ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাধন চন্দ্র মজুমদার

ইতিহাসের অংশ পদ্মা সেতু

প্রকাশিত: ২১:১৭, ২৬ জুন ২০২২

ইতিহাসের অংশ পদ্মা সেতু

ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এ.পি.জে. আবদুল কালাম বলেছেন, ‘স্বপ্ন কখনও ঘুমিয়ে দেখতে নেই, ঘুমিয়ে দেখা স্বপ্ন কখনও বাস্তব হয় না। যে স্বপ্ন ঘুমাতে দেয় না, সেই স্বপ্নই ইতিহাস হয়ে থাকে।’ আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ঘুমাতে দেয়নি। তিনি স্বপ্নের বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করেছেন। গোটা জাতিকে উজ্জীবিত রেখেছেন না ঘুমানোর স্বপ্নে। তাই পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপ লাভ করেছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় লাভ করে। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের যাত্রা শুরু হয়। জননেতা সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অর্পণ করে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়। পদ্মা সেতু প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছিল। তদানীন্তন যোগাযোগমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের প্রথমদিন থেকেই পদ্মা সেতু নিয়ে কাজ করতে থাকেন। পরামর্শ নিয়োগ প্রক্রিয়া, পরামর্শক নিয়োগে দরপত্র আহ্বান, মূল সেতুর প্রাকযোগ্য দরপত্র আহ্বান এবং সেতুর অর্থায়ন সংস্থা- বিশ্বব্যাংক, জাপানের জাইকা, ইসলামী উন্নয়ন সংস্থা ও এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণ করা, ক্ষতিগ্রস্তদের তিনগুণ ক্ষতিপূরণ দেয়া এবং তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করা হয়। এমনি পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ঋণ চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ায়। পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক সরে যায়। বাংলাদেশের বিখ্যাত নাগরিক যিনি শান্তিতে নোবেল জয় করেন তিনি বিশ্বব্যাংক ও আমেরিকার একজন আস্থাভাজন ব্যক্তি। শান্তিতে নোবেল পেলেও পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক একটা অশান্তির পরিবেশ তৈরি করেন তিনি। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে দেশী-বিদেশী নানারকম ষড়যন্ত্র শুরু হয়। যে পরিকল্পনা নিয়ে পদ্মা সেতুর কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ব্যাহত না হলে ২০১৩ সালেই পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হতো। ভুয়া কাল্পনিক দুর্নীতির খবর বাংলাদেশের প্রথম সারির কয়েকটি দৈনিক এমনভাবে প্রচার করতে থাকে যেন বাংলাদেশের জাত চলে গেল! যেখানে সেতুর টাকাই ছাড় হয়নি সেখানে কি করে দুর্নীতি হয়? হয়ত অনেকে বলবেন ছাড় হলেই দুর্নীতি হতো। এই অনুমাননির্ভর কথা দিয়ে কি সত্য যাচাই হয়? আসলে যারা বাংলাদেশ চায় না, বাংলাদেশকে ভালবাসে না সেই ফ্যাসিবাদী চক্রই সব সময় ভাল কাজের বাধা দিয়ে আসছে। কিন্তু তারা কখনও সফল হতে পারেনি, পারবেও না কোনদিন। পদ্মা সেতুর কাল্পনিক দুর্নীতির ইস্যুকে কেন্দ্র করে তদানীন্তন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনসহ সেতুর সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন স্বেচ্ছায়। তারা এই মর্মে পদত্যাগ করেন, তবু যেন পদ্মা সেতুটা হয় এবং বিশ্বব্যাংক যাতে ঋণ দান থেকে সরে না দাঁড়ায়। পদত্যাগকারীগণ দেশ প্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তারপরও বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন স্থায়ীভাবে স্থগিত করে। উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু যাতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে না হতে পারে তার একটি ষড়যন্ত্র দৃশ্যমান হয়েছিল, যেমন পাকিস্তান বংশোদ্ভূত একজনকে পদ্মা সেতুর কো-অর্ডিনেটর নিয়োগ করেছিল বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন উর্ধতন কর্তাব্যক্তি গোল্ড স্টেইনের সঙ্গে ছিল ড. ইউনূসের পরম সখ্য। তার পরামর্শে পাকিস্তানীকে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। যা হোক সমস্ত ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সংকল্প গ্রহণ করেন। তখনও সুশীল সমাজের কেউ কেউ এবং কোন কোন অর্থনীতিবিদও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তদানীন্তন বিরোধীদলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করছেন শেখ হাসিনা- এতে কেউ উঠবেন না এটা ভেঙ্গে পড়বে।’ সব সমালোচনা, কটাক্ষ হজম করে স্থিত-প্রাজ্ঞ নেত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর কার্যক্রম শুরু করেন যা বাস্তবে রূপ লাভ করেছে। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন। প্রমত্তা পদ্মা নদীর ওপর দৃশ্যমান এই সেতু এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। পদ্মা সেতু বিশ্বের বিস্ময়। পদ্মা সেতু আমাদের গৌরব ও সাহসের প্রতীক। আমাদের সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। শক্তিশালী প্রকৌশলগত জাতীয় স্থাপনা। কালজয়ী ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে এই পদ্মা সেতু। নিন্দুকেরা এখনও পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির গন্ধ খুঁজে ফিরছে। জানা গেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে প্রমত্ত পদ্মা একটা ভিন্ন প্রকৃতির নদী। কোথাও ব্যাপক গভীরতা আবার তলদেশে বালুর স্তরের ভিন্নতায় পিলার প্রতিস্থাপনে ব্যাপক গবেষণা করতে হয়েছে। অত্যাধুনিক বিশ্বমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। পৃথিবীর কোন সেতুর সঙ্গে এর তুলনা করা যাবে না। পদ্মার চরিত্র বিশ্বের অন্য যে কোন নদী থেকে আলাদা। যে বাজেট নিয়ে এই সেতুর কার্যক্রম শুরু করা হয়, তার তিনগুণ খরচ বেশি হওয়াতে অনেকেই সমালোচনা করছেন। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ আলাদা। গত দুটো বছর করোনার প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ে। মুদ্রাস্ফীতির কবলে পড়ে কাঁচামালসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের দাম হয়ে যায় আকাশচুম্বী। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অর্থনীতিতে নতুন করে চাপ তৈরি হয়। এ সবটার যোগ ফলে পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয়ও বেড়ে যায়। ব্যয়ের ভয়ে সেতু কার্যক্রম থেমে থাকেনি। সততার সঙ্গে সত্যের পথে পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। আমাদের গৌরবের ইতিহাসকে করেছে সমৃদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করেছি। তাঁর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছি। ইতোপূর্বে যেসব দুর্বলতা আমাদের গ্রাস করেছিল, রাষ্ট্র প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল, তা থেকে উত্তরণের সুবর্ণ পথ রেখায় ধাবিত করতে আমাদের নেত্রী নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের মর্যাদা ও মূল্যকে বিশ্ববাসী স্বীকৃতি দিয়েছেন। উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশকেই উদাহরণ হিসেবে টানা হয়। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে জাতিকে সম্মিলিতভাবে চিন্তা করতে হবে কিভাবে এই বাংলাদেশকে আরও সুস্থ ও বলিষ্ঠ করে তোলা যায়। জীব বিজ্ঞান বলে মানুষই একমাত্র প্রজাতি যে পরস্পরের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করতে পারে। চিন্তার এই যে আদান-প্রদান, তার দ্বারাই সে তার বিবর্তনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমাদের সৃজনশীল শক্তির উৎসগুলো কোনদিন শুকিয়ে যাবে না- পদ্মা সেতু সে শিক্ষায় নিশ্চয়ই শিক্ষিত করে তুলবে মহান বাঙালী জাতিকে। লেখক : খাদ্যমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য
×