
.
চেরি ফল। নাম শুনে মনে হবে বিদেশী। দেশেই ফলছে, দেশীয় ফল করমচা নামে। বর্ষা মৌসুমের এই ফল নীরবে-নিভৃতে ফলে। কখনও বনফুলের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। বগুড়া নগরীর ছাদবাগানে চেরি করমচা নামে সৌন্দর্যবর্ধনের সঙ্গে ফলছে। করোনাকালে মানবদেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে (এ্যান্টিবডি) চেরি নামের করমচা অন্যতম ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছে। বগুড়ার ফল ও পুষ্পপ্রেমী সুরভী নাসরিন বললেন “বাঙালীর চেরি দেখতে যেমন সুন্দর স্বাদেও ভাল।” ছাদবাগানে টবে করমচা ফলিয়ে তিনি খুশি। বললেন, অনেকে করমচার আচার বানিয়ে বয়ামে রাখে। আচারের স্বাদ খুব ভাল।
বগুড়া নগরীর বহুতল অনেক বাড়িতে ছাদবাগান বানানো হয়েছে। বছর দশেক আগেও এই ছাদবাগান কালচার ছিল না। তখন হাতে গোনা কিছু বাড়ির ছাদবাগানে টবে ফুল ফুটত। লোকজন বলাবলি করতো : এ হলো ছাদবাগান বিলাস। নগরীর অনেকে ব্যালকনি ও ঘরের টবে মানি প্লান্ট, পাতা বাহার ইত্যাদি গাছ লাগায়। নগরীর ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে উদ্ভিদে কত কি না করে। এই জায়গাটিতে বর্তমানে আসন করে নিয়েছে চেরিসহ অনেক ফুল। চেরির পরিচিতি ফল। বগুড়া নগরীর ছাদবাগান এখন আর বিলাস নয়। ছাদবাগানের টবে নানা ধরনের সবজিও ফলছে। নগরীর একটি বহুতল বাড়িতে বিভিন্ন জাতের প্রায় দেড়শ’ বৃক্ষের চারা রোপিত হয়েছে। বাড়ির মালিকের মামা মাহমুদ জানালেন ছাদবাগান দেখার জন্য লোকজন আসছে।
শুরুতে করমচার এতটা পরিচিতি ছিল না। দেখতে চেরি ফলের মতো হওয়ায় অনেক আগেই একশ্রেণীর ব্যবসায়ী এটি প্রসেস করে বয়ামে ভরে চেরি নামে বিক্রি করছে। লালচে রঙের দেখতে সুন্দর ছোট আকৃতির এই ফলের স্বাদে আছে টকের সঙ্গে হালকা মিষ্টির আলাদা ফ্লেভার। কোন করমচা বেশি টক কষ্টা স্বাদের। ছাদবাগানে চেরির সৌন্দর্যবর্ধনের সঙ্গে ফলছে। উদ্যানতত্ত্ববিদ রওশন আক্তার বললেন, টক স্বাদের এই ফল খাওয়া যায়। কাঁচা ফল সবুজ। পরিণত অবস্থায় লালচে রঙের। করমচা ঝোপ দেখতে সুন্দর। বিলুপ্তির পথেই যাচ্ছিল। চেরি ফুলের মতো হওয়ায় প্রথমে নান্দনিকতার ছোঁয়ায় দৃষ্টিনন্দন হয়। তারপর ফলের তালিকায় যুক্ত হয়। সাধারণত প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে। চাষও করা যায়। বর্তমানে শহরের বাসাবড়ির ছাদে সৌখিন বৃক্ষপ্রেমীরা টবে করমচা ফলাচ্ছে। ছাদও দৃষ্টিনন্দন হচ্ছে। ফলও মিলছে।
কৃষি বিজ্ঞানী এ কে এম জাকারিয়া বললেন, বাঙালীর চেরি করমচা ফল হিসাবে অবহেলিত ছিল। পুষ্টিবিজ্ঞানীগণ খুঁজে পেলেন করমচার পুষ্টিগুণ মোটেও অবহেলার নয়। প্রতি একশ’ গ্রাম করমচায় আছে এনার্জি ৬২ কিলোক্যালরি, ভিটামিন এ ৪০ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিট, ভিটামিন সি ৩৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি। এর সঙ্গে আছে নিয়াসিন, রিবোফ্লেভিন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, কর্বোহাইড্রেট। করমচার বহু গুণাবলীÑ রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রেখে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। ডায়াবেটিস রোগীদেরও উপকারী। অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ কমিয়ে দেয়। যকৃৎ ও কিডনির রোগ প্রতিরোধ ও দূষণ পরিষ্কারে সহায়ক। কোন ফ্যাট (কোলেস্টেরল) নেই। করমচার রস সর্দিকাশি, জ¦রজারি উপশম করে। করমচার বিজ্ঞান নাম ক্যারিসা ক্যারোন্ডাম। ইংরেজী নাম ক্রিস্টসথর্ন। কাঁটাযুক্ত গুল্মজাতীয় এই গাছের আদিনিবাস নিয়ে বিতর্ক আছে। কোন প্রজাতি ভারতবর্ষের। তবে বাংলাদেশের সমতল ভূমিতে এই গাছ বেড়ে ওঠে। বিশে^ করমচার ১৫৫ বর্ণের ও গোত্রের গাছ আছে। যার মধ্যে চেরিও অন্তর্ভুক্ত। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে রোপণের পর ফেব্রুয়ারিতে ফুল আসে। ফুল দেখতে সাদা ও ফিকে গোলাপি। মিষ্টি গন্ধ। এপ্রিল ও মে মাসে ফল ধরে। বর্ষায় লালচে হয়ে পাকে। ভেতরে চেরি ফলের মতো ছোট্ট ৪/৫টি বীজ থাকে।
ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবেশবিদ আবু হায়দার বললেন, ভারতবর্ষের আদি চিকিৎসাশাস্ত্রে করমচার উল্লেখ আছে। পাশাপাশি করমচার বহুমুখী গুণাগুণ। ভেষজ চিকিৎসায় অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাচীন বা আদি চিকিৎসা ব্যবস্থায় ভেষজ গুণাগুণ সমৃদ্ধ গাছগাছালি খুঁজে বের করা হতো। বর্তমানেও এইসব গাছ নিয়ে নানা গবেষণা হচ্ছে। বগুড়া নগরীর টবে ভেষজ গুণাগুণের গাছগাছালির চারা রোপণন করা হচ্ছে। নগরীর একটি বহুতল বাড়িতে বিভিন্ন জাতের প্রায় দেড়শ’ বৃক্ষের চারা রোপিত হয়েছে।
ডাঃ এমদাদ হোসেন বললেন, এ্যালোপ্যাথি ওষুধের অনেক ফর্মুলা আসে ঔষধি গাছগাছালি থেকে। ভেষজ কোন্ বৃক্ষের কি গুণাগুণ তা নিয়ে গবেষণা এখনও চলছে। দেশের প্রতিষ্ঠিত অনেক ওষুধ কোম্পানি হারবাল মেডিসিন প্যাকেটজাত করছে। সর্দ্দিকাশি, জ¦রজারির জন্য তুলসীপাতার রস, লং, দারুচিনি, এলাচি, তেজপাতা ইত্যাদি ওষুধের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। কালোজিরা, আদা, রসুন কোনটিই বাকি নেই। মাত্রা মেপে এসব খেলে কোন ক্ষতি নেই। বরং অনেকক্ষেত্রে উপকার আছে।