেত্রেই ‘না’ হবে।
বস্তুত স্বার্থের পৃথিবীতে বন্ধু দুর্লভ। তবে ভাল বন্ধু একেবারেই পাওয়া যায় না এমন নয়। বন্ধু আসলে অর্জন করতে হয়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে ভিন্ন কথা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অর্জন করতে হয়। বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় একটি গানের কথা মনে পড়ে গেল, যেখানে বলা হচ্ছে, ‘একটাই কথা আছে বাংলাতে,/মুখ আর বুক বলে একসাথে,/সে হলো বন্ধু, বন্ধু আমার।’ পরের কথাগুলো আরও গুরুত্বপূর্ণ। নম্র সুরে বলা হচ্ছে, ‘কে গরিব কে আমির সে বুঝে না,/জাতির বিচার করা সে জানে না।/সে হলো বন্ধু, বন্ধু আমার...।’ বস্তুত বন্ধু পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহারগুলোর অন্যতম। যিনি পেয়েছেন তিনি এ পাওয়ার মূল্য বোঝেন। যিনি পাননি তিনি বোঝেন আরও বেশি।
তোমায় আমি গড়তে চাই না, পড়তে চাই না/কাড়তে চাই না, নাড়তে চাই না/ফুলের মতো পাড়ত চাই না/চাইছি তোমার বন্ধুতা...। বন্ধুতাই হোক আজকের দিনের মূল চাওয়া। সবাইকে বন্ধু দিবসের শুভেচ্ছা।