ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাহদাব আকবর

রাজনীতির হালচাল

প্রকাশিত: ২১:২১, ২৯ জুলাই ২০২০

রাজনীতির হালচাল

এক সমুদ্র রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের লাল সবুজের পতাকা। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ’৭১-এ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন নাম এর সংযোজন ‘বাংলাদেশ’। বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে আজ আমরা বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছি। সমগ্র এশিয়ার মধ্যে আমরা তৃতীয় ও বিশ্বে পঞ্চম দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনৈতিক দেশ। অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমরা দ্রুতবেগে এগিয়ে থাকলেও সামাজিক উন্নয়নে আমরা পশ্চাৎমুখী অবস্থানে আছি। এর একটি প্রধান কারণ হলো স্বাধীনতা উত্তর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘকাল স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি, চিহ্নিত রাজাকারদের দেশে প্রত্যাবর্তন, ক্যু কাউন্টার ক্যু-এর মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধা নিধন ইত্যাদি। ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তিকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্যে নীতি পরিবর্তন এবং কিছু ক্ষেত্রে বিসর্জনও দিতে দেখা যায়। সংসদ সদস্য প্রার্থী মনোনয়নে প্রকৃত রাজনৈতিক নেতাদের পরিবর্তে ধীরে ধীরে ব্যবসায়ীদের অনুপ্রবেশ ঘটে এই যুক্তিতে যে অর্থবল না থাকলে বিজয়ী হওয়া যাবে না। সংসদে অবশ্যই সব স্তরের প্রতিনিধির সমন্বয় থাকতে হবে, কিন্তু বর্তমান চিত্র একটু ভিন্ন। অধিকাংশ সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী অথবা অনৈতিক পন্থায় অর্থ উপার্জনকারী বিত্তশালী। কিছুক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দলীয় আদর্শবিরোধী প্রার্থীকেও নমিনেশন দিয়ে সংসদে স্থান করে দেওয়ার নজিরও দেখা যায়। প্রচুর অর্থ ব্যয় করে যারা সংসদ সদস্য হয়েছেন স্বভাবতই তারা তাদের বিনিয়োগ লাভ ও সুদ সমেত তুলে নিতে উদ্যোগী হবেন। অবশ্য এদের মধ্যে ব্যতিক্রমও আছে। তাদের কাছে নীতি, নৈতিকতা বা আদর্শ একটাই এবং তা হলো যে কোন উপায়ে অর্থ উপার্জন। অর্থ শক্তি বলে এরা দলীয় কিছু নেতৃবৃন্দ ও অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারী কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে তৈরি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রায় সকল পর্যায়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে। ছাগল দিয়ে যেমন হাল চাষ করা যায় না, তেমনি নৈতিকতা বিবর্জিত অনেক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের দিয়ে আদর্শভিত্তিক সুশৃঙ্খল সংগঠন তৈরি করা যাবে না। সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব, আইনের ফাঁকফোকর ও দুর্নীতির কারণে হত্যা, মাদক, অস্ত্রসহ বহু মামলার আসামিও নির্বিঘেœ জামিন পাওয়ায় সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ও আইনের সফল প্রয়োগে ব্যাত্যয় ঘটায় সমাজে অস্থিরতা বিদ্যমান। মানুষ যখন দেখে তার কাছেরই একজন কম যোগ্যতাসম্পন্ন কেউ রাতারাতি গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়ে যাচ্ছে, শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও খুঁটির জোরে অন্যরা চাকুরি পেয়ে যাচ্ছে। কাল যে একজন সামান্য কর্মচারী ছিলেন সে একই ব্যক্তি রাতারাতি হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছে, তখন স্বভাবতই একটা হতাশার সৃষ্টি হয়। রাতারাতি বিত্তশালী হওয়ার মরণ নেশা যেন পুরো সমাজটাকে গ্রাস করে ফেলছে। এইসব সমস্যার জন্য জনগণকে দায়ী করা মোটেও সমীচীন হবে না। জনগণ হচ্ছে নদীর ¯্রােতধারা, নদী যত বাঁক নেবে ¯্রােত সেই বাঁক ধরেই প্রবাহিত হয়ে এক সময় মোহনায় মিলিত হয়। জাতির গতি প্রবাহের সকল ‘বাঁক’ নির্ধারণ করে রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকরা। ¯্রােতধারা তথা আমজনতা জানেই না সামনের ‘বাঁক’টির পর কি অপেক্ষা করছে। জীবন নদীর মানচিত্র তৈরি হয় নীতিনির্ধারক দ্বারা। তাই সমাজের চরম অবক্ষয়ের দায় তাদের উপরই বর্তায়। এই ক্রান্তিলগ্নে করোনার হিংস্র থাবায় বিশ্ব মানচিত্র আজ রক্তাক্ত-ক্ষতবিক্ষত। বাংলাদেশসহ বিশ্ব অর্থনীতির চাকা থমকে আছে। এই ভয়াবহ পরস্থিতির মধ্যেও বিশ্ব রাজনীতির খেলা থেমে নেই। চীন এর উত্থানের কারণে সমগ্র এশিয়া মহাদেশে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এই মেরুকরণে বাংলাদেশের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নিবিড় সখ্য, অন্যদিকে চীনের পুরনো বন্ধু পাকিস্তান ও মিয়ানমারের সঙ্গে নেপালের চীনমুখী অবস্থান। এমন একটি পর্যায়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কি হতে যাচ্ছে তা অনুমান করা গেলেও এখনও পরিষ্কার হয়নি। ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি ও সূক্ষ্ম কুটনীতির মাধ্যমে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা প্রয়োজন। করোনার এই মহামারীকালে স্বাস্থ্য খাতে মারাত্মক দুর্নীতি, দলের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা অপশক্তি, সামাজিক অবক্ষয়, দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থা ও স্থবির অর্থনীতির প্রভাবের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি কেউ যেন অন্যদিকে প্রবাহিত করতে না পারে তার জন্য সরকারকে বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন। লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
×