ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষাক্ষেত্রে ব্লেন্ডেড পদ্ধতিকে আমাদের কেন অগ্রাধিকার দেয়া উচিত

প্রকাশিত: ২১:২০, ২৭ অক্টোবর ২০২১

শিক্ষাক্ষেত্রে ব্লেন্ডেড পদ্ধতিকে আমাদের কেন অগ্রাধিকার দেয়া উচিত

শিক্ষা মূলত তিনটি আন্তঃসম্পর্কিত উপাদান নিয়ে গঠিত- টিচিং (শিক্ষণ), লার্নিং (শিক্ষণ) এবং এ্যাসেসমেন্ট (মূল্যায়ন)। শিক্ষার এই উপাদানগুলোর প্রতিটি প্রতিফলিত হলে সেটিকে আমরা ব্লেন্ডেড লার্নিং বলতে পারি। মানব সৃষ্টির শুরু থেকে আমরা প্রচলিত ফেস-টু-ফেস (অনসাইট) শিক্ষায় অভ্যস্ত, যা পরবর্তীতে আইসিটি টুলসের মাধ্যমে আরও উন্নত হয়েছে। যেমন মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরসহ একটি শ্রেণীকক্ষে পাঠদান। অন্যদিকে অনলাইন লার্নিং হলো এমন শিক্ষা যা ইন্টারনেটে এবং দূরশিক্ষণের মাধ্যমে হয়, প্রচলিত ক্লাসরুমে হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এলএমএস) দিয়ে জুম বা মিট ভিডিও কনফারেন্সিং ব্যবহার করে ক্লাস পরিচালনা করা। ব্লেন্ডেড লার্র্নিংয়ের অর্থ হলো ফেস-টু-ফেস এবং অনলাইন কার্যকলাপের উদ্দেশ্যমূলক সংমিশ্রণ। যেমন তিনদিন ফেস-টু-ফেস এবং দুইদিন অনলাইনে সমন্বিত ক্লাস পরিচালনা করা। তবে প্রচলিত ক্লাসে স্মার্টবোর্ড ব্যবহার করা বা অনলাইন ক্লাসে জ্যামবোর্ড বা একটি লেকচার ক্লাসের পর ফিল্ড ভিজিটের মতো কাজগুলো সাধারণত আজকের প্রেক্ষাপটে ব্লেন্ডেড লার্নিং নয়, এটিতে অনসাইট এবং অনলাইন উভয় উপাদান থাকা উচিত। আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এবং ইন্টারনেটের স্বল্প গতির মধ্যে কোভিড-পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থা অনলাইন বা ফেস-টু-ফেস নয়, বরং স্মার্ট পদ্ধতিতে ব্লেন্ডেড হতে পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত শিক্ষার পূর্ণ মূল্যায়নের জন্য একটি জাতীয় ব্লেন্ডেড লার্নিং টাস্কফোর্স গঠন করেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) উচ্চশিক্ষার জন্য জাতীয় ব্লেন্ডেড লার্নিং পলিসি প্রণয়ন করে সেটাকে নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে। এই পলিসি প্রোগ্রাম পর্যায়ে বিবেচনা করা হতে পারে এবং একটি প্রোগ্রাম যেমন রসায়নে স্নাতকের মোট ক্রেডিটের প্রায় ৩৩-৪০% কোর্স একাডেমিক কমিটির পূর্বানুমতি নিয়ে অনলাইনে পরিচালনা করা যেতে পারে। মহামারী চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল অপ্রত্যাশিত এবং জরুরী ভিত্তিতে পূর্বের ফেস-টু-ফেস কোর্সগুলো অনলাইনে পড়ানো এবং মহামারীর শেষের দিকে আবার প্রচলিত পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়া। এই পরিবর্তন বিশ্বজুড়ে অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্য সহজ ছিল না, প্রাতিষ্ঠানিক নীতি এবং অনুশীলনে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হয়েছে। এখন কোভিড-পরবর্তী পর্যায়ে আমাদের কি এসব উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনকে পেছনে রেখে চিরায়ত মুখোমুখি শিক্ষায় ফিরে যাওয়া উচিত? অবশ্যই না। তাহলে এখন আমাদের এগিয়ে যাওয়ার কৌশল কি হওয়া উচিত? ব্লেন্ডেড লার্নিং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষার জন্য নিউ নরমাল হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচিত হচ্ছে। আসুন জেনে নিই কেন বাংলাদেশে ব্লেন্ডেড শিক্ষার বিষয়টি বিবেচনা করা আমাদের জন্য একটি ভাল বিকল্প হতে পারে- ১. তাত্ত্বিক ভিত্তি : ব্লেন্ডেড লার্নিং ফ্লিপড ক্লাসরুম পেডাগজি সমর্থন করে, যা নিম্নক্রম চিন্তাভিত্তিক লেকচার উপাদানকে বোঝায়। এটি ইন্টারএ্যাকটিভ বিষয়বস্তু (পিডিএফ, পডকাস্ট বা ভিডিও) হিসেবে বাসায় পড়াশোনার জন্য দেয়া হয় এবং সমস্যা সমাধান, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, আলোচনা জাতীয় উচ্চতর বিষয় অনুশীলনের জন্য পর্যাপ্ত সময় এবং শিক্ষকের তত্ত্বাবধানসহ প্রচলিত ক্লাসে ফিরিয়ে আনা হয়। এই পেডাগজি সক্রিয় শিক্ষার তত্ত্বকে সমর্থন করে, যা কাজ করতে করতে শেখাকে উদ্বুদ্ধ করে। ২. সময় এবং স্থানভিত্তিক ফ্লেক্সিবিলিটি : ব্লেন্ডেড লার্নিং পদ্ধতিতে ক্লাস বা কাজের সিডিউল সপ্তাহে ৫ দিনের মধ্যে ৩ দিন অনসাইট এবং ২ দিন অনলাইনে হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য এবং শিক্ষকদের জন্য ৪ দিন অনসাইট এবং ১ দিন অনলাইনে হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে গুণগত মান এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরী। এটি অনেক সময় এবং স্থান বাঁচাবে। কেননা আমাদের মতো দেশে যানজট এবং অন্য অনেক সমস্যা প্রতিদিনের সঙ্গী। ৩. উন্নত টিচিং-লার্নিং : ব্লেন্ডেড পদ্ধতিতে টিচিং-লার্নিং আরও ভাল হবে। কারণ অনসাইট এবং অনলাইন পদ্ধতির সেরা অংশগুলো এতে সংহত করা যায়। যেমন অনসাইট ক্লাসের ইন্টারএ্যাকশন, অনলাইন শিক্ষার ক্লাস রেকর্ডিং, বিষয়বস্তুর সুশৃঙ্খল সংগঠন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের জন্য এলএমএস অত্যন্ত উপকারী। কারণ তারা সব বিষয়বস্তু, মূল্যায়ন এবং অনুশীলনের অপশন এক জায়গায় পায়, যা যে কোন সময়, যে কোন জায়গায় এ্যাক্সেস করা যায়। ৪. প্রামাণিক মূল্যায়ন : অনলাইন শিক্ষা টিচিং-লার্নিংয়ের জন্য ভাল। কিন্তু মূল্যায়নের নিরিখে এটি সুবিধাজনক নয়। বিশেষ করে সামষ্টিক মূল্যায়ন (যেমন, ফাইনাল পরীক্ষা)। উচ্চশিক্ষার জন্য ইউজিসি প্রদত্ত ন্যাশনাল ব্লেন্ডেড লার্নিং পলিসি অনুসারে মিড-টার্ম পরীক্ষাসহ সমস্ত ধারাবাহিক মূল্যায়ন অনলাইনে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু অসাধু উপায় রোধ করার জন্য ফাইনাল পরীক্ষা অনসাইট হতে হবে এবং একই সঙ্গে উদ্ভাবনী অনলাইন মূল্যায়ন কৌশলগুলোর জন্য গবেষণা করতে শিক্ষাবিদদের উৎসাহিত করতে হবে। ৫. সম্পদের যথাযথ ব্যবহার : প্রতি বছর ১০ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় এবং আমাদের ভৌত অবকাঠামো রাতারাতি বাড়ানো সম্ভব নয়। ব্লেন্ডেড পদ্ধতিতে সময় এবং স্থানভিত্তিক ফ্লেক্সিবিলিটি (যেমন, ক্লাসের সময়সূচীতে) থাকার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ পায়। উদাহরণস্বরূপ, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫২ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থী রয়েছে, যেখানে আমাদের একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেটি আয়তনে প্রায় ৭-৮ গুণ বড়, সেটিতে রয়েছে মাত্র ১৬ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থী। এভাবে আমরা দেশের সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছি। ৬. শিক্ষার্থীদের অধিক অংশগ্রহণ ও মনোযোগিতা : ইন্টারএ্যাকশন, পারস্পরিক সম্পর্ক, পুনর্ব্যবহারযোগ্য ক্লাস রেকর্ডিং, ডিজিটাল সরঞ্জাম এবং কৌশলের ক্ষেত্রে অনসাইট এবং অনলাইন শিক্ষার সর্বোত্তম অনুশীলনগুলো একত্রিত করে পাশাপাশি প্রয়োগ করা যেতে পারে, যাতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ও মনোযোগ ভাল হবে। এলএমএস-এ শিক্ষার্থীদের সক্রিয় রাখতে পারলে তাদের শেখার অভিজ্ঞতা ভাল হয়, সঙ্গে সঙ্গে শেখার ফলাফলও। ৭. শেখার এবং উপার্জনের অপশন : যদি ক্লাসের সময়সূচী ব্লেন্ডেড হয় (যেমন ৩ দিন অনসাইট এবং ২ দিন অনলাইন), শিক্ষকরা এই সময়টিকে গবেষণা, উদ্ভাবন, ইন্ডাস্ট্রি এনগেজমেন্টের জন্য ব্যবহার করতে পারেন। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা নিজেদের গবেষণায় নিয়োজিত করতে পারে। বাড়িতে পড়াশোনা অথবা বাইরে খণ্ডকালীন কাজে যোগ দিতে পারে। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমনটাই হচ্ছে, যেখানে শিক্ষা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ৮. প্রাসঙ্গিক সমস্যা : আমাদের দেশে বিভিন্ন স্তরে শিক্ষায় আগ্রহী সকল ছাত্রছাত্রীর জন্য পড়াশোনা করার বা থাকার পর্যাপ্ত জায়গা নেই। একই সঙ্গে ইন্টারনেটের কম গতি, ডিভাইসের অভাব এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থা অনলাইন শিক্ষার সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করছে। ব্লেন্ডেড শিক্ষা ফ্লেক্সিবল এবং দেশের মানসম্মত শিক্ষা অব্যাহত রাখতে এটি সম্ভাব্য সর্বোত্তম অপশন হতে পারে। ৯. জবাবদিহিতা এবং রিপোর্টিং : ব্লেন্ডেড শিক্ষা সময়, স্থান এবং অন্য পরিমিতিগুলোতে ফ্লেক্সিবল, যেমন শিক্ষকরা অফিসে ৩ বা ৪ দিন এবং অনলাইনে ২ বা ১ দিন কাজ করতে পারেন। তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর স্ট্যান্ডার্ড মেনে রিপোর্টিং হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মার্ট-এডুকেশন সিস্টেম ডিজিটাল প্রমাণ হিসেবে শিক্ষকদের কার্যক্রম রেকর্ড করে এবং তাদের কাজের পদ্ধতি নির্বিশেষে মাসিক এনালিটিক্স প্রদান করে এবং সেইসঙ্গে স্বচ্ছভাবে তাদের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক রিপোর্টিং করে। ১০. ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি : গত দেড় বছর ধরে আমরা অনেক কিছু শিখেছি এবং এখন আমাদের ব্লেন্ডেড লার্নিং-এর বিভিন্ন দিক যেমন ডিজিটাল দক্ষতা, শিক্ষাগত উদ্ভাবন, বিভিন্ন ধরনের ইন্টারএ্যাকশন, এনগেজমেন্ট এবং মূল্যায়ন কৌশল, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, সহায়তা কাঠামো, ডিজিটাল পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর মনোযোগ দিতে হবে এবং ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক নীতি এবং অনুশীলনে সেগুলো গ্রহণ করতে হবে, যাতে আমরা ২০২৬ সালের মধ্যে ৩৭৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের বৈশ্বিক ডিজিটাল শিক্ষা বাজারের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে পারি। কোভিড-১৯-এর আবির্ভাবের সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তৎপর পদক্ষেপের কারণে আমরা আজকে এত দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্লেন্ডেড, অনলাইন এবং ডিজিটাল শিক্ষায় যে অগ্রগতি করেছি তা বেশ অবিশ্বাস্য। অন্যথায় এটি করতে ৫-১০ বছর সময় লাগতে পারত। এখন সকল স্তরের মানুষ এর গুরুত্ব অনুভব করেছে এবং আমাদের এটিকে পুঁজি করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত। যদি এখনও ব্লেন্ডেড শিক্ষা যথাযথভাবে অনুধাবন করা যায় তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে না। শিক্ষকদের তাদের বেঁচে থাকার জন্য বেমানান চাকরি খুঁজতে হবে না এবং শিক্ষার্থীরাও হতাশাবোধ করবে না। বিশ্বব্যবস্থাপনা ক্রমবর্ধমানভাবে ডিজিটাল হচ্ছে এবং যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডিজিটালাইজেশনে নিজেদের শামিল করতে না পারবে তারা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে। আমরা যত তাড়াতাড়ি সেটি উপলব্ধি করব ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক। লেখক : অধ্যাপক, ব্লেন্ডেড, অনলাইন ও ডিজিটাল এডুকেশন এক্সপার্ট, পরিচালক, ব্লেন্ডেড লার্নিং সেন্টার, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, প্রতিষ্ঠাকালীন বিভাগীয় প্রধান, আইসিটি ও শিক্ষা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি
×