ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নতুন মাস্টারপ্ল্যান ॥ বাস্তবায়িত হোক আধুনিক ঢাকার স্বপ্ন

প্রকাশিত: ২০:৪০, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

নতুন মাস্টারপ্ল্যান ॥ বাস্তবায়িত হোক আধুনিক ঢাকার স্বপ্ন

বছর কয়েক আগে নবায়ন করা হয়েছিল ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের আয়তন। এক শ’ ঊনত্রিশ বর্গকিলোমিটার থেকে বেড়ে হয়েছিল দু’শ’ সত্তর বর্গকিলোমিটার। উত্তর-দক্ষিণে আটটি করে ইউনিয়ন যোগ হওয়ায় বেড়েছে জনসংখ্যাও। নতুন ষোলোটি ইউনিয়নের দশ লাখের মতো জনসংখ্যা নিয়ে দু’সিটির জনসংখ্যা এখন এক কোটি একাশি লাখ চুরাশি হাজার একচল্লিশ জন। জনসংখ্যার এ হিসাব দু’হাজার এক ও এগারো সালের গণনা অনুযায়ী। যদিও আন অফিসিয়ালী সবাই জানে ঢাকার জনসংখ্যা দু’কোটি ছাড়িয়েছে অনেক আগে। দখল আধিপত্যের কবলে পড়ে প্রায় বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়া ঢাকাকে এবার পরিকল্পিত নগরে পরিণত করার জন্য নতুন মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকার মোট জমিকে তেরো ধরনের ভূমি জোনে ভাগ করা হয়েছে। নগর এলাকা একষট্টি দশমিক একষট্টি ভাগ, কৃষি এলাকা আটাশ দশমিক আটচল্লিশ ভাগ এবং জলাশয় সাত দশমিক সাতাশি ভাগ। আরও বিভিন্ন ধরনের সুপারিশসহ রাজউক ডিটেল এরিয়া প্ল্যান বা ড্যাপের খসড়া জমা দিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে। বলেছে, এখন থেকে রাজধানীতে ছোটবড় যেকোনও অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী। যেখানে সেখানে মসজিদ বা ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। জলাশয় ভরাট করে কোন স্থাপনা তৈরি করা যাবে না। শহর ঢাকা তো বটেই আশপাশে রাজউকের সীমানার মধ্যে সব কার্যক্রম হবে পরিকল্পনা অনুযায়ী। নগর বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি সুন্দর-স্বাস্থ্যকর শহরে কম করে হলেও তিরিশ-পঁয়ত্রিশ ভাগ খোলা জায়গা থাকা দরকার। প্লোগ্রাউন্ড এ্যাসোসিয়েশনের মতে, প্রতি এক হাজার জনে অন্তত দশ একর খোলা জায়গা থাকা উচিত। রাজউকের প্রথম ডিটেল্ড এরিয়া প্ল্যানে ঢাকার এক কোটি তিরিশ লাখ মানুষের জন্য খোলা জায়গা ছিল পাঁচ শ’ তিন দশমিক চৌষট্টি একর। হাজারের হিসেবে দশমিক শূন্য চার ভাগেরও কম। এদিকে জনসংখ্যা বাড়ছে। ঢাকা এখন বিশ্বের চতুর্থ জনবহুল শহর। এবারের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ঢাকা হয়ত স্বাস্থ্যকর বাসযোগ্য শহর হবে। দু’ আড়াই দশক আগেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হিসাবে ঢাকা শহরে পার্ক, উদ্যান ও খেলার মাঠের সংখ্যা ছিল এক শ’র বেশি। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের পরিসংখ্যানে যা এখন দাঁড়িয়েছে সাতচল্লিশে। তাও কেবল নথিতে, বাস্তবে ব্যবহারোপযোগী পার্ক রয়েছে চার থেকে পাঁচটা। পিডব্লিউডি, গণপূর্ত বিভাগ ও অন্যান্য সরকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকায় সাতাশটা পার্কের নাম রয়েছে। সেও ওই নামেই। বেশিরভাগই ব্যবহারযোগ্যতা হারিয়েছে। ফাঁকা জায়গা ভরে আকাশছোঁয়া ঘরদোরের মনোলোভা হাতছানির উপসর্গে আক্রান্ত হচ্ছে প্রথমত শিশু-কিশোররা। তাদের অভিজ্ঞতায় খেলার মাঠ বলে কিছু থাকছে না। আপাত তুচ্ছ মনে হলেও বিষয়টা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কারণ খেলার মাঠেই শিশুর সামাজিকায়নের প্রথম পাঠ সম্পন্ন হয়। সমবয়সীদের সঙ্গে মেলামেশা, দলবেঁধে খেলা, হারার বেদনা, জয়ের আনন্দ, প্রতিযোগিতা, বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা সব কিছুর সঙ্গে পরিচয় ঘটে খেলার মাঠে। একজন পূর্ণ সামাজিক মানুষ হওয়ার ভিত অজান্তেই তৈরি হয় খেলার মাঠে। চার দেয়ালে আবদ্ধ শিশুর শরীর-মন দু’য়েরই বিকাশ অপরিপূর্ণ থাকে। নিঃসঙ্গতা থেকে তৈরি হয় নানা ধরনের মানসিক জটিলতা। ঠিক সময়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ না নিলে এ শিশুরা অস্বাভাবিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে বড় হয়ে ওঠে। বাইরে থেকে সুস্থ-স্বাভাবিক মনে হলেও অসম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব নিয়ে বেড়ে ওঠা এসব শিশু ব্যক্তি বা সমাজ জীবনে তেমন কোন অবদান রাখতে পারে না। স্কুলে মাঠ নেই, বিকেলে খেলতে বা বেড়াতে যাওয়ার জায়গা নেই। স্কুলভবন থেকে বাসভবন, ফুড কোর্ট থেকে শপিং মলে আবদ্ধ শিশুরা আত্মকেন্দ্রিক ও অসামাজিক হচ্ছে ক্রমশ। জীবনযাপনে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বজুড়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও পুষ্টিবিদরা বলছেন, কর্মময় দীর্ঘ-সুস্থ জীবনের পূর্বশর্ত সঠিক খাদ্যাভাস ও শরীরচর্চা। নতুন নতুন গবেষণায় তারা দেখছেন সঠিক লাইফস্টাইল হৃদরোগ-ডায়াবেটিসের মতো রোগের জটিলতা কমাতে তো পারেই প্রতিরোধও করতে পারে। লাইফস্টাইলে শরীরচর্চা বিশেষ করে হাঁটার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। প্রতিদিন মুক্ত বাতাসে এক ঘণ্টা হাঁটা শরীরকে অনেক জটিলতা থেকে মুক্ত রাখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, খোলা জায়গা মানুষের জীবনে মৌলিক প্রয়োজনীয় বিষয়। কোন শহরে খোলা জায়গা কম থাকলে সেখানে মৃত্যুহার বেড়ে যায়। এ তথ্য অনুযায়ী প্রকারান্তরে আমরা আয়ু ঝুঁকিতে রয়েছি। আর শহরের জনসংখ্যার বিশাল অংশ নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীনরা তো প্রত্যক্ষ আয়ু ঝুঁকিতে রয়েছেই। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও মাঠ, পার্ক বেদখলের অজুহাত হিসেবে সাধারণত অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপকে সামনে আনা হলেও দখল যারা করে তাদের রয়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ক্ষমতা এবং অর্থের জোর। রাজউকের মাস্টার প্ল্যানের সবুজ বেষ্টনী দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ সোজা কাজ নয়। দখল করে অপরিকল্পিতভাবে ভবন তৈরি করার মানসিকতা সমর্থন করা যায় না। মুনাফা অর্জনেরও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া রয়েছে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় না গিয়ে ধুন্ধুমার কা- ঘটালে সব কিছু তালগোল পাকায়। ঢাকার এখনকার চেহারা তার প্রমাণ। যেমন তেমন একটা ফাঁকা জায়গা পাওয়া গেলÑব্যস, শুরু হলো বহুতল আবাসিক প্রকল্পের কাজ। যেন সব মানুষের এ্যাপার্টমেন্টের বন্দোবস্ত এই ঢাকাতেই করতে হবে। সুষ্ঠু আরবান প্ল্যানিংয়ের কিছু শর্ত থাকে; যেমন নিরাপত্তা, স্বল্প আয়ের আবাসন নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ, যোগাযোগ ও যান চলাচল, নগরায়ণ কমানো, সৌন্দর্য, পরিবেশগত উপাদান, আলো ও শব্দ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। আরবান প্ল্যানিংয়ে এখন সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া দরকার নগরায়ণ কমানো অর্থাৎ সাব-আরবানাইজেশনের দিকে। ঢাকাকে বদ্ধ শহরে পরিণত না করে আশপাশের ছোট শহর বা উপশহরগুলোর দিকে মনোযোগ দিলে চাপ অনেক কমবে। এখানে যোগাযোগ ও যান চলাচলের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাফিক জ্যাম নিয়ন্ত্রণ করে ঠিক সময়ে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা থাকলে উপশহরের বহু মানুষ ঢাকার সংসার গুটিয়ে নিজ শহর থেকে স্বচ্ছন্দে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করবে। পুনর্নির্মাণের সুযোগও আছে। প্রাকৃতিক নিয়মেই সব শহরের একটা অংশ ক্রমশ পুরনো হয়ে ক্ষয়ে যেতে থাকে। তাকে ভেঙ্গে নতুন করে তৈরির প্রক্রিয়া হাতে নিতে হয়। যেমন শুধু পুরান ঢাকার জন্য আলাদা পরিকল্পনা করা যেতে পারে। ওখানকার বাড়িঘর-রাস্তার পুনর্বিন্যাস করলে আবাসন সঙ্কটের সমস্যা অনেকটা কাটানো যায়। কিন্তু এ ঝামেলাপূর্ণ কাজে নির্মাণ কোম্পানিগুলোর আগ্রহ নেই। তার চেয়ে পশ এলাকার এক টুকরো জমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ‘ম্যানেজ’ করে দখল করায় তারা বেশি আগ্রহী। কারণ, এতে পুরোটাই লাভ। নির্মাণ কোম্পানির সদিচ্ছা থাকলে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য বজায় রেখেও নতুন রূপে নতুন ঢাকার সঙ্গে মেলাতে পারে। এ জন্য কিছুটা হলেও আন্তরিকতা থাকা দরকার। নিজ শহর ও দেশের প্রতি মমতা থাকা দরকার। সরকারের এ বিষয়ে শক্ত পদক্ষেপ নেয়া দরকার। পার্ক ও খেলার মাঠ রক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দেশ রয়েছে। সে সঙ্গে পার্ক ও খেলার মাঠ পরিচালনার জন্য বানানো স্থাপনা ছাড়া অন্যসব স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশও রয়েছে। ১৯৫৯ সালে ঢাকা শহরের মাস্টার প্ল্যান করা হয়েছিল, যেখানে ২৯১ একর খোলা জায়গা রাখা হয়েছিল। সে প্ল্যান বাস্তবায়ন হয়নি। ২০০০ সালে আইন করা হয়েছিল যাতে বলা হয়েছে, খেলার মাঠ, পার্ক, খোলা জায়গা ও প্রাকৃতিক জলাধারের কাঠামো ও আকৃতি পরিবর্তন করা যাবে না। ওই আইন উপেক্ষা করেই চলেছে দখল বাণিজ্য। এবারের মহাপরিকল্পনা শতভাগ কার্যকর হবে এমন আশা নগরবাসীর।
×