ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রধান বাধা স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত

হালে পানি পাচ্ছে না বিরোধী দলের যুগপৎ আন্দোলন

প্রকাশিত: ২৩:১৭, ২১ মে ২০২২

হালে পানি পাচ্ছে না বিরোধী দলের যুগপৎ আন্দোলন

শরীফুল ইসলাম ॥ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন টার্গেট করে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর যুগপৎ আন্দোলনের চেষ্টা হালে পানি পাচ্ছে না। ডান, বাম ও মধ্যপন্থী আড়াই ডজন রাজনৈতিক দলকে সম্পৃক্ত করে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলনের পথে প্রধান বাধা স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াত। বিএনপি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের পথে হাঁটলেও বাম ও মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর এ বিষয়ে রয়েছে ঘোর আপত্তি। সূত্র জানায়, রাজপথে শক্তি প্রদর্শন করা না গেলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গিয়েও কোন লাভ হবে না- এমন চিন্তাভাবনা থেকে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বছরখানেক আগে থেকেই আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এ নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ৮ থেকে ১০টি ছোট বাম দলকে নিয়ে বৃহত্তর জোট করতে অনেক মিটিং-সিটিং হয়। প্রথমে বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়ে যুগপৎ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তাতেও ঘটে বিপত্তি। কারণ, বিএনপি চায় কৌশলে জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে এই দলটিকেও যুগপৎ আন্দোলনে শরিক রাখতে। আর মধ্য ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো চায় বিএনপি যেন আন্দোলন শুরুর আগেই জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের প্রকাশ্য ঘোষণা দেয়। এদিকে জামায়াত ইস্যু ছাড়াও আদর্শিক আরও কিছু অমিল থাকায় সরকারবিরোধী প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সব দল একমত্যে পৌঁছতে পারছে না। বিশেষ করে আন্দোলন শুরুর পর এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে বিএনপি এককভাবে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করবে কি না সেটি নিয়ে আগাম চিন্তা করতে হচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে। এ ছাড়া যে দলের চেয়ারপার্সন বন্দী জীবনযাপন করছেন এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিদেশে অবস্থান করছেন সে দলের নেতৃত্বে আন্দোলনে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সফল হওয়া যাবে কি না সে বিষয়টিও বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের কাছে অনিশ্চিত। সূত্র জানায়, সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন শুরুর বিষয়ে মাসখানেক আগেও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যে তৎপরতা ছিল তা এখন অনেকাংশেই থেমে গেছে। যদিও বিরোধী দলগুলোর নেতারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে শীঘ্রই আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণা করা হবে জানিয়ে মাঠ গরম রাখার চেষ্টা করছেন। বাস্তবে এখনও এ বিষয়ে কোন প্রস্তুতি নেই। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে চেষ্টা চলছে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে এক সঙ্গে নিয়ে একটি বৈঠক করার। এ বৈঠকে গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেন ও এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব) অলি আহমেদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সিনিয়র নেতাদের উপস্থিত রাখতে চায় বিএনপি। তবে কোন কোন দল বৈঠকের আগে কিছু বিষয়ের ফয়সালা চায়। তাই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির ক’জন সিনিয়র নেতা এ ব্যাপারে চেষ্টা করেও বৈঠক আয়োজনের বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত করতে পারছেন না। তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আন্দোলন বলে কয়ে হয় না। সময়ের প্রয়োজনে যে কোন সময় যে কোন আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। দেশে এখন গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার প্রশ্নে সর্বস্তরের মানুষ ঐক্যবদ্ধ। তাই এবার আন্দোলন সফল হবে এবং এ আন্দোলনের সুফল দেশের মানুষ পাবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, সরকারবিরোধী আন্দোলন চলছে। তবে সরকার পরিবর্তনের জন্য চলমান আন্দোলন যথেষ্ট নয়। শীঘ্রই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের রূপরেখা প্রকাশ করা হবে। এ আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেবে। সরকারকে চাপে ফেলতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির নেতৃত্বে ডান, বাম ও মধ্যপন্থী দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করতে দৌড়ঝাঁপ করছেন বিএনপির কিছু নেতা। তবে যুগপৎ এ আন্দোলনে জামায়াত থাকবে না এমন ঘোষণা দিতে পারেনি বিএনপি। এ কারণে আন্দোলনের বিষয়টি এখনও হালে পানি পায়নি। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই চায় না যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াত থাকুক। কারণ, আন্দোলন সফল হলেও জামায়াতকে নিয়ে করা আন্দোলনের পর দেশ-বিদেশে প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। এদিকে মুখে মুখে বিএনপি নেতারা আন্দোলন আন্দোলন বললেও বাস্তবে আন্দোলন শুরুর আগে বার বার ভাবতে হচ্ছে দলীয় হাইকমান্ডকে। কারণ, এখন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে ঐক্য নেই। দলের কোন কোন নেতার সরকারের লোকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে। আবার কোন কোন সুযোগ সন্ধানী নেতা নির্বাচনের আগে পল্টি দেয়ার চেষ্টায় রয়েছেন। আর এ কারণেই বিএনপির সিনিয়র নেতারা এখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে দলীয় ঐক্যের বিষয়টিকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। সূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াও চান না গতানুগতিক কোন আন্দোলন করে বিএনপি আবারও নতুন করে রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়ুক। তবে কমন ইস্যুতে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করা গেলে সফলতা আসতে পারেন বলে তিনি মনে করছেন। তাই বিএনপির সিনিয়র নেতারা চান মাঠ জরিপ করে আগেই আটঘাট বেঁধে মাঠে নামতে হবে। যেভাবে ২০০১ সালের আগে চারদলীয় জোট করে আন্দোলনে রাজপথ দখলে রেখে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয় লাভ করে বিএনপি। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও রাজপথে আন্দোলনের হাঁকডাক দিয়ে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট করে নির্বাচন করে বিএনপি। তবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন পুরনো ২০ দলীয় জোট সরাসরি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে না থাকলেও বিএনপির সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচন করে জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের ক’টি শরিক দল। এ জন্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন চরম সমালোচনার মুখে পড়েন। বিএনপি কৌশলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে জামায়াতকে শরিক রেখে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় এ নিয়ে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের মধ্যেও কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ত্যাগ করে চলে যায়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর থেকেই রাজনৈতিক জোট নিয়ে বিএনপি চরম সঙ্কটে। যে স্বপ্ন নিয়ে তারা বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে তা কোন কাজেই আসেনি। বরং এ জোটের কারণে ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মী এমনকি বিএনপির কিছু ক্ষব্ধ নেতাকর্মী ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ছিল কার্যত নিষ্ক্রিয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে ভাগে পাওয়া ২৮১টি আসনের মধ্যে বিএনপি জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের ক’টি শরিক দলকে ছেড়ে দেয়া হয় ৪০টি আসন। এর মধ্যে ২৫টি আসন জামায়াতকে দিলেও তাতে কোন কাজ হয়নি। কারণ জামায়াত আগেই বুঝে যায় তারা কোন আসনে জয় পাবে না। তাই নির্বাচনী মাঠে জামায়াতের নেতাকর্মীরা ছিল নিষ্ক্রিয়। এ ছাড়া জামায়াতকে দেয়া ২৫টি সংসদীয় আসনের নির্বাচনে বিএনপি নেতাকর্মীরাও ছিল কার্যত: নিষ্ক্রিয়। সূত্র মতে, বৃহত্তর পরিসরে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে বিএনপি বর্তমানে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক থাকা জাতীয় পার্টির সঙ্গেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। কিন্তু জাতীয় পার্টি এ বিষয়ে বিএনপিকে নেতিবাচক সাড়া দেয়। তাই ইদানীং সরকারী দল আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জাতীয় পার্টিরও কড়া সমালোচনা করছেন বিএনপি নেতারা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে যুগপৎ আন্দোলনের জন্য খুব বেশি রাজনৈতিক দল বিএনপির ডাকে সাড়া দেবে না। তবে আন্দোলনের এ প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াত না থাকলে হয়তো বর্তমান সরকারকে পছন্দ করে না এমন কিছু রাজনৈতিক দল বিএনপির ডাকে সাড়া দিত। কিন্তু বিএনপি ভোট ব্যাংকের কথা চিন্তা করে হয়তো জামায়াতকে দূরে ঠেলতে চাচ্ছে না।
×