ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তামিমের সরে যাওয়া এবং কিছু প্রশ্ন

প্রকাশিত: ২৩:৫৪, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১

তামিমের সরে যাওয়া এবং কিছু প্রশ্ন

টানা খেলার চাপ, অসুস্থতা বা অন্য কোন কারণে যে কোন ক্রিকেটারই সাময়িক বিরতি নিতে পারেন, পারেন নিদ্দিষ্ট কোন আসর থেকে সরে দাঁড়াতে। ইংলিশ সুপারস্টার বেন স্টোকসই যেমন এখন ক্রিকেটের বাইরে আছেন। এমন কি তার আসন্ন টি২০ বিশ্বকাপেও খেলার সম্ভাবান কম (আপাতত দলে নেই)। কিন্তু তামিম ইকবাল যেভাবে, যে পরিস্থিতিতে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বেশ কিছুদিন টি২০ ক্রিকেটের বাইরে থাকলেও কখনোই তিনি বলেননি যে, বিশ্বকাপে খেলবেন না। ঘটনাটা ঘটেছে কিছুটা নাটকীয় ভাবে। যখন প্রধান কোচ রাসেল ডোমিঙ্গো সংবাদ মাধ্যমকে তামিমের থাকা- না থাকার ইস্যুতে বলেন, ‘দলে যারা আছে তাদের নিয়ে প্রশ্ন করুন!’ এবং আশ্বর্যজনক অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ এ নিয়ে একটি বাক্যও ব্যয় করেননি। তামিমের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কর্তারা! বিশ্বকাপের প্রায় এক মাস আগে সেই তামিম যখন ফিট হয়ে অনুশীলনে ফিরেছেন, খেলতে যাচ্ছেন এভারেস্ট প্রিমিয়ার লিগে (ইপিএল), তখন প্রশ্নগুলো আরও বড় হয়ে ভিড় করছে। সবকিছু যে কর্মকর্তাদের ইচ্ছায় হয়েছে, তেমনটাই মনে করেন ক্রিকেট বিশ্লেষক নাজমুল আবেদিন ফাহিম, ‘বার বার শুনে আসছিলাম, বিশ্রামে থাকলেও তামিম কনফার্ম প্লেয়ার। তার বিশ্বকাপ দলে থাকা নিশ্চিত। কিন্তু যখন সে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিল, তখনই দেখলাম বাতাস বদলে গেল। কোন জায়গা থেকে দেখলাম না তাকে ফেরানোর চেষ্টা করা হলো। মনে হলো না তামিম খুব বড় পছন্দ ছিল। মনে হয়েছে টিম ম্যানেজমেন্ট যা চেয়েছে, তা পেয়েছে। তামিম নিজ থেকে সরে দাঁড়ানোয় মনে হয় তাদের (টিম ম্যানেজমেন্ট) ইচ্ছেরই প্রতিফলন ঘটেছে।’ আসলেই ঠিক। তামিম নিজেই ঘোষণা দিয়ে কোচ, নির্বাচকদের কাজটা সহজ করে দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যাট হাতে টপ অর্ডারে সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম ফর্মে নেই। তামিও দলে নেই। ঘরের মাঠে চেনা কন্ডিশনেই লিটন, সৌম্য, আফিফরা যেভাবে খাবি খেয়েছে, সেখানে আমিরাতে টি২০ বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে প্রতিপক্ষের বিশ্বসেরা সব বোলারদের বিপক্ষে না জানি কী অপেক্ষা করছে! হ্যাঁ, তামিম বল নষ্ট করেন, অনেকদিন টি২০তে নেই। কিন্তু তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যানের একজন। তার মতো অভিজ্ঞ কেউ অপরপ্রান্তে ক্রিজ আঁকড়ে থাকলেও অন্য প্রান্তে তরুণরা সাহস পায়। বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যানের স্ট্রাইকরেটই তো ধারাবাহিক টি২০ মানের নয়। তার ওপর বিশ্বকাপে ১৫ সদস্যের দলের সঙ্গে করোনার কারণে নিজেদের খরচে বাড়তি আরও তিন জন ক্রিকেটার নেয়ার সুযোগ আছে। সেখানে বাংলাদেশের টি২০ ইতিহাসের তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৭০১ রান ও দ্বিতীয় সর্বাধিক ৮ হাফ সেঞ্চুরির মালিকের কথা কারও মাথায় আসলো না। স্ট্রাইকরেটও কিন্তু সৌম্য-মুশফিকের চেয়ে ভাল! বিশ্বকাপে ব্যাটসম্যানরা খারাপ করলে, ওপেনাররা ব্যর্থ হলে তামিমের কথা আরও বেশি করে মনে পড়বে। উইন্ডিজ গ্রেট শিবনারায়ন চন্দরপল তো মনে করেন, টি২০ বিশ্বকাপে তামিম ইকবালকে ছাড়া ওমান, পাপুয়া নিউগিনিকেও হারাতে পারবে না বাংলাদেশ, পেরোতে পারবে না ‘রাউন্ড-১’! তামিম সর্বশেষ টি২০ খেলেছেন গত বছর মার্চে, শেষ মাঠে নেমেছিলেন গত জুলাইয়ে, জিম্বাবুইয়ে সফরে। এর পর তিনটি সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। ওপেনিংয়ে মোহাম্মদ নাইম, সৌম্য সরকার ও লিটন দাস সেভাবে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। ‘অনেক দিন টি২০ খেলার মধ্যে নেই। লম্বা বিরতির পর বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে খেলা ঠিক হবে না। আর এতদিন যারা দলের সঙ্গে ছিল তাদেরই সুযোগটা পাওয়া উচিত।’Ñ সরে দাঁড়ানোর ঘোষণায় তামিমের মূল বক্তব্য ছিল এটিই। কিন্তু তার কদিন পরই নেপালে এভারেস্ট প্রিমিয়িার লিগে (ইপিএল) খেলতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কাছে আবেদন করেন। অনুমোদন পেয়েও যান। ২৫ সেপ্টেম্বর শুরু হবে এ টুর্নামেন্ট। সামাজিক মাধ্যমে দেয়া টি২০ বিশ্বকাপ থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণায় প্রস্তুতির ঘাটতি, তরুণদের সুযোগ করে দেয়ার কথা জানালেও বিশ্বকাপের আগেই ফিট হওয়ার আশাবাদও ছিল তার কণ্ঠে। তবে তামিমের বক্তব্যের মতো পেছনের গল্পটা এত সরল নয়। যখন কোচ রাসেল ডোমিঙ্গো বলেন, ‘এখন দলে ১৭-১৮ জন ক্রিকেটার আছে। তাদের দিকেই আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ। তামিম ফিট হলে সেও আসবে এবং এটা নিয়ে আমি খুব বেশি ভাবিনি।’ তামিমের মতো একজন অভিজ্ঞ ওপেনার কোচের ভাবনার মধ্যেই নেই! এটা কেবল তামিম নয়, সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীদের পক্ষেও বিশ্বাস করা কঠিন। যে কারণে ন্যাটা ব্যাটসম্যানের জন্মশহর চট্টগ্রামে তাঁকে ফেরানোর জন্য মিছিল পর্যন্ত হয়েছে। তামিমের এভাবে সরে যাওয়া নিয়ে যেমন অনেক প্রশ্ন, তেমনি খোদ তামিমের প্রশ্ন বিশ্বকাপের প্রস্তুতি নিয়ে। মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে মন্থর ও টার্নিং উইকেটে অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ডকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। তাতে জয় ধরা দিলেও স্কিলের দিক থেকে বিশ্বকাপ প্রস্তুতি কতটা হয়েছে, সেই সংশয়ের অবকাশ থাকছে। ধারাভাষ্যকার ও সাবেক শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটার রাসেল আর্নল্ডের সঙ্গে ফেইসবুকে ‘চিলিং উইথ রাসেল’ শো-তে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ সম্ভাবনার প্রসঙ্গে উইকেটের প্রসঙ্গ তোনে তামিমও, ‘আমরা যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েছি। আমরা ম্যাচ জিতেছি, বড় দলগুলোকে হারিয়েছি। তবে আদর্শ হতো, যদি সত্যিই স্পোর্টিং উইকেটে কয়েকটি ম্যাচ খেলতে দেখতাম দলকে। কারণ, বিশ্বকাপে খেলা হবে ভিন্ন ব্যাপার।’ তিনি বলেন, ‘ম্যাচ জেতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আমি তাতে একমত। তবে যেহেতু এটা এত বড় একটা টুর্নামেন্টে, সামনের দুই সপ্তাহে (বিশ্বকাপে) যে ধরনের উইকেটে খেলতে হবে, সেসবের সঙ্গে মিল থাকলে ভাল হতো। বাংলাদেশ অনেক আত্মবিশ্বাস নিয়ে যাচ্ছে, যেটা প্লাস পয়েন্ট।’ বিশ্বকাপের মূল লড়াইয়ে যাওয়ার আগে প্রথম রাউন্ডে খেলতে হবে বাংলাদেশকে। সেখানে দুই গ্রæপের মধ্যে তুলনামূলক সহজ গ্রæপে পড়েছে বাংলাদেশ। তবে তামিমের মতে, এখানেও কাজটা হয়ে উঠতে পারে কঠিন। প্রথম বাধা আমাদের যে কোনভাবে পার হতে হবে, যেটা হলো বাছাইপর্ব (প্রথম রাউন্ড)। ওমান, স্কটল্যান্ডের মতো ছোট দলগুলো কখনও কখনও খুব ‘ট্রিকি’ হয়। টি২০ খেলা খুব ট্রিকি হতে পারে।’ সুপার-টুয়েলভ বা মূল পর্বের লড়াইয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের উইকেটের আচরণ বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন তামিম, ‘মূল বিশ্বকাপে গিয়ে কৌতূহল জাগানিয়া হবে, কোন ধরনের উইকেট পাওয়া যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, আইপিএল চলবে। উইকেটগুলো তাই ক্লান্ত থাকবে। স্পিনারদের যদি ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকে, আমরা অবশ্যই ভাল করব বলে আমি মনে করি। উইকেট ভাল থাকলে খুব চ্যালেঞ্জিং হবে।’ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দলের সম্ভাবনায় অবশ্য আরেকটি ব্যাপারও তামিমের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রায় ১৫ বছরের পথচলায় নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই তা তুলে ধরলেন তিনি,‘শুরুটা ভাল করতে হবে আমাদের। ইতিহাস বলে, শুরুটা ভাল করলে বাংলাদেশ গোটা টুর্নামেন্ট ভাল করে। শুরুটা ভাল না হলে সমস্যা।’ শোয়ে ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম অবশ্য ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে বড় কিছু করার স্বপ্নের কথা বলেছেন। টি২০ বিশ্বকাপ খেলতে আগামী ৩ অক্টোবর ওমানের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়বে টাইগারা। স্কটল্যান্ডের সঙ্গে প্রথম ম্যাচ ১৭ অক্টোবর। অপর দু’দল ওমান ও পাপুয়া নিউগিনি। রাউন্ড-১ এ প্রত্যাশিত সাফল্য এলে মিলবে আমিরাতে সুপার-১২এর টিকেট।
×