ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ অরূপরতন চৌধুরী

তামাকমুক্ত বাংলাদেশের অন্তরায়

প্রকাশিত: ২২:৪৩, ৬ ডিসেম্বর ২০২১

তামাকমুক্ত বাংলাদেশের অন্তরায়

জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় হুমকি ‘তামাক’। সস্তা, সহজলভ্যতা, তামাক কোম্পানির প্রলুব্ধকরণ কার্যক্রম ও নানা কারণে দেশের জনগণের মধ্যে তামাকজাত পণ্য ব্যবহারের বিদ্যমান হার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সন্তোষজনক নয়। গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে-২০১৭-এর তথ্যানুসারে, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে ৩৫.৩% (৩ কোটি ৭৮ লক্ষ) তামাকজাত দ্রব্য সেবন করেন। ঞড়নধপপড় অঃষধং-২০১৮ তথ্যমতে বাংলাদেশে তামাকজনিত রোগে (ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের রোগ ইত্যাদি) আক্রান্ত হয়ে বছরে প্রায় ১ লাখ ৬২ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে, যা দেশে মোট মৃত্যুর ১৩.৬%। সড়ক দুর্ঘটনা, মহামারী বা যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানির চাইতে তামাকজনিত কারণে কয়েকগুণ বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। তামাকজাতীয় ক্ষতিকর পণ্য সেবনের কারণে অনেক অসংক্রামক রোগের বিস্তার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। দরিদ্র জনগণ তামাকজাত পণ্যের ভোক্তাদের একটি বিরাট অংশ। স্বাভাবিকভাবেই তামাক সেবনকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে রোগ-শোক দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ সকল রোগের চিকিৎসায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়, যার প্রায় পুরোটাই ব্যয় করতে হয় আক্রান্ত ব্যক্তিকে। আর তাই দরিদ্রতা, অপুষ্টিতে ভুক্তভোগী মানুষের সংখ্যাও কমছে না। আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ও অন্যান্য সংস্থা পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে তামাকের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় ৩০,৫৭০ কোটি টাকা, ঐ বছরে যা ছিল জিডিপির ১.৪ শতাংশ। দেশে অন্যতম বড় সামাজিক সমস্যা ‘মাদকাসক্তি’র মূল অনুঘটক ‘তামাক’। গবেষণায় দেখা যায়, মাদকাসক্তদের ৯৫ ভাগই ধূমপায়ী। অর্থাৎ, ধূমপান দিয়েই তারা পা বাড়ায় নেশার জগতে। তামাকের ক্ষয়ক্ষতি থেকে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ সুরক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে বর্তমান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ প্রশংসনীয়। তামাক নিয়ন্ত্রণে সামাজিক আন্দোলনটি সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে। বিগত দিনে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন, বিধিমালা প্রণয়ন, জনগণের মধ্যে তামাকবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে এবং বর্তমানেও চলমান। দীর্ঘমেয়াদে তার সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৬ সালে ‘সাউথ এশিয়ান স্পীকার সামিটে’ বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ দেখতে চান মর্মে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। সময়ের প্রয়োজনে তাই এখন আরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। তার মধ্যে অন্যতম বিএটিবি থেকে সরকারের শেয়ার প্রত্যাহার। বহুজাতিক তামাক কোম্পানি ‘ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোতে সরকার ও সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১০% শেয়ার রয়েছে। জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ বিধ্বংসী পণ্যের ব্যবসায় সরকারের অংশীদারিত্বের বিষয়টিকে অনেকেই সরকারের দ্বৈতনীতি হিসেবে দেখছেন। কারণ, তামাক নিয়ন্ত্রণে প্রায় ২ দশক ধরে বাংলাদেশ সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ২০০৩ সালে আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি এফসিটিসিতে স্বাক্ষরের পর তামাক নিয়ন্ত্রণে আমাদের সাফল্যের ঝুড়িতে কিছু অর্জন রয়েছে। বর্তমান সরকারপ্রধান তামাক নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত ইতিবাচক। এমতাবস্থায়, তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার এবং নিরুৎসাহিত/ক্ষতিকর পণ্যের ব্যবসা থেকে লভ্যাংশ গ্রহণ সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টাকে জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এর ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জনগণ। কেননা, তামাক নিয়ন্ত্রণ/জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং অজানা কারণে বিলম্ব হচ্ছে। যার দরুন সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ নীতিগুলোর কার্যকর বাস্তবায়নেও যথেষ্ট ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুসারে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নে একটি ‘রোডম্যাপ’ প্রণয়নের কাজ ৩ বছরের অধিক সময় ধরে চলমান। জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী (এনটিসিপি) প্রণয়নের বিষয়টিও আলোচনায় আছে অনেক দিন যাবত। এছাড়াও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে আরও কিছু নীতি, যেমন- তামাক চাষ নীতি, এফসিটিসি আর্টিকেল ৫.৩ বাস্তবায়নে ‘গাইডলাইন’ প্রণয়নের কাজ চলমান বলে জানা গেছে। কিন্তু এ নীতিগুলো কবে নাগাদ চূড়ান্ত হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে দেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের কর্মীদের। কারণ, বিএটিবিতে সামান্য শেয়ার থাকায় সরকারের উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তাকে বিএটিবির পরিচালনা পর্ষদে প্রতিনিধিত্ব করতে হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা জনস্বার্থের পাশাপাশি তামাক কোম্পানির স্বার্থসিদ্ধির বিষয়টি দেখবেন। কোন কোন ক্ষেত্রে তামাক কোম্পানির লাভের পাল্লাটাই ভারি হয়ে থাকে। তামাক কোম্পানিতে শেয়ার ও সরকারী কর্মকর্তার প্রতিনিধিত্ব থাকার ফলে- * আইন/নীতি গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তামাক কোম্পানি সরাসরি হস্তক্ষেপ করে থাকে। ফলে আইন/নীতি দুর্বল হয়ে থাকে এবং এ সকল নীতি প্রণয়ন ও চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়া বিলম্ব হয়ে থাকে; * আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি-এফসিটিসির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংঘর্ষ সৃষ্টি করে এবং এর প্রতিপালনে বাধা সৃষ্টি করে; * জনস্বাস্থ্য বিষয়ক আইন/নীতিতে জনগণের স্বার্থ সঙ্কুচিত এবং এর প্রয়োগ দুর্বলতর হয়; * সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিভ্রান্তকর তথ্য প্রদানের মাধ্যমে তামাক কোম্পানিগুলো নিজ স্বার্থ হাসিল করে; * ক্ষতিকর পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘনে উৎসাহী হয়; * সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কর্মসূচীর আড়ালে তামাক কোম্পানিগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করে; * জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন/তামাক নিয়ন্ত্রণ কমসূচী ক্ষতিগ্রস্ত বা দুর্বল হয়ে পড়ে; * জনগণের মধ্যে একটি সন্দেহ তৈরি হয়, যা লক্ষ্যকে সামনে নিতে বাধা সৃষ্টি করে। তামাক কোম্পানিতে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিত্ব থাকার নেতিবাচক দিক পরিলক্ষিত হয়েছে গত বছরে। করোনাকালীন যখন সমস্ত উৎপাদনমুখী সেক্টর সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল, এমনকি কঠোর লকডাউনের সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিপণন বন্ধ থাকলেও তামাক পণ্য উৎপাদন, বিপণন, এমনকি আইন লঙ্ঘন করে তামাক পণ্যের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা বন্ধ ছিল না। কারণ, শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ অনুমোদন নিয়ে তারা এ কাজ চালিয়ে গেছে। অবশ্য এখানে আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। তা হলো- অতি পুরনো আইন ‘এসেনসিয়াল কম্যুডিটি এ্যাক্ট-১৯৫৬’তে তামাক এখনও ‘জরুরী পণ্য’ হিসেবে লিপিবদ্ধ রয়েছে, যা বাতিল করা বর্তমানে অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার ও তাদের পরিচালনা পর্ষদে সরকারী প্রতিনিধিত্ব তামাক নিয়ন্ত্রণে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। সুতরাং, জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় এবং নৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় করার স্বার্থেই সরকারকে এ অবস্থান থেকে সরে আসা আবশ্যক। যেহেতু ৩০% থেকে শেয়ার ১০%-এর নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে, তবুও সামান্য এ শেয়ার তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারপ্রধানের ঘোষণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সুতরাং, অতি দ্রুত ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি থেকে সরকারের বাকি শেয়ার প্রত্যাহার করা উচিত। এতে বিশ্ব দরবারে দেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে। লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, অধ্যাপক, একুশে পদকপ্রাপ্ত এবং শব্দ সৈনিক (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র), সাম্মানিক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম ও অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিক্যাল কলেজ
×