ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

চোর সিন্ডিকেট সক্রিয়

তেল চুরির জন্য সংক্ষিপ্ত পথে আসতে গিয়ে পদ্মা সেতুতে ফেরির ধাক্কা!

প্রকাশিত: ২৩:৩৮, ২৯ জুলাই ২০২১

তেল চুরির জন্য সংক্ষিপ্ত পথে আসতে গিয়ে পদ্মা সেতুতে ফেরির ধাক্কা!

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ ॥ ফেরি চলাচলের কোটি কোটি টাকার তেল ব্যয় হয়। এই তেল ব্যয়ের ব্যাপারে রয়েছে নানা রকমের কারসাজি। বহু দিন ধরেই শিমুলিয়ায় তেল চুরি সিন্ডিকেট সক্রিয়। চক্রটির হাত লম্বা। তেল চুরির ভাগ চলে যায় অনেক উপরের কর্মকর্তাদেরও হাতে। তাই যুগ যুগ ধরে এই তেল চুরি চলছেই। আধুনিক ভিটিএস যন্ত্র ব্যবহার না করাও এর একটি কারণ। এক শ্রেণীর কর্মকর্তার অবৈধ আয়ের অন্যতম উৎস এই তেল চুরি। গত ২৩ জুলাই রো রো ফেরি শাহজালাল পদ্মা সেতুর ১৭ নম্বর খুঁটিতে ধাক্কার ঘটনাটি নানাভাবে আলোচিত। তেল সাশ্রয়ের জন্য কম গতিতে এবং সহজ পথে আসতে গিয়েই দুর্ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ উঠেছে। সাশ্রয় করা তেলই বাইরে বিক্রি করা হয়। এর নেপথ্যে তেল চুরিই বিষয়টিই আলোচিত হচ্ছে। তবে বিআইডবিøউটির চেয়ারম্যান সৈয়দ তাজুল ইসলাম বলেন, চুরি হয় সত্য। তবে শাহজালাল ফেরির দুর্ঘটনা তেল চুরি জন্য নয়। এদিকে বুধবার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব রফিকুল ইসলাম খানকে প্রধান করে উচ্চ পর্যায়ের আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার এ কমিটির ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার কথা রয়েছে। এই কমিটি আরও চমকপ্রদ ঘটনা বের করে আনবেন এমনটিই সংশ্লিষ্ট অনেকের মধ্যে আলোচনা চলছে। বিআইডবিøউটিসির সহ-মহাব্যবস্থাপক (মেরিন) আহম্মদ আলী জনকণ্ঠকে জানান, প্রতিটি ফেরিরই তিন সদস্যের একটি একটি টাইম নির্ধারণ করে তেল বরাদ্দ দেয়। রো রো ফেরি শাহ পরাণের বাংলাবাজার থেকে শিমুলিয়া আসার জন্য সময় নির্ধারণ করা ৫৫ মিনিটি এবং তেল বরাদ্দ ১০৮ লিটার। শিমুলিয়া থেকে বাংলা বাজার যাওয়া জন্য ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটে ২২১ লিটার বরাদ্দ রয়েছে। তেলের দায়িত্বে থাকা বিআইডবিøউটিসির নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ রুবেলুজ্জামান জানান, শাহজালাল ফেরিটিও শাহ পরাণের ক্যাটাগরির। তবে রো রো ফেরি শাহজালাল পাটুরিয়া থেকে ১৯ জুলাই শিমুলিয়া আসে। এই অল্প সময়ে ফেরিটির টাইম এবং তেলের পরিমাপ সেটেল করা হয়নি। তাই তেল চুরির বিষয়টি যৌক্তিক নয়। সহ-মহাব্যবস্থাপক (মেরিন) আহম্মদ আলী জানান, গত ৩ জুন থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত সেতু কর্তৃপক্ষ পদ্মা সেতুর ১৪ থেকে ২১ খুঁটি দিয়ে চলাচলের জন্য নির্ধারণ করে। সেই অনুযায়ী বিআইডবিøউটিএ মার্কিং করে দেয়। তবে দুর্ঘটনার পর প্রবল ¯্রােতের কারণে ২৫ জুলাই থেকে সেতুর ৫ নম্বর খুঁটি থেকে ১২ নম্বর খুঁটি পর্যন্ত নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এখন ফেরি সেই অনুযায়ী চলছে। রো রো ফেরি শাহ পরাণের মাস্টার শামসুল আলম জনকণ্ঠকে জানান, ফেরি কোন কোন সময় একটু বেশি লাগে আবার কখনও সময় একটু কম লাগে। কম লাগলে তেল কম খরচ হয়। তবে হিসাবেই মধ্যেই থাকে। এগুলো রেজিস্টার মেনটেন করা হয়। প্রতি মাসে এই ফেরি রুটে সংস্থাটির কোটি কোটি টাকা আয় ব্যয় রয়েছে। বিআইডবিøউটিসির সহ-মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মোঃ শফিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, গত মে মাসে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার রুটে ফেরিগুলো ৪ হাজার ৫৭০টি ট্রিপ দিয়ে আয় করেছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। আর তেল খরচ হয়েছে ২ কেটি ৬৮ লাখ ৫০ হাজার টাকার। গত জুন মাসে ৬ হাজার ৪৫২টি ট্রাক, ২৫ হাজার ৩৬৯টি বাস এবং ৭৪ হাজার ৯৫টি ছোট যান পারাপার করেছে। ফেরিগুলো ট্রিপ দিয়েছে ৪ হাজার ৬১৬টি। এতে আয় হয়েছে ১১ কোটি ২০ লাখ ৯৫ হাজার ২৮৯ টাকা। তবে এই মাসের তেল খরচ তাৎক্ষণিক তিনি জানাতে পারেননি। তেলে হিসাব অডিট হয়ে তার কাছে কিছুটা বিলম্ব হয় বলে তিনি জানান। তবে তেলের দায়িত্বে থাকা বিআইডবিøউটিসির নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ রুবেলুজ্জামান তথ্য না দিয়ে নানা কৌশলে এগিয়ে যান। তেল চুরি সিন্ডিকেটের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততার আঙ্গুল তুলছেন অনেকে। তবে এই নির্বাহী প্রকৌশলী অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। পদ্মা সেতুর পিলারে ফেরির ধাক্কার ঘটনায় মাস্টার ও সুকানিকে দায়ী করেছে তদন্ত কমিটি। অভিযোগ উঠেছে- তবে কেন তাঁরা নিয়মিত পথে না গিয়ে পদ্মা সেতুর ১৬ ও ১৭ নম্বর পিলারের মধ্য দিয়ে সংক্ষিপ্ত পথ বেছে নিয়েছিলেন? তেল চুরিই কী উদ্দেশ্য ছিল কীনা মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি তাও তদন্ত করবে। তবে বিআইডবিøউটিসি এ ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের কমিটি বিষটি এগিয়ে গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেরিটি সম্প্রতি মেরামত করা হয় এবং সেটি পুরোপুরি চলাচল উপযোগী ছিল। পদ্মায় চলাচলরত নৌযানগুলো বাংলাবাজার ঘাট থেকে এসে মাগুরখÐে মূল পদ্মা নদীতে বেরিয়ে কিছুটা উজানে পাড়ি দিয়ে সেতুর ৬ থেকে ১৩ নম্বর পিলারের মধ্য দিয়ে পার হয়। সেখানে এই ফেরি উজানে না গিয়ে স্রোতের অনুকূলে গিয়ে সেতুর ১৬ ও ১৭ নম্বর পিলারের মধ্য দিয়ে যেতে চায়। তীব্র স্রোতের মধ্যে ফেরির গতি কম থাকায় সেটি সেতুর পিলারে আঘাত হানে। এর আগে শাহ মখদুম নামের একটি ফেরি পদ্মা সেতুর ১৬ নম্বর পিলারে ধাক্কা দেয়। এ বিষয়ে ফেরিটির মাস্টার আমির হোসেনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে বলেও জানা যায়। বিআইডবিøউটিসি ফেরি বা জাহাজের গতিবেগ ও কোন পথে জাহাজ চলছে সেটা মনিটরিং করার জন্য ভ্যাসেল ট্র্যাকিং সিস্টেম (ভিটিএস) পদ্ধতি স্থাপন করা হয়েছিল। ভিটিএস পদ্ধতিতে চলাচলের দূরত্ব পরিমাপ ও জাহাজের গতির নির্ণয় করে সেই অনুযায়ী তেল বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হয়। পাশাপাশি জাহাজের গতিবিধিও মনিটরিং করা সম্ভব। ২০১৩ সালের মে মাসে ঘটা করে ভিটিএস প্রযুক্তির উদ্বোধন করা হলেও তা কখনই পুরোপুরি মনিটরিং করা হয়নি। এমনকি নানা অজুহাতে মাসিক বিল পরিশোধ না করে এক পর্যায়ে এ প্রযুক্তির ব্যবহার অকার্যকর করে দেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে তেল চুরি নির্বিঘœ করতে ভিটিএস পদ্ধতি এখন অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে। নানা অজুহাতে বর্তমানে পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে আছে প্রযুক্তিটি। ফেরি ও জাহাজে তেল বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে। অভিযোগ রয়েছে, দূরত্ব, গতিবেগ ও স্রোত বিবেচনায় বিপুল পরিমাণ তেল বরাদ্দ দেয়া হলেও সেই অনুযায়ী ফেরি ও জাহাজ চালানো হয় না। এভাবে বরাদ্দের তেল বাঁচিয়ে তা গোপনে বিক্রি করে দেন সংশ্লিষ্টরা। তেল চুরির টাকা সংস্থাটির বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েক কর্মকর্তার পকেটে যায়। সর্বশেষ এ ঘটনার প্রমাণ মিলেছে বাংলাবাজার-শিমুলিয়া রুটে চলাচলকারী রো রো ফেরি শাহজালালের ক্ষেত্রে। নির্ধারিত গতির চেয়ে কম গতিতে এবং সংক্ষিপ্ত পথে চলতে গিয়ে ওই ফেরিটি পদ্মা সেতুর ১৭ নম্বর পিলারে আঘাত করে। যদিও স্রোত বৃদ্ধি ও পদ্মা সেতুর পিলার নিরাপদ রেখে নির্দিষ্ট দূরত্বের বাইরে চলাচলের জন্য সর্বশেষ গত ৪ জুলাই এ রুটের সব ফেরির তেল বরাদ্দ বাড়ানো হয়। নাম প্রকাশ না কারার শর্তে বিআইডবিøউটিসির এক দায়িত্বশীল বলেন, প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত তেল বরাদ্দ দেয়া হয়। আবার নৌযান পরিচালনার সময় যেই গতি ও দূরত্ব অনুযায়ী তেল নেয়া হয় তার চেয়ে কম গতি ও দূরত্বে চলাচল করে। এভাবে তেল বাঁচিয়ে তা পরিবহন ঠিকাদারের মাধ্যমে গোপনে বিক্রি করে দেয়। এরপরও নানা অজুহাত দেখিয়ে তেল বরাদ্দের হার বাড়ানো হয়। বিআইডবিøউটিসির চেয়ারম্যান সৈয়দ তাজুল ইসলাম বলেন, মাস্টার এবং সুকানির অবহেলার কারণেই আসলে গেল গত শুক্রবার ফেরি শাহজালাল পদ্মা সেতুর খুঁটিকে ধাক্কা দেয়। তেল চুরির যে অভিযোগ করা হচ্ছে এটা অনেক কঠিন একটা বিষয়। এটা সব জায়গায়ই কিছু না কিছু হয়। তেল চুরির বিষয়টা আমরা একেবারে অস্বীকার করছি না। কিন্তু সেজন্য আমাদের জাতীয় সম্পদ আমাদের প্রাণের সেতু পদ্মা সেতু ধ্বংস করে ফেলবে এমন তো হতে পারে না। দুর্ঘটনাটা শুধু মাস্টার আর সুকানির অসর্তকতার জন্যই হয়েছে। এজন্য ফেরি শাহজালালের মাস্টার ও সুকানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এখন বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, তেল চুরির বিষয়টি যেহেতু আমাদের নলেজে এসেছে, আমরা চেষ্টা করছি বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে। আমরা ভিটিএস যন্ত্র বসাব। সে বিষয়ে আলোচনা চলছে। এর আগেও ভিটিএস প্রযুক্তি বসানো হয়েছিল। এটি পুরোপুরি কার্যকরভাবে কাজ করছে না। এখন আমরা সিরিয়াসলি এটা দেখছি। তেল তিনি বলেন, যেসব সংস্থার যানবাহন চলাচল করে সেসব সংস্থায় কমবেশি তেল চুরি হয়। স্রোত বৃদ্ধিসহ নানা অজুহাতে তেলের বরাদ্দ বাড়িয়ে থাকে এ বিআইডবিøউটিসি। সবশেষ গত ১৪ জুলাই এক আদেশে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়াসহ অন্যান্য রুটের ফেরির তেল বরাদ্দ বাড়ানো হয়। ওই আদেশ গত ১৪ জুলাই জারি করা হলেও তা কার্যকর দেখানো হয় ৪ জুলাই থেকে। আরও জানা গেছে, গত ২ জুলাই সংস্থাটির মাওয়া বাণিজ্যিক কার্যালয় থেকে এক বেতার বার্তায় স্রোত ও পদ্মা সেতুর পিলারের নিরাপত্তার কারণে বেশি দূরত্ব দেখিয়ে তেল বরাদ্দের আবেদন পাঠানো হয় সদর দফতরে। ওই চিঠির প্রেক্ষিতে গত ৬ জুলাই তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে সংস্থাটির ফুয়েল সেল। ওই কমিটি ৭ জুলাই মাঠপর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করে ৮ জুলাই প্রতিটি ফেরিতে তেল বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ করে। একই দিন আরেক প্রতিবেদনে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে চলাচলকারী ফেরির তেল বরাদ্দ বাড়ানোরও সুপারিশ করা হয়। পরে দুই রুটেই তেল বরাদ্দ বাড়ানো হয়। এতে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার রুটে চলতে ফেরি শাহ মখদুমের জ্বালানি ১৩৪ লিটার থেকে বাড়িয়ে ২১৫ লিটার করা হয়েছে। ফেরি এনায়েতপুরী ও শাহপরাণের তেলের বরাদ্দ প্রতি ট্রিপে ১৩৭ লিটার থেকে বাড়িয়ে ২২১ লিটার করা হয়েছে। একইভাবে অন্যান্য ফেরির তেলের বরাদ্দ বাড়ানো হয়। রো রো ফেরিতে দুটি ইঞ্জিন থাকে। দুটি ইঞ্জিন গড়ে ৫০০ আরপিএমে চলবে-এমন শর্তে এ তেল বরাদ্দ দেয়া হয়। ভিটিএস তথা ফেরি বা জাহাজের গতিবেগ ও কোন পথে চলছে তা মনিটরিং করার জন্য ভ্যাসেল ট্র্যাকিং সিস্টেম। এ পদ্ধতিতে চলাচলের দূরত্ব পরিমাপ ও জাহাজের গতির নির্ণয় করে সেই অনুযায়ী তেল বরাদ্দ হওয়ার কথা। পাশাপাশি জাহাজের গতিবিধিও মনিটরিং করা সম্ভব। সেটি কেন কার্যকর হচ্ছে না এটিই প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের।
×