ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে ॥ এসেছে হেমন্তলক্ষ্মী

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ১৭ অক্টোবর ২০২১

দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে ॥ এসেছে হেমন্তলক্ষ্মী

মোরসালিন মিজান ॥ হেমন্ত এসেছে। সর্বত্রই যখন ভ্যাপসা গরম নিয়ে চর্চা হচ্ছে, চরম অস্বস্তি যখন জনজীবনে তখন পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে এলো হেমন্ত। আজ ১ কার্তিক, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। প্রিয় ঋতু শুরুর দিন। কবির ভাষায়: সবুজ পাতার খামের ভেতর/হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/কোন্ পাথারের ওপার থেকে/আনল ডেকে হেমন্তকে...। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে দুই মাস পর পর রূপ বদলায় প্রকৃতি। সে হিসেবে কখনও গরম। কখনও শীত। আর তার মাঝের সময়টা হেমন্ত। কার্তিক অগ্রহায়ণ দুই মাস হেমন্তকাল। শীত নয়, তবে শীতের বাহন বলা হয় হেমন্তকে। বর্তমানে বৃষ্টি নেই। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ অনেক বেশি। এর ফল ভ্যাপসা গরম। তাপ বিকিরণ প্রক্রিয়ায় রাতেও ঠা-া হচ্ছে না প্রকৃতি। শনিবার দুপুর নাগাদ দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্র ছিল ৩৮.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। তবে আবহাওয়াবিদদের মতে, এখন থেকে যত দিন যাবে ততই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য কমতে থাকবে। পার্থক্য যত কমবে তত বাড়তে থাকবে শীত। নবেম্বরের পুরোটা এভাবে যাবে। ডিসেম্বর থেকে জোরে বইবে শীতের হাওয়া। এখনই অল্পস্বল্প শিশির ঝরতে শুরু করেছে। বাইরের জেলাগুলোতে তো বটেই, ঢাকায়ও শিশির ঝরছে। আর ভোর বেলায় কুয়াশা। সবুজ পাতার গায়ে জমে থাকা শিশির বিন্দু স্বাগত জানাচ্ছে হেমন্তকে। জীবনানন্দ দাশের ভাষায়: পা-ুলিপি কাছে রেখে ধূসর দ্বীপের কাছে আমি/নিস্তব্ধ ছিলাম ব’সে;/শিশির পড়িতেছিল ধীরে-ধীরে খ’সে;/নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি/উড়ে গেলো কুয়াশায়,-কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরো...। অবশ্য হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকের এক রূপ। পরেরটির রূপ অন্য। এক সময় হেমন্তের প্রথম মাসটি ছিল অনটনের। ফসল হতো না। বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা দিত। সারাবছরের জন্য জমিয়ে রাখা চাল ফুরিয়ে যেত এ সময়ে এসে। ধানের গোলা শূন্য হয়ে যেত। কার্তিকের দুর্নাম করে তাই বলা হতো ‘মরা কার্তিক’। রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ও দুর্দিনের উল্লেখ পাওয়া যায়। কবিগুরু লিখেছেন: শূন্য এখন ফুলের বাগান, দোয়েল কোকিল গাহে না গান,/কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে...। বর্তমানে কার্তিক আর মরা কার্তিক নয়। ফসলে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। অগ্রহায়ণে মাঠের সোনালি ফসল কাটা শুরু হয়। দেখতে দেখতে গোলা ভরে ওঠে কৃষকের। হেমন্তের বাতাসে ভেসে বেড়ায় পাকা ধানের মন মাতানো ঘ্রাণ। বাড়ির আঙ্গিনা নতুন ধানে ভরে ওঠে। কৃষক বধূ ধান শুকোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রতি ঘর থেকে আসে ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ। তবে যত দিন যাচ্ছে ততই বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। এখন শস্যের বহুমুখীকরণের ফলে মোটামুটি সারাবছরই ব্যস্ত থাকতে হয় কৃষককে। নানা ফসল ফলান তারা। আয় রোজগারও বেশ। পাশাপাশি এখন কার্তিক মাসেই হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শীষ। পাকা ধান কাটা শুরু হয়ে যায়। ঠিক এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে আগাম আমন ধান কাটার উৎসব। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে মহাধুমধামে চলছে ফসল কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ। বগুড়া, রংপুর, নীলফামারীসহ বিভিন্ন জেলার কৃষকরা যারপর নাই ব্যস্ত। কৃষকরা বাড়তি লোক নিয়ে ফসলের মাঠে যাচ্ছেন। দিনভর চলছে ধান কাটা। তারপর ফসল কাঁধে বাড়ি ফিরছেন। এত যে দেখা, তবু চোখ সরানো যায় না! অদ্ভুত ছন্দ তুলে সরু আইল মেঠো পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফেরেন কৃষক। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষমাণ কিষানি। ধান মাড়াই, শুকিয়ে ঘরে তোলার দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় খুশি মনেই অংশ নিতে দেখা যায় তাদের। অগ্রহায়ণে সারা বাংলায় চলে নবান্ন উৎসব। চলে বলতে, একসময় চলত। বাঙালীর প্রধান ও প্রাচীনতম উৎসবগুলোর অন্যতম নবান্ন। এ সময় আমন ধান কাটা শুরু হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফসল উৎপাদনের সময় এটি। প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টন আমন উৎপাদন হয় এ সময়। নতুন ধানে চলে নবান্ন উৎসব। আমন ধানের চালে প্রথম রান্না হয়। এ উপলক্ষে চলে আনন্দঘন উদ্যাপন। কোন কোন অঞ্চলে ফসল কাটার আগে বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখা হয়। বাকি অংশ চাল করে সে চালে চলে পায়েস রান্না। এভাবে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত হয় নবান্ন উৎসব। শুধু গ্রামে নয়, এখন শহরেরও থাকে নানা আয়োজন। গ্রামের মতো না হলেও প্রতিবছর ১ অগ্রহায়ণ রাজধানী ঢাকায় প্রতীকী নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়। এভাবে শেকড়ের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার অনুপ্রেরণা হয়ে আসে হেমন্ত। হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে/হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে...। আজ থেকে হেমন্তের হিম শীতল আঁচলে বাঁধা পড়ল বাংলাদেশ।
×