ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

৩৭ বছর পর ডিসেম্বরে ঘূর্ণিঝড়ের রেকর্ড

জাওয়াদের প্রভাবে টানা বৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি

প্রকাশিত: ২৩:২৫, ৮ ডিসেম্বর ২০২১

জাওয়াদের প্রভাবে টানা বৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে টানা ৩দিনের বৈরী আবহাওয়া ও বৃষ্টিতে সারাদেশে জনজীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে আসে। এছাড়াও বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন জেলায় কৃষিজমি তলিয়ে যাওয়ায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। দেশে এটি ছিল দীর্ঘ ৩৭ বছর পর ডিসেম্বরে ঘূর্ণিঝড়ের রেকর্ড। এর আগে ১৯৮৪ সালে দেশে ডিসেম্বর মাসে ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড় নিষ্ক্রিয় হওয়ার পর প্রথমে গভীর নিম্নচাপ, এর পর নিম্নচাপ ও সর্বশেষ লঘুচাপ সৃষ্টি হয়। ইতোমধ্যেই বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপটিও দুর্বল হয়ে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। তবে এর প্রভাবে মঙ্গলবারও আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় সূর্যের দেখা মেলেনি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি থাকলেও দুপুরের পর থেকে আকাশ পরিষ্কার হতে থাকে। ৪দিন পর মঙ্গলবার বিকেলে উপকূলাঞ্চলের সমুদ্রবন্দরগুলোর জন্য নামানো হয় সতর্ক সঙ্কেত। আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস অনুসারে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ ভারতের ওড়িশা উপকূলে আঘাত হানার কথা থাকলেও শনিবার রাত থেকেই এর গতিপথ পরিবর্তন হতে থাকে। রবিবার ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ দুর্বল হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলেও এর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে প্রথমে গভীর নিম্নচাপ ও পরে নিম্নচাপের গতিপথ পরিবর্তন হওয়ার পর প্রবল বৃষ্টি ঝড়িয়ে এটি বাংলাদেশ উপকূলের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। রবিবার সকাল থেকে সোমবার রাত পর্যন্ত টানা বৃষ্টির পর আস্তে আস্তে বৃষ্টির মাত্রা কমতে থাকে। এর প্রভাবে মঙ্গলবারও দুপুর পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি হয়। এর ফলে রাস্তাঘাটে চলাচলকারী বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বৃষ্টির কারণে গণপরিবহন সঙ্কটে ছোট ছোট বিভিন্ন যানবাহন যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। মঙ্গলবারও আবহাওয়া বৈরী থাকায় সড়কে অপেক্ষাকৃত কম যানবাহন চলাচল করতে দেখা যায়। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ছিল তীব্র যানজট। দেশে ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ঘূর্ণিঝড় হওয়ার পর জাওয়াদের মাধ্যমে ৩৭ বছর পর ডিসেম্বরে আবারও দেশে ঘূর্ণিঝড় হয়ে গেল। তবে মঙ্গলবার বিকেলে আবহাওয়া অধিদফতরের দেয়া আবহাওয়া বার্তা অনুসারে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের পর সর্বশেষ পরিস্থিতি লঘুচাপটিও দুর্বল হয়ে গুরুত্ব হারিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে সাগর উত্তাল হওয়ার পর ৪দিন আগেই সমুদ্রবন্দরগুলোর জন্য সতর্ক সঙ্কেত দেয়া হয়। প্রথমে ১ ও পরে দেয়া হয় ৩ নম্বর সতর্ক সঙ্কেত। ৪দিন পর মঙ্গলবার এই সতর্ক সঙ্কেত তুলে নেয় আবহাওয়া অফিস। এর ফলে এখন থেকে কোন বিধিনিষেধ ছাড়াই সাগরে নামতে পারবে মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার। যশোরে সাড়ে ২৩ হাজার হেক্টর জমির ফসলের ব্যাপক ক্ষতি ॥ স্টাফ রিপোর্টার জানান, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে অসময়ের ভারি বর্ষণে কপাল পুড়েছে যশোরাঞ্চলের কৃষকের। টানা বৃষ্টিপাতে ভাসছে কৃষকের আমন ধান, সবজি ক্ষেত। তলিয়ে গেছে বোরো ধানের আগাম বীজতলা, আলু ও মসুর ক্ষেত। জেলার প্রায় সাড়ে ২৩ হাজার হেক্টর জমির ধান ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে মাঠে থাকা শীতকালীন সবজির। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর যশোরের তথ্য মতে, অসময়ের এই বৃষ্টিতে জেলার ৮ উপজেলার কর্তনকৃত ৮ হাজার হেক্টর জমির ধান পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বাউফলে আমন ধান ও খেসারি ডালের ক্ষতি ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, বাউফলে বিরামহীন বৃষ্টির কারণে জমিতে পানি জমে থাকায় আমন ধান ও খেসাড়ি ডাল (কলই) চাষীদের খেত ডুবে পচে যাচ্ছে। বাগেরহাটে দুই কোটি টাকার শুঁটকির ক্ষতি ॥ স্টাফ রিপোর্টার জানান, ‘জাওয়াদ’ এর প্রভাবে বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গেছে সুন্দরবনের চারটি চরের প্রায় দুই কোটি টাকার শুঁটকি। মৌসুমের শুরুতে এ ক্ষতি হওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন জেলে ও শুঁটকি ব্যবসায়ীরা। নড়াইলে ১৮ হাজার হেক্টরের বেশি জমির ফসলের ক্ষতি ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, তিনদিনের টানা বৃষ্টিতে নড়াইলে ১৮ হাজার ৬৩২ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফরিদপুরে বৃষ্টিতে পেঁয়াজের বীজতলার ব্যাপক ক্ষতি ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে দেশের সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদনকারী উপজেলা ফরিদপুরের নগরকান্দায় পেঁয়াজের বীজতলার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। টানা দুদিনের বৃষ্টিতে পেঁয়াজের বীজতলায় পানি জমে গেছে। ফলে পেঁয়াজের চারা পচে যাচ্ছে। এছাড়াও বোরো বীজতলার একই অবস্থা। বীজতলা পানির নিচে ডুবে আছে। চাঁদপুরে ৭৮৪২ হেক্টর আবাদি জমির ফসলের ক্ষতি ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে চাঁদপুরে ফসলিজমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ৫ ডিসেম্বর থেকে টানা বৃষ্টিতে জেলার দু’টি সেচ প্রকল্প এলাকাসহ আশপাশের আবাদি জমির আলু, বীজতলা, গম, সরিষা ও পেঁয়াজের জমিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে আলু আবাদের জমি তৈরি করে কৃষকরা এখন বড় ধরনের ক্ষতির শিকার। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, ৭হাজার ৮শ’ ৪২ হেক্টর জমির প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হচ্ছে। ু মুন্সীগঞ্জে ১৩ হাজার হেক্টর আলুর জমি ক্ষতিগ্রস্তÑ ঘরে ঘরে কৃষকের কান্না ॥ স্টাফ রিপোর্টার জানান, মুন্সীগঞ্জে অসময়ের বৃষ্টিতে ১৩ হাজার হেক্টরের বেশি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আলু উৎপাদনের শীর্ষ জেলা মুন্সীগঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ঘরে ঘরে এখন কান্নার রোল। পরিবারগুলোর দিশেহারা অবস্থা। ধার-দেনা করে আলু বপন করতেই বৃষ্টিতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্ন। পানি জমে যাওয়ার কারণে জমিগুলোর আলুবীজ নষ্ট হয়ে গেছে। তাই জমি শুকানোর পরে নতুন করে আলু আবাদ করতে হবে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। পটুয়াখালীতে ফসলের ক্ষতি ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে কয়েকদিনের চলমান বৃষ্টিতে ক্ষেতভরা সোনালি আমনের ওপর বড় ধরনের প্রভাবের আশঙ্কা করছেন কৃষি বিভাগ। পাশাপাশি খেসারি, সরিষা, ধনিয়া ও তরমুজ চাষেও নামতে পারে বিপর্যয়। এতে করে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন জেলার কৃষক। টাঙ্গাইলে বৃষ্টিতে সরিষা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, টাঙ্গাইলের বাসাইলে টানা দুই দিন গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। এদিকে সরিষার কাটুই পোকার আক্রমণে দিশেহারা কৃষক। আর অসময়ের এই বৃষ্টিতে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে কৃষক। সরেজমিন দেখা যায়, বৃষ্টির ফলে অনেক জমির সরিষা চারা গাছ পচে গেছে।
×