ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দক্ষ সংগঠকের অভাবে বেহাল হকি

প্রকাশিত: ২৩:৫৬, ১৩ জানুয়ারি ২০২১

দক্ষ সংগঠকের অভাবে বেহাল হকি

বাংলাদেশে হকি খেলা এখনও টিকে আছে কিছু সহজাত প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের কারণে। অন্যথায় হকিস্টিকগুলো ব্যবহৃত হতো চুলার লাকড়ি অথবা গুণ্ডা-মাস্তানদের অস্ত্র হিসেবে। তা না হলে সেই কতদিন থেকে সংগঠকদের দলাদলি আর চেয়ার নিয়ে টানাটানি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে হকিস্টিক শোভা পেত ঐ মাস্তানদের হাতেই। বলতে গেলে হকি ফেডারেশনের সাংগঠনিক দুর্বলতা শুরু সেই ১৯৯৫-৯৬ থেকে, পোড় খাওয়া সংগঠক দীর্ঘদিন হকির হাল ধরে থাকা শামসুল বারি, জহিদুর রহমান পুশকিনসহ একঝাঁক নিবেদিত সংগঠকদের বিদায়ের পর। তারপরও বেশ কিছু বছর ভালই চলছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সংগঠকদের রেষারেষি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, সরকার, মন্ত্রী এবং অনেক শক্তিশালী ব্যক্তির হস্তক্ষেপেও তাদের এক করে হকির উন্নয়নে ফেরানো যায়নিÑ এমনকি তাদের দলবাজি এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, লীগ বর্জনের ঘটনাও শুরু হয়। পথ প্রদর্শকদের বা অভিভাবকদের এমন কোন্দলের মাঝেও ঐ সহজাত প্রতিভাবান খেলোয়াড় আছে বলেই কোনক্রমে টিকে আছে হকি। স্বল্পসময়ে এবং সীমিত সুযোগ-সুবিধা ও স্বল্প পরিচর্যায় মধ্যেই অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টগুলোতে শক্তিশালী দলগুলোর চোখে চোখ রেখে ফাইট করার সাহস দেখায় বাংলাদেশ দল এসব খেলোয়াড়দের জন্য। কিন্তু এমন সাংগঠনিক দৈন্যদশা ও বিতর্কিত অবস্থায়ও অনেক বাঘা বা শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে অবিশ্বাস্য ফলাফল করছে দল। বিশেষ করে বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টগুলোতে সাফল্য চোখে পড়ার মতো । কিন্তু এভাবে আর কতদিন। কী ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে দেশের হকির। অথচ হকিই ছিল একসময় দেশের দ্বিতীয় জনপ্রিয় খেলা। গ্যালারি ঠাসা দর্শক দেখা যেত শুধু আন্তর্জাতিক নয়, স্থানীয় বা ঘরোয়া আসরে বড় দলগুলোর খেলায়। গ্যালারি টইটম্বুর থাকতো দর্শকে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য দীর্ঘদিন থেকে ফেডারেশন লীগটাই নিয়মিত মাঠে গড়াতে পারছে না। চেয়ারটাকে লক্ষ্যে স্থির রেখে চলছে চালবাজি আর ঠাণ্ডা গরম লড়াই। তাদের তো আর হকির উন্নয়ন নিয়ে ভাববার ফুরসত নেই। বেশ কয়েক বছর পূর্বে কিছু সংখ্যক সংগঠক ‘বাঁচাও হকি’ ব্যানারে একটা সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। কিন্তু ঐটুকুই তৎপরতা। এতে কি হকি ভালভাবে বেঁচে আছে? বলতে হবে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছে। দেশের জনপ্রিয় খেলা হকির সাম্প্রতিক হালচাল নিয়ে এই কথাগুলো বলেন সাবেক তারকা খেলোয়াড় রফিকুল ইসলাম কামাল। হকির স্বর্ণযুগের অন্যতম তারকা কামাল যারা দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন দেশময়। কামাল বর্তমানে একজন সংগঠকও বটে। তাই খেলোয়াড় এবং সংগঠক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই কথা বলেছেন- হকির এ অধঃগতির কারণ এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে। একসময়ের দুরন্ত গতির চৌকস এ খেলোয়াড় বলেন, ঘরোয়া লীগ ও বিভিন্ন টুর্নামেন্ট যা খেলোয়াড় তৈরির প্রকৃত জায়গা। ‘আসলে দেখেন হকি লীগ নিয়মিত নেই, বছরে দু’একটা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়। ঢাকার বাইরে কোন প্রকার লীগ বা টুর্নামেন্ট নেই, ট্যালেন্ট হান্ট পরিকল্পনা নেই। এসব ঘরোয়া প্রতিযোগিতা ও কার্যক্রম না থাকলে হকির উন্নয়ন প্রশ্নাতীত।’ দেশের হকির অন্যতম এ তারকা এক্ষেত্রে সাংগঠনিক দুর্বলতাকেই দেখছেন বড় করে- ‘হকির উন্নয়নে যারা কাজ করেন সেই সংগঠকদের মধ্যে অন্তর্কলহ, রেষারেষি অসহিষ্ণুতা, অসহযোগিতা এসব তো হকির জন্য পজিটিভ দিক নয়। এ দুরবস্থার কারণে স্পন্সররাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আর খুবই বাস্তবতা যে স্পন্সর ব্যতীত কোন খেলাকেই এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। বয়সভিত্তিক জাতীয় দল, ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রাম, লীগসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতা পরিচালনার জন্য বিরাট আর্থিক সহযোগিতা ব্যতীত সম্ভব নয়। আর এসব যোগাড়ের দায়দায়িত্ব সংগঠকদের। কিন্তু যারা গাছে জল ঢালবেন তারাই যদি জলাধার নিয়ে কাড়াকাড়িতে মেতে ওঠেন তখন গাছটাই তো মরে যাওয়ার উপক্রম হবে, এটাই তো স্বাভাবিক।’ আসলে এখন হকির পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, ‘কুইনিন জ্বর সারাবে কিন্তু কুইনিন সারাবে কে’- সংগঠকরা হকিকে বাঁচিয়ে রাখেন- কিন্তু সংগঠকদের বাঁচাবে কে? তাই কামাল মনে করেন, সংগঠকদের একহয়ে একযোগে কাজ করতে হবে। দলীয় আর ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধে থেকে সবাইকে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। তবে এই তারকা খেলোয়াড় এখনও খুব আশাবাদী এই অচলায়তন ভাঙ্গবে বলে। তিনি মনে করেন বর্তমান সরকার এবং ক্রীড়ামন্ত্রী একজন ক্রীড়ানুরাগী ব্যক্তিত্ব। আমাদের ফেডারেশনের সভাপতি যথেষ্ট আন্তরিক হকির উন্নয়নের জন্য। সুতরাং এখন সময় শুধু সবাই একটা পরিবার হয়ে আন্তরিকতার সহিত কাজ করা। শক্ত হাতে ফেডারেশনের কার্যক্রম পরিচালনা করা। এক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে দেশের হকির উন্নয়নে। যাতে লীগসহ সবধরনের প্রতিযোগিতা নিয়মিত আয়োজন নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি এসব প্রতিযোগিতায় সংশ্লিষ্ট ক্লাবগুলোর অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। অন্যথায় হকির স্বার্থে কাউন্সিলরশিপ বাতিল করতে হবে। কামাল আরও বললেন, আসলে হাতেগোনা কয়েকটা ক্লাব নিয়ে বছরে দু’একটি টুর্নামেন্ট আয়োজন করলে উন্নতি কিছুতেই হবে না। সিনিয়র ডিভিশন, প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ এমনকি তৃতীয় এবং পাইওনিয়ার লীগ ও জেলা লীগ করতে পারলে হকির উন্নয়ন আশা করা যায়। এক কথায় দক্ষ সাংগঠনিক কার্যক্রমই হতে পারে হকির উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতার প্রকৃত সমাধান।
×