ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বনলতা সেন ॥ প্রকৃতি ও রোমান্টিকতায় অবগাহন

প্রকাশিত: ০০:২৪, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বনলতা সেন ॥ প্রকৃতি ও রোমান্টিকতায় অবগাহন

কবি জীবনানন্দ দাশের (জন্ম : বরিশাল, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯-মৃত্যু: কলকাতা, ২২ অক্টোবর, ১৯৫৪) অন্যতম কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে, ‘বনলতা সেন’ (১৯৪২)। এ কাব্যগ্রন্থে ৩০টি কবিতা রয়েছে। বনলতা সেন ও সুরঞ্জনার মতো রোমান্টিকপ্রধান কবিতা আছে এ গ্রন্থে। ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে পঠিত ও একইসঙ্গে জনপ্রিয় কবিতা। হায় চিল, বেড়াল, শিকার, ঘাস, বুনো হাঁস, নগ্ন নির্জন হাত, হরিণেরা প্রভৃতি শিরোনামীয় হতাশা ও রহস্যময় কবিতাগুলো পাঠকের মনে আলোড়ন তোলে। শ্যামলী, সুদর্শনা, মিতভাষণ কবিতায় নারীর ছবিতে অপ্রাপ্তির নিখুঁত ছবি এঁকেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। ধানকাটা হয়ে গেছে, অঘ্রাণ প্রান্তরে, শিরীষের ডালপালা কবিতায় প্রকৃতির রূপবর্ণনা পাওয়া যায়। এসব কবিতায় কবির বিভিন্ন ইন্দ্রিয়জাত অনুভূতিগুলোর শক্তিশালী দিকগুলো ফুটে উঠেছে। স্বপ্নের ধ্বনিরা, পথ হাঁটা, আমাকে তুমি, সুচেতনা কবিতায় সভ্যতা-ঘিরে কবির ভাবনা, হিসাবের লেনদেন অনুধাবন করা যায়। হাওয়ার রাত, অন্ধকার, দু’জন, কমলালেবু, আমাকে তুমি, অবশেষে, তুমি, হাজার বছর শুধু খেলা করে, সবিতা কবিতায় জীবনের জটিল হিসাব-নিকাশ চিত্রায়িত হয়েছে। বলে রাখি, উল্লিখিত কবিতায় তুলে ধরা দিকগুলো প্রধান বার্তা; অনেক কবিতায় একইসঙ্গে অন্যান্য বিষয়াদিও উঠে এসেছে। কিটসের সৌন্দর্যমাখা আর ওয়ার্ডওয়ার্থের প্রকৃতিবর্ণনা ধরা দেয় জীবনানন্দের কবিতায়। জন কিটস লিখেছেন, ‘ঝড় ও ংঃৎধরমযঃধিু নবমধহ ঃড় ঢ়ষঁপশ ধ ঢ়ড়ংবু/ঙভ ষীঁঁৎরবং নৎরমযঃ, সরষশু ংড়ভঃ ধহফ ৎড়ংুৃ’-(ও ংঃড়ড়ফ ঞরঢ়ঃড়ব)। জীবনানন্দ দাশ কম কী লিখলেন? দেখি কিছু কবিতাংশ- (১) ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,/মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর/হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা/...সব পাখি ঘরে আসে- সব নদী ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;/থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’-(বনলতা সেন) (২) ‘শ্যামলী, তোমার মুখ সেকালের শক্তির মতন:/যখন জাহাজে চড়ে যুবকের দল/... তোমার মুখের দিকে তাকালে এখনও/আমি সেই পৃথিবীর সমুদ্রে নীল,/দুপুরের শূন্য সব বন্দরের ব্যথা,/বিকেলের উপকণ্ঠে সাগরের চিল,/নক্ষত্র, রাত্রির জল যুবাদের ক্রন্দন সব/শ্যামলী, করেছি অনুভব।’-(শ্যামলী) কিটসের ‘অ নৎরমযঃ ঃড়ৎপয, ধহফ ধ পধংবসবহঃ ড়ঢ়ব ধঃ হরমযঃ,/ঞড় ষবঃ ঃযব ধিৎস খড়াব রহ!’-(ঙফব ঃড় চংুপযব)- যেন জীবনানন্দের: ‘একদিন মনে হতো জলের মতন তুমি।/সকালবেলার রোদে তোমার মুখের থেকে বিভা/অথবা দুপুরবেলা-বিকেলের আসন্ন আলোয়/চেয়ে আছে- চলে যায়- জলের প্রতিভা।/...তোমার বুকের পরে আমাদের পৃথিবীর অমোঘ সকাল;/তোমার বুকের পরে আমাদের বিকেলের রক্তিল বিন্যাস;/তোমার বুকের পরে আমাদের পৃথিবীর রাত;/নদীর সাপিনী, লতা, বিলীন বিশ্বাস।’-(তোমাকে) অঘ্রান-কার্তিক কবির প্রিয় সময়। বিভিন্ন উপকরণে প্রকৃতি ধরা দিয়েছে বিভিন্নরূপে। চিল-হরিণ-জোনাকি-বেড়াল-বাদুড়, চাঁদ-নক্ষত্র-আকাশ-সাগর-নদী, ডানা-লতা-ঠাং-শরীর-পালক, ঘ্রাণ-ঘুম-নির্জনতা, হিজল-ঝাউবন, লেবু-আমলকি-দেবদারু, পাতা-ঘাস-ধান, বালি-শিশির-হাওয়া-রোদ-জ্যোৎস্না, ঝড় ঢেউ, নীল-সবুজ হলুদ, মুখোমুখি-স্তব্ধতা-অন্ধকার-নগ্ন-শাঁই শাঁই শব্দ, রূপালি ইত্যাদি ধরা দিয়েছে জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে। এসব শব্দাবলি ও এরকমই একার্থক শব্দাবলির বারংবার ব্যবহার লক্ষ্য যায়। এগুলো প্রতীকী হিসাবেও ধরে নেওয়া যায়। নগ্ন, অন্ধকার যেমন হতাশার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে তেমনই হিজল-ঝাউবন প্রকৃতি বা সৌন্দর্যের প্রতিনিধি। আবার স্ফটিক, নীল আকাশ ইত্যাদি জীবন-মনের উদারতা ও উজ্জ্বল্য প্রকাশিত হয়েছে। কিছু কবিতাংশ তুলে ধরি- (১) ‘ধান কাটা হয়ে গেছে কবে যেন- ক্ষেত মাঠে পড়ে আছে খড়/পাতা কুটো ভাঙা ডিম- সাপের খোলস নীড় শীত।/এই সব উৎরায়ে ঐ খানে মাঠের ভিতর/ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ-কেমন নিবিড়।/ঐ খানে একজন শুয়ে আছে- দিনরাত দেখা হত কত কত দিন/হৃদয়ের খেলা নিয়ে তার কাছে করেছি যে কত অপরাধ;/শান্তি তবু: গভীর সবুজ ঘাস ঘাসের ফড়িং/আজ ঢেকে আছে তার চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ।’-(ধান কাটা হয়ে গেছে) (২) ‘কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয়/পৃথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেলা;/কাঁচা বাতাবীর মতো সবুজ ঘাস- তেমনি সুঘ্রাণ-/হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে!/আমারো ইচ্ছে করে এই ঘাসের এই ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো/ গেলাসে-গেলাসে পান করি,/এই ঘাসের শরীর ছানি-চোখে ঘষি/ঘাসের পাখনায় আমার পালক,/ঘাসের ভিতর ঘাস হয়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার/শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে।-(ঘাস) (৩) ‘পেঁচার ধূসর পাখা উড়ে যায় নক্ষত্রের পানে-/জলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে চাঁদের আহবানে/বুনো হাঁস পাখা মেলে- শাঁই শাঁই শব্দ শুনি তার;/এক-দুই-তিন চার-অজস্র-অপার-/রাত্রির কিনার দিয়ে তাহাদের ক্ষিপ্র ডানা ঝাড়া/এঞ্জিনের মতো শব্দে; ছুটিতেছে-ছুটিতেছে তারা।/তারপর পড়ে থাকে, নক্ষত্রের বিশাল আকাশ,/হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ-দু-একটা কল্পনার হাঁস;/মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা স্যানালের মুখ।’-( বুনো হাঁস, স¤পূর্ণ) ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতা সভ্যতার সঙ্কট নিয়ে। নারী যেমন সৃষ্টি করে তেমনই ভাঙ্গনও ধরাতে পারে। সুন্দরের মধ্যে অসুন্দর বিরাজমান। ধনীর পাশাপাশি গরিবও রয়েছে। ফকিরের আত্মকথনও তুলে ধরা হয়েছে ‘ভিখিরী’ কবিতায়। কবি জীবনানন্দের বোধও এখানে সক্রিয়। কখনও তিনি প্রতীকী হিসেবে অন্যকিছু ব্যবহার করে নিয়েছেন। সেক্ষেত্রে পাঠককে বুঝে নিতে হবে। এমন কিছু কবিতাংশ তুলে ধরলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে- (১) ‘একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি আহিরীটোলায়,/একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি বাদুড়বাগানে,/একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো/তবে আমি হেঁটে চ’লে যাবো মানে মানে।/বলে সে বাড়ায়ে দিলো অন্ধকারে হাত।/...একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো/তাহলে ঢেঁকির চাল হবে কলে ছাঁটা।/বলে সে বাড়ায়ে দিলো গ্যাসলাইটে মুখ।’-( ভিখিরী) (২) ‘শিরীষের ডালপালা লেগে আছে বিকেলের মেঘে,/পিপুলের ভরা বুকে চিল নেমে এসেছে এখন;/বিকেলের শিশুসূর্যকে ঘিরে মায়ের আবেগে/করুণ হয়েছে ঝাউবন।/নদীর উজ্জ্বল জল কোরালের মতো কলবরে/ভেসে নারকোলবনে কেড়ে নেয় কোরালীর ভ্রƒণ:/বিকেল বলেছে এই নদীটিকে: শান্ত হতে হবে’।-( শিরীষের ডালপালা) (৩) ‘তোমার সৌন্দর্য নারী, অতীতের দানের মতন।/মধ্যসাগরের কালো তরঙ্গের থেকে/ধর্মাশোকের ¯পষ্ট আহ্বানের মতো/আমাদের নিয়ে যায় ডেকে/...মানুষের সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি আসে;/বড় বড় নগরীর বুকভরা ব্যথা;/ক্রমেই হারিয়ে ফেলে তারা সব সঙ্কল্প-স্বপ্নের/উদ্যমের অমূল্য ¯পষ্টতা।’-(মিত ভাষণ) (৪) ‘কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;/...ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু,/দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত/ভাই বোন বন্ধু পরিজন পড়ে আছে/;পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;/মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।/...আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুশিয়াসের মতো আমাদেরও প্রাণ/মূক করে রাখে; তবু চারিদিকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান।’-(সুচেতনা) ‘হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে/তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে-উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!/তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে!/...আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে/বেদনা জাগাতে ভালোবাসে...’-(হায় চিল)। এমন অনেক কবিতা জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন। ‘বনলতা সেন’ কাব্যে এমন কিছু অলংকারিক-চিত্রকল্পে নির্মাণের বেশ কিছু কবিতা আমরা পাই। কবির ইন্দ্রিয়গত সক্রিয়তা লক্ষ্য করার মতো। ইন্দ্রিয়জাত চিত্রকল্প; যেমন বিভিন্ন রঙ, গন্ধ ও দৃশ্যের বর্ণনা, পাঠককে মোহিত করে, আনন্দ দেয়।
×