গৌতম পান্ডে ॥ আবদুল জব্বার খান পরিচালিত ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট। এর আগে এই ভূখণ্ডে বাংলা ভাষায় আর কোন পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র হয়নি। পঞ্চাশের দশকে মঞ্চনাটকে অভিনয়ের জন্যও নারী শিল্পী পাওয়া ছিল কঠিন। তখন চলচ্চিত্র নির্মাণের মতো স্টুডিও বা সুযোগ-সুবিধা ঢাকায় ছিল না। পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ডাকাতির খবরকে উপজীব্য করে ‘ডাকাত’ নামে একটি নাটক লিখেছিলেন আবদুল জব্বার খান। সেই কাহিনীকেই চলচ্চিত্রের রূপ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
চলচ্চিত্রটি প্রযোজনায় এগিয়ে আসে ইকবাল ফিল্মস। পরিচালক আব্দুল জব্বার শুরুতে ভেবেছিলেন, কোন পুরুষকেই নারী সাজিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে দেবেন। তখন মঞ্চনাটকে নারী চরিত্রে পুরুষদের অভিনয়ের চল ছিল। পরে ‘মুখ ও মুখোশ’র অভিনেত্রী খুঁজতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন আবদুল জব্বার খান। চিত্রালী ম্যাগাজিনে সেই বিজ্ঞাপন দেখেই নবাব কাটরায় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইকবাল ফিল্মসের অফিসে যান ইডেন কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী জহরত আরা আর তার বান্ধবী পিয়ারী বেগম।
বাংলাদেশের প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’র অভিনেত্রী সেই জহরত আরা আর নেই (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। ১৯ জুলাই লন্ডনের একটি কেয়ার হোমে তার মৃত্যু হয় বলে তার পারিবারিক বন্ধু ফেরদৌস রহমান জানান। ফেরদৌস বলেন, আশি বছরের বেশি বয়সী জহরত আরা দীর্ঘদিন ধরে নানা স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছিলেন। পরিবারের বরাত দিয়ে ফেরদৌস রহমান বলেন, কেয়ার হোমে যাওয়ার আগে জহরত আরা থাকতেন নরউইচে, সেখানেই তাকে দাফন করা হবে। এ বিষয়ে বিস্তারিত পরে জানাবে তার পরিবার।
পূর্ব পাকিস্তানের তখনকার গবর্নর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ‘মুখ ও মুখোশ’ সিনেমার উদ্বোধন করেছিলেন। এর ঠিক চার বছর আগে ১৯৫২ সালে মায়ের ভাষার দাবিতে বাঙালীর সংগ্রাম তুঙ্গে পৌঁছায়। ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তে রাঙানো পথ ধরে ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায় বাংলা। পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালীদের ক্ষোভ তখন ধীরে ধীরে বাড়ছিল। তখনকার পাকিস্তানী চলচ্চিত্র শিল্পে বাঙালী টেকনিশিয়ান ও কর্মীরাও হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। কারণ দেশভাগের কারণে বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল কলকাতা। সিনেমা নির্মাণে তারা এগিয়ে যাচ্ছিল। সেই প্রেক্ষাপটেই যাত্রা শুরু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের। ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রে অভিনেতা মনসুর আলীর স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেন জহরত আরা।
পুরান ঢাকার মেয়ে জহরতের ভাই মোসলেহ উদ্দীন ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক, ভাবি নাহিদ নিয়াজীও সঙ্গীত শিল্পী। চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াত জানান, বেতারে নাটকের অভিজ্ঞতা আগে থেকেই ছিল জহরতের। একজন এ্যাথলেট হিসেবেও তিনি পরিচিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলনেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন।
জহরত আর পিয়ারী দুজনেই সিনেমার জন্য নির্বাচিত হলেন। কিন্তু পরিবারের আপত্তির মুখে তারা অভিনয় করতে পারবেন কিনা, সেই শঙ্কা ছিল।
জহরত আরা ছিলেন নাছোড়। পরিচালক আব্দুল জব্বার খান অনুনয়বিনয় করে তাদের পরিবারকে রাজি করিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত। ‘মুখ ও মুখোশ’র নায়িকা কুলসুমের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য এগিয়ে এলেন চট্টগ্রামের মেয়ে কলকাতার অভিনেত্রী পূর্ণিমা সেনগুপ্ত। নায়ক আফজালের চরিত্রে আব্দুল জব্বার খান নিজেই অভিনয় করেন। পিয়ারী অভিনয় করেন নায়ক আফজালের বোন রাশিদার চরিত্রে। অসৎ পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে ছিলেন অভিনেতা আলী মনসুর। আর তার স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেন জহরত আরা। ডাকাত সর্দারের ভূমিকায় ছিলেন ইনাম আহমেদ।
১৯৫৪ সালে ৬ আগস্ট শাহবাগ হোটেলে ‘মুখ ও মুখোশ’ সিনেমার মহরত হয়। মহরতে বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলেন জহরত আরা। কালীগঞ্জ, সিদ্ধেশ্বরী, কমলাপুর (বাসাবো) বৌদ্ধ বিহারের পুকুরপাড়, মিরপুর ও তেজগাঁওয়ের জঙ্গল, রাজারবাগ ও লালমাটিয়ার ধানক্ষেত এবং টঙ্গীতে সিনেমার শূটিং হয়। ৬৪ হাজার টাকা ব্যয়ে ১৯৫৫ সালের ৩০ অক্টোবর শেষ হয় দৃশ্যধারণ। ১৯৫৬ সালের আগস্টে ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পাওয়ার পর দেশজুড়ে হইচই পড়ে যায়। জহরত আরার অভিনয় দর্শকমহলে প্রশংসা পায়। তবে পরে আর কোন চলচ্চিত্রে তাকে দেখা যায়নি। জহরত বিয়ে করেন সরকারী কর্মকর্তা ডেভিড খালেদ পাওয়ারকে। চার দশকেরও বেশি আগে তারা লন্ডনে থিতু হন। জহরত আরার বাবা ইমামউদ্দিন পাটোয়ারি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মী। বাবা-মায়ের স্মৃতির উদ্দেশে জহরত প্রতিষ্ঠা করেন ইমামউদ্দিন ও বেগম আসমাতুন্নেসা ফাউন্ডেশন।
এ ফাউন্ডেশনের অধীনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বৃত্তিও দেয়া হতো। পুরান ঢাকার মেয়ে জহরতের ভাই মোসলেহ উদ্দীন ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক, ভাবি নাহিদ নিয়াজীও সঙ্গীত শিল্পী। চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াত জানান, বেতারে নাটকের অভিজ্ঞতা আগে থেকেই ছিল জহরতের। একজন এ্যাথলেট হিসেবেও তিনি পরিচিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলনেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন।