
.
আমাদের সমাজে পরিবার মানেই যেন একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার টেবিল, একসঙ্গে ঈদ-পূজার সময় কাটানো, সাত সকালে সন্তানদের স্কুলে ও কোচিংয়ে নিয়ে আসা যাওয়ার দায়িত্ব পালন করা। আজকের এই দ্রুতগতির জীবনে প্রযুক্তির দখলে থাকা সময়গুলোয় পারিবারিক যোগাযোগ যেন হারিয়ে যাচ্ছে অদৃশ্য কোনো দেয়ালে। অথচ পরিবার একে অপরের আবেগ, মতামত, চিন্তাধারা, সৃষ্টিশীলতার আদান-প্রদান করে ভালো-মন্দে পাশে থাকা এবং ভালোবাসায় বেড়ে ওঠার একটি কেন্দ্র হবার কথা।
এই আত্মিক সংযোগ ফিরিয়ে আনতে যে উপায়টি সবচেয়ে সহজ, কার্যকর এবং আনন্দদায়ক হতে পারে তা হলো ‘সাপ্তাহিক পারিবারিক আড্ডা’।
সপ্তাহে একবার দেড় থেকে দুই ঘণ্টার একটা পরিকল্পিত আড্ডা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তৈরি করতে পারে আন্তরিকতা, সহযোগিতা এবং একে অপরকে বোঝার এক শক্তিশালী ভিত্তি। একটি পারিবারিক আড্ডায় যেসব বিষয়গুলো থাকতে পারে তা হলোঃ
১. কুশল বিনিময় ও প্রয়োজনীয় বিষয়ের আলোচনা:
পরিবারের কে কী বিষয় নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে তা জানাল। সন্তানরা জানাল তার পড়ালেখার জন্য বা অন্য কাজে এই মুহূর্তে কী কী লাগবে। বাবা-মা বিষয়গুলো শুনলেন এবং সময় সাপেক্ষে তা পূরণের কথা জানালেন।
উপকারিতা: পরিবারের প্রত্যেক সদস্যদের মাঝে বোঝাপড়া বৃদ্ধি পায়।
২. জ্ঞানচর্চা ও একাডেমিক আলোচনার পর্ব:
মেয়ে-ছেলে তার এই সপ্তাহে স্কুলের মজার অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করল। স্কুল-কলেজের অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করল এবং পড়ালেখার অগ্রগতি বা সমস্যা থাকলে তা জানাল। মা-বাবা পত্রিকার দেশের বা বিশ্বের আলোচনাযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো তুলে ধরলেন।
উপকারিতা: এতে পরিবারে শেখার ক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর হয়।
৩. শখ ও সৃজনশীলতার প্রদর্শনী:
মা বাবা, ছেলে-মেয়ে যে যাতে পারদর্শী- নাচ, গান, কবিত লিখা বা আবৃত্তি, ছবি আঁকা ইত্যাদি সবার নিজ নিজ প্রতিভাগুলো সবার সঙ্গে শেয়ার করল।
উপকারিতা: এতে একে অপরের প্রতিভা ও মনোযোগকে মূল্য দেওয়া হয় এবং সবাই নিজ নিজ সৃজনশীলতা বৃদ্ধির উৎসাহ পায়।
৪. ইনডোর গেমস ও শব্দ খেলা:
শব্দ দিয়ে খেলা, লুডু, কেরাম, পাজল, উনো গেম ইত্যাদি খেলা।
উপকারিতা: এতে বুদ্ধির চর্চা হয়।
৫. ভালো কাজের প্রতিবেদন:
সবাই সবার ভালো কাজগুলো উপস্থাপন করা- যেমন সন্তান জানাল, ‘আমি আমার বন্ধুকে অঙ্ক শিখতে সাহায্য করেছি।’ মা বললেন, ‘আমি পাশের বৃদ্ধা আন্টিকে ওষুধ কিনে দিয়েছি।’ বাবা বললেন, ‘অফিসে এক সহকর্মীর কাজে সাহায্য করেছি।’
উপকারিতা: এতে শিশুদের মধ্যে মানবিকতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ গড়ে ওঠে।
৬. ধন্যবাদ ও প্রশংসার মুহূর্ত:
সবাই সবার ভালো কাজগুলোর প্রশংসা এবং সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। বাবা-মা ছেলেমেয়েদের ভালো পড়াশোনা ও রেজাল্টের জন্য প্রশংসা করল। সন্তানরা ছুটির দিনে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে বাবা-মাকে ধন্যবাদ জনাল।
উপকারিতা: এতে সম্মান ও সম্পর্কের উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়।
৭. নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ চর্চা:
একজন সত্য বলার উপকারিতা নিয়ে কথা বলল। কেউ কোরআনের আয়াত বা হাদিস শোনাল। নবী বা মনীষীদের জীবনীর মাধ্যমে শেখানো হলো ধৈর্য বা সহানুভূতি।
উপকারিতা: এতে সন্তানরা পায় সততা, মানবতা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা। মাস শেষে ‘স্টার অব দ্য মান্থ’ নির্বাচন করা যায় এবং একটি ছোট্ট উপহার দিলে তা মন্দ হয় না। হয়তো সেই ছোট্ট উপহারই হতে পারে সন্তানের কাছে অনেক বড় অনুপ্রেরণার উৎস।
প্রতিদিন কিছুটা সময় তো পরিবারের জন্য দিতেই হবে। পাশাপাশি প্রতি সপ্তাহে এমন একটি পারিবারিক আড্ডারও ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। এতে সবার মাঝে দায়বদ্ধতা, আন্তরিকতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া, পারিবারিক বন্ধন মজবুত হবে। আর এই একটি ছোট্ট আয়োজনেই তৈরি হতে পারে একটি পরিবারে সৃজনশীলতা, সহমর্মিতা ও মননশীলতার এক অনন্য পরিসর।
তাই সপ্তাহে অন্তত একদিন পরিবারের সবাইকে নিয়ে একটুখানি সময় হালকা চা-নাশতা আর মন খুলে কথা বলার জন্য ‘পারিবারিক আড্ডা’র আয়োজন করুন।
প্যানেল