ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এস এম মুকুল

বিপুল সম্ভাবনাময় সৌরবিদ্যুত বাস্তবায়নে চাই মহাপরিকল্পনা

প্রকাশিত: ২৩:৩৯, ২৫ অক্টোবর ২০২০

বিপুল সম্ভাবনাময় সৌরবিদ্যুত বাস্তবায়নে চাই মহাপরিকল্পনা

সৌরবিদ্যুত বাংলাদেশে অমিত সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। সৌরশক্তি উৎপাদন ও ব্যবহারের উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে প্রয়োজনীয় প্রধান উপাদান সূর্য এবং সহযোগী আরও পাঁচটি উপাদান যথাক্রমে আলো, বাতাস, রোদ, গাছ-পালা এবং পানির উৎস বাংলাদেশে অফুরান। গৃহস্থালী চাহিদার পাশাপাশি শিল্প-কারখানাও সৌরশক্তি দিয়ে চলতে পারে। কৃষি ক্ষেত্রে সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার উন্নয়ন সহায়ক হবে। পাহাড়ি ও হাওর এলাকায় সৌর বিদ্যুত নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে। সৌরবিদ্যুত ব্যবস্থায় প্রচুর দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গ্রামাঞ্চলভিত্তিক যে সৌরবিদ্যুত কার্যক্রম চলছে তাতে বছরে এই খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে আড়াই হাজার কোটি টাকারও বেশি। ৬০ ভাগ বিনিয়োগ হয় সৌর প্যানেলে যার সবটাই আমদানিনির্ভর। ২৫ ভাগ বিনিয়োগ হয় ব্যাটারিতে আর ১৫ ভাগ আনুষঙ্গিক খুচরা যন্ত্রাংশে। ব্যাটারি ও খুচরা যন্ত্রাংশ দেশেই তৈরি হয়। প্যানেল এখন দেশে তৈরি হচ্ছে। দেশীয় চাহিদা পূরণ করতে পারলে পুরো বিনিয়োগটাই দেশীয় নির্ভরতায় প্রতিষ্ঠিত হবে। সাশ্রয় হবে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। দেশে এখন প্রতি মাসে প্রায় ৬৫ হাজার নতুন সোলার হোম সিস্টেম বসানো হচ্ছে। আর এর সুবিধা পাচ্ছে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ। প্রায় ১৩ লাখ ৪০ হাজার ডিজেল সেচ পাম্পকে পর্যায়ক্রমে ‘সৌর পাম্পে’ রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সেচ মৌসুমে প্রায় ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের বিকল্প উৎস মিলবে। ২০২১ সালের মধ্যে দেশে যে মোট ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তার ১০ শতাংশ উৎপাদন করা হবে সৌরবিদ্যুত ও অন্যান্য নবায়নযোগ্য উৎস থেকে- এমন লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুত উৎপাদনের দিকে বিশেষ নজর দিচ্ছে। এতে পরিবেশ সংরক্ষিত হবে। ২০২১ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৪ হাজার মেগাওয়াট। এই লক্ষ্যমাত্রার ১০ শতাংশ বিদ্যুত নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে তেল ও কয়লার ব্যবহার ২০ শতাংশ কমিয়ে আনতে চায় সরকার। যার ফলে বছরে অন্তত ৯৫ মিলিয়ন টন তেলের সমপরিমাণ জ্বালানি সাশ্রয় হবে। বছরে আর্থিক সাশ্রয় হবে পাঁচ হাজার একশ’ কোটি টাকা। ছাদে সৌর প্যানেলে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবায়নযোগ্য জ্বালানি গবেষণা কেন্দ্র তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, দেশের মোট আয়তনের ১ ভাগ জায়গা ব্যবহার করে ৪০ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব। আরও ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হতে পারে শুধু বায়ুশক্তির ব্যবহার করে। সেনা কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সরকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডিজেল প্লান্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্নেল মোহাম্মদ আলীর এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়, ঢাকা মহানগরের ভবনগুলোর ছাদে সৌরবিদ্যুত প্যানেল বসিয়ে অন্তত ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব। ভবন মালিকরা ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করে ২৫ বছর পর্যন্ত মাসিক পাঁচ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। যা আগে বিদ্যুতের বিল হিসেবে দিতে হতো। ঢাকা শহরে ৩ লাখ ইউনিট বাড়ি থাকলেও সৌর প্যানেল স্থাপনের মতো রয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার বাড়ি। এখান থেকে মোট ১ হাজার ৪৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব। ভারত ইতোমধ্যে এক গিগাওয়াট (১ হাজার মেগাওয়াট) ক্ষমতার রুফটপ সৌরবিদ্যুত কাঠামো স্থাপন করেছে এবং ২০২২ সালে ৪০ গিগাওয়াট রুফটপ সৌরবিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কেপিএমজি আশা করছে, ২০২৫ সাল নাগাদ ভারতে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের সাড়ে ১২ শতাংশ আসবে সৌরবিদ্যুত থেকে (বর্তমানে ১ শতাংশ)। দুবাই ইলেকট্রিসিটি এ্যান্ড ওয়াটার অথোরিটি ও ডিপি ওয়ার্ল্ড নামের দুটি প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, তারা যৌথ উদ্যোগে দুবাইয়ের প্রতিটি বাড়ির ছাদে সৌরবিদ্যুত স্থাপনা বসাবে। সৌরবিদ্যুতে আলোকিত হচ্ছে গ্রামীণ জনপদ সৌরবিদ্যুতের আলোয় উন্নয়ন ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় কর্মপ্রেরণা ও প্রাণচঞ্চলতা লক্ষ্য করা যায় নিভৃত গ্রামীণ জনপদে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ, বিনোদন সকল ক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুতের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে গ্রামাঞ্চল। টেলিভিশন, কম্পিউটার, মোবাইলফোন এমনকি ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ার ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের একদিকে যেমন বিনোদন ব্যবস্থার সুযোগ বাড়ছে অন্যদিকে মেধার বিকাশ ঘটছে। সৌরবিদ্যুত আসায় তাদের সন্তানরা আগের তুলনায় অনেক বেশি লেখাপড়া করছে। গ্রামের যেসব বাড়িতে সৌরবিদ্যুত রয়েছে তারা মোবাইল ফোনও ব্যবহার করতে পারছে। ফলে গ্রামের যেসব লোক দেশ-বিদেশে থাকে তারা সহজেই তাদের বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে। তাছাড়া ২০ভাগ সৌরবিদ্যুত ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করায় কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। এ ব্যবস্থাকে আরও বিকশিত করা গেলে গ্রামের মানুষকে শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা থেকে বিরত রাখা যাবে। বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুত ব্যবহারে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুত ব্যবহারে (সোলার হোম সিস্টেম) বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশের মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ মানুষ বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুত ব্যবহার করায় বৈশ্বিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্টে (জিএসআর) বাংলাদেশ মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। আর মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশ মানুষ বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুত বা সোলার হোম সিস্টেম ব্যবহার করে নেপাল এ তালিকায় প্রথম। ২০২০ সালের বৈশ্বিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে জিএসআর প্রকাশ করেছে আরইএনএ ২১। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম সোলার হোম সিস্টেমের জন্য বিশেষ ক্যাটাগরিতে স্থান পেয়েছে। বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুত ব্যবহারে শীর্ষ ছয়টি দেশকে তালিকায় আনা হয়েছে। এখানে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সেচের কাজেও সৌরবিদ্যুত ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশটির ১ হাজার ৫০০ সেচপাম্প সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে চালু রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আছে সুবিধা এবং সাশ্রয় সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার সহজ, নিরাপদ এবং কম খরচে দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহারযোগ্য। একবার বিনিয়োগ করলেই কমপক্ষে ১০ বছর নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত সুবিধা পাওয়া যাবে। সৌরবিদ্যুত পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি। লোডশেডিং নেই। বিল দেয়ার ঝামেলা নেই। সৌরবিদ্যুত ব্যবহারের ফলে গ্রামীণ জনপদে হাটবাজার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজের সময় বৃদ্ধির ফলে আয় রোজগার বেড়েছে। সৌরবিদ্যুত যে কোন স্থানে স্থাপন করা যায়। সাধারণ বিদ্যুতের মতোই ব্যবহার করা যায়- কম্পিউটার টেলিভিশন, রেডিও, ক্যাসেট প্লেয়ার, ভিসিপি, ভিসিআর, ছোট বৈদ্যুতিক পাখা চালানো সম্ভব। মোবাইল ফোনের ব্যাটারি চার্জ করা যায়। সোলার প্যানেল কার্যকর থাকতে পারে টানা ২৫ বছর পর্যন্ত। ব্যাটারি পরিবর্তনযোগ্য। আকাশে মেঘ থাকুক বা টানা বৃষ্টি থাকুক কোন সমস্যা নেই। দিনের স্বাভাবিক আলো থেকেই সোলারে বিদ্যুত উৎপাদন করে। তবে সূর্যের আলোর তুলনায় তা কম হবে। বাংলাদেশে বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে গড়ে ৩৪০ দিন সুর্যের আলো থাকে। ২৫ দিন আলো না থাকলেও দিনের যে আলো বিদ্যমান থাকে তাতেই প্রয়োজনীয় বিদ্যুত উৎপন্ন হয়। সৌরবিদ্যুত স্বল্প মূল্যে স্থাপন করা যায়, বিক্রয়োত্তর সেবা ও প্রয়োজনীয় ঋণ সহায়তা পাওয়া যায়। কেরোসিনের প্রায় সমান খরচে গ্রামীণ জনগণ সৌর প্লান্টের মালিক হতে পারেন। সৌরবিদ্যুত উৎপাদনে কোন কাঁচামালের দরকার হয় না এবং এটি নবায়নযোগ্য। প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে এর জনপ্রিয়তা। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুত ব্যবহাকারীর সংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ। সরকারের উদ্যোগে বর্তমানে মানুষ এ বিষয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়ে উঠেছে। ফলে বিদ্যুতের যোগান পুরোপুরি পেতে বাড়িতে সৌর প্যানেল লাগাচ্ছেন তারা। বর্তমানে দেশের দুই কোটিরও বেশি মানুষ সৌর বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। ৪৭টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইডকল গ্রামীণ জনপদে সৌরবিদ্যুতের কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে। সৌরবিদ্যুত ব্যবস্থা স্থাপনের মাধ্যমে ব্যাটারি, ক্যাবল, সোলার সংক্রান্ত সরঞ্জামের কারখানা গড়ে উঠেছে। কেরোসিনের ব্যবহার হ্রাস পয়েছে। সৌরবিদ্যুতের ব্যবহারের কারণে বার্ষিক একলাখ ৪০ হাজার টন কেরোসিন আমদানি কম হচ্ছে। যার আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য প্রায় ১২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আবার কেরোসিনের ব্যবহার হ্রাসের ফলে পরিবেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিগর্মন হ্রাস পাচ্ছে। যা পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
×