ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে দুই সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশের দিন

প্রকাশিত: ২৩:০১, ২৪ মে ২০২২

শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে দুই সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশের দিন

মোঃ মামুন রশীদ ॥ পেস তোপের মুখে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে আতঙ্কে শুরু। মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের রহস্যময় উইকেটে আগে ব্যাটিংয়ে নেমেই বিপাকে পড়ে বাংলাদেশ। লঙ্কান দুই পেসার কাসুন রাজিথা আর আসিথা ফার্নান্দো ৪০ মিনিট, ৬.৫ ওভার আর ২৪ রানে ৫ উইকেট তুলে নেন। সেখান থেকে অবিশ^াস্য এক কীর্তি গড়েন মুশফিকুর রহিম ও লিটন দাস। দুজন জোড়া শতক উপহার দিয়ে ষষ্ঠ উইকেটে অবিচ্ছিন্ন থেকে ২৫৩ রানের জুটির বিশ^রেকর্ড গড়েন। শুরুর বিবর্ণতাকে দিনশেষে ঝলমলে রঙিন করেছেন তারা। মিরপুরের সদা পরিচিত ভয়ানক ২২ গজে অকল্পনীয় এক রূপকথাই রচনা করেছেন তারা। দিনশেষে তাই ৫ উইকেটে ২৭৭ রান তুলে স্বস্তিতেই মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ। আইসিসির চেয়ারম্যান গ্রেগ বার্কলের উপস্থিতিতে এদিন মিরপুর স্টেডিয়ামে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ও বিভিন্ন একাডেমির বয়সভিত্তিক ক্রিকেটাররা দেখেছেন মুশফিক-লিটনের কীর্তি। এখান থেকে বড় সংগ্রহের স্বপ্ন দেখতেই পারে স্বাগতিকরা। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধান কোচ রাসেল ডোমিঙ্গো আজ দ্বিতীয় দিনের শুরুতে বাংলাদেশী ব্যাটারদের জন্য দিয়েছেন সতর্কবার্তা। কারণ দ্রুতই ২ উইকেট হারিয়ে ফেললে এখান থেকেও খারাপ অবস্থানে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবলতর হবে। টেস্টে এর আগেও ২৫ রানের মধ্যেই ৫ উইকেট হারিয়েছে বাংলাদেশ। অতি সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেই ডারবান টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে ১৬ রানে ৫ উইকেট হারানোর পর ৫৩ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। এছাড়া এ বছরই জানুয়ারিতে ক্রাইস্টচার্চে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ইনিংসে (ম্যাচের দ্বিতীয়) ২৭ রানে ৫ উইকেট হারানোর পর শেষ পর্যন্ত ১২৬ রানেই গুটিয়ে যেতে হয়েছে বাংলাদেশকে। এছাড়া ২০১৮ সালে এন্টিগায় ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ১৮ রানে ৫ উইকেট হারানো বাংলাদেশ মুখ থুবড়ে পড়ে নিজেদের সর্বনি¤œ সংগ্রহ ৪৩ রানে। তবে ২৫ রানের মধ্যেই ৫ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশের সেরা জুটি ২০০৪ সালে হারারেতে। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে সেই ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে ১৪ রানে ৫ উইকেট হারানোর পর মানজারুল ইসলাম রানাকে সঙ্গে নিয়ে রাজিন সালেহ ৬৭ রানের জুটি গড়েন। এরপরও ১৬৯ রানের বেশি করতে পারেনি বাংলাদেশ। এবার ভয়াল মিরপুরের উইকেটে আগে ব্যাটিংয়ে নেমে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ ২৪ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলে। শূন্য রানেই সাজঘরে ফেলেন মাহমুদুল হাসান জয়, তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসান। ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বার গোল্ডেন ডাক দেখেছেন সাকিব। আর ব্যর্থতায় নিমজ্জিত অধিনায়ক মুমিনুল হক (৯) ও নাজমুল হোসেন শান্ত (৮)। মুমিনুল টানা ৬ ও শান্ত টানা ৩ ইনিংসে দুই অঙ্কে পৌঁছুতে পারেননি। বাঁহাতি পেসার শরিফুল ইসলাম ও অফস্পিনার নাঈম হাসানের ইনজুরিতে বাধ্য হয়েই ২ পরিবর্তন আনতে হয়েছে বাংলাদেশ দলকে। এবাদত হোসেন ফিরেছেন এবং ৩ বছর পর টেস্ট খেলতে নেমেছেন মোসাদ্দেক হোসেন। আর আগের ম্যাচে বল হাতে সুবিধা করতে না পারায় বাঁহাতি স্পিনার লাসিথ এম্বুলদেনিয়ার বদলে আরেক বাঁহাতি প্রাভীন জয়াবিক্রমা নেমেছেন। লঙ্কানদের হয়ে চট্টগ্রাম টেস্টে দুর্দান্ত বোলিং করেন দুই পেসার রাজিথা ও আসিথা। তাই একাদশে টিকে গেছেন তারা মিরপুরের ধীরগতির উইকেট হতে পারে এমনটা জানার পরও। তবে সকালের সুবিধাটা নিয়ে এ দুই পেসার লঙ্কানদের তাঁবুতে আনন্দের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। মাত্র ৪১ বল, ৪০ মিনিট আর ২৪ রানের বিনিময়ে দুজন ৫ উইকেট তুলে নেন বাংলাদেশের। সেখান থেকে আর লঙ্কান বোলারদের সুযোগ দেননি মুশফিক-লিটন। ব্যাট হাতে প্রতিরোধের দেয়াল তুলে এক রূপকথার গল্প লিখতে শুরু করেন তারা মিরপুরের ২২ গজে। প্রথম সেশনে দেখেশুনে আরও ৪২, দ্বিতীয় সেশনে ৩০ ওভারে ৮৭ এবং চা বিরতির পর শেষ সেশনে ৩২ ওভারে আরও ১২৪ রান যোগ করেছেন তারা। এতেই ৫ উইকেটে ২৭৭ রান তুলে দারুণ একটা দিন পার করে বাংলাদেশ। ২৫ রানের মধ্যে ৫ উইকেট হারিয়ে ২৫৩ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে বিশ^রেকর্ড গড়েছেন দুজন। ১৯৫৯ সালে এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের ওয়ালিস ম্যাথিয়াস ও সুজাউদ্দিন বাট ঢাকা স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে যে ৮৬ রানের জুটি গড়েন সেটিই ছিল সেরা। এবার সেটিকে টপকে বিশ^রেকর্ড গড়া লিটন-মুশফিক ষষ্ঠ উইকেটে দেশের পক্ষে সেরা জুটিও গড়েছেন। আগে ষষ্ঠ উইকেটে বাংলাদেশের সেরা জুটি ছিল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই ২০০৭ সালে কলম্বোয় মোহাম্মদ আশরাফুল আর মুশফিকের ১৯১ রান। আর তাই বাংলাদেশ কোচ ডোমিঙ্গো প্রশংসায় পঞ্চমুখ, ‘কোচ হিসেবে টেস্টে এটাই আমার দেখা অন্যতম সেরা জুটির একটা। প্রচ- চাপের মধ্যে এ দুই ব্যাটারের কাছ থেকে আমরা দারুণ কিছু দেখলাম।’ ক্যারিয়ারে এই প্রথম টানা দুই ইনিংসে শতকের দেখা পেলেন চট্টগ্রামেও সেঞ্চুরি পাওয়া মুশফিক। এতে করে মিরপুরে এবং দেশের মাটিতে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বাধিক রানের মালিক হয়েছেন তিনি। ক্যারিয়ারের নবম সেঞ্চুরিটি লঙ্কানদের বিপক্ষে তৃতীয় এবং এটাকে আরও বাড়াতে পারলে বেশ কিছু মাইলফলকের দেখা পাবেন মুশফিক। পাঁচে নামলেও তিনি ৭৬তম ওভারে এবং ছয়ে নেমে ৬৩তম ওভারে সেঞ্চুরি পান লিটন। লঙ্কানদের বিপক্ষে এর আগে ৯৪ ও ৮৮ রানের দুই ইনিংস খেলে আউট হওয়া লিটন এবার ২২১ বলে ১৬ চার, ১ ছক্কায় ক্যারিয়ারসেরা ১৩৫ রানে অপরাজিত আছেন। আর ৪৭ রান করতে পারলেই দেশের অষ্টম ব্যাটার হিসেবে টেস্টে ২ হাজার রানও পূর্ণ হবে তার। মুশফিক ২৫২ বলে ১৩ চারে অপরাজিত ১১৫ রানে। চট্টগ্রামে ‘কনকাসন সাব’ হয়ে নেমে ক্যারিয়ারসেরা বোলিংয়ে ৪ উইকেট নেয়া রাজিথা ৩টি ও আসিথা ২টি উইকেট তুলে নিয়েছেন। মুশফিক-লিটন লঙ্কান ভয়ানক হয়ে ওঠা লঙ্কান বোলারদের পরবর্তীতে নখ-দন্তহীন প্রমাণ করে হতাশ করেছেন সফরকারীদের। তবে এখনও বিপদ কাটেনি। মিরপুরে প্রথম ইনিংসের গড় রান ৩১৪। তাই বড় কিছু করতে হলে আজ দ্বিতীয় দিনের সকালটায় অনেক সতর্ক থাকতে হবে। কারণ নতুন করে উইকেটে থিতু হতে হবে। নয়তো প্রথম দিনের মতোই ঘনিয়ে আসতে পারে বিপদ। সতর্কবার্তাটা দিয়েছেন দিনশেষে বাংলাদেশের প্রধান কোচ ডোমিঙ্গোই, ‘আমাদের প্রথম সেশনের দিকেই সবার মনোযোগ। আবারও জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পড়ার জন্য আমরা ২ উইকেট পিছিয়ে আছি। এখানে প্রথম ইনিংসের গড় রান ৩১৪। এই দুজন (মুশফিক-লিটন) যদি ৩০০ পেরিয়ে যায় এবং মোসাদ্দেক আছে এরপর... আমরা এরচেয়ে বেশি ভাবতে পারছি না। আজ রানের হার চমৎকার ছিল, কিন্তু যতটা মিরপুরকে জানি খেলায় দ্রুতগতি পরিবর্তন হয়। আপনি যে কোন দলকে গুটিয়ে দিতে পারেন ২-৩ সেশনের মধ্যেই।’ দারুণ একটা দিনের পরেও যে সতর্কবাণী শুনিয়েছেন ডোমিঙ্গো তা অমূলক নয়। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা-বাংলাদেশ টেস্ট এখানে ড্র হয়েছে। এরপর গত ৭ বছরে হওয়া ৮ টেস্টেই ফল হয়েছে মিরপুরে। এই ম্যাচগুলোর অধিকাংশই শেষ হয়েছে ৩-৪ দিনে। তাই আজ দিনের শুরুটা বাংলাদেশের ব্যাটাররা কেমন করেন সেটাই হয়তো শেষ পর্যন্ত এই ম্যাচের ভাগ্যটাকে নির্ধারণ করে দেবে।
×