ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাভাবিক জীবনের ধারণায় চিড়, এখন চলছে নিউ নরমাল

প্রকাশিত: ২১:৫৬, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

স্বাভাবিক জীবনের ধারণায় চিড়, এখন চলছে নিউ নরমাল

মোরসালিন মিজান ॥ শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে? কবিগুরুর এই জিজ্ঞাসা কোভিডের বেলায় খুব খাটে। সেই কবে হানা দিয়েছিল কোভিড-১৯! বিদায় নেয়ার নাম গন্ধ নেই। যাই যাচ্ছি করেও ঠিক আছে। কম করে আছে। বেশি করে আছে। কিন্তু আছে। সেই কবে চীনে শুরু। তার পর এই দেশ ওই দেশ করে প্রায় গোটা দুনিয়ায়। বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। আর আজ সেপ্টেম্বরের ৭। সংক্রমণ এবং মৃত্যু দুই-ই অব্যাহত। কবে এর শেষ? ব্যক্তি সংস্থা সংগঠন কেউ বলতে পারছে না। এ অবস্থায় কোভিড সঙ্গে নিয়েই চলতে শিখছে মানুষ। নতুন করে নিজেকে প্রস্তুত করেছে। যাপিত জীবনের বিধিবদ্ধ অনেক নিয়ম থেকে বেরিয়ে আসছে প্রতিনিয়ত। এভাবে খুব নীরবে বদলে যাচ্ছে স্বাভাবিক জীবনের ধারণা। নিউ নরমাল জীবনে অভ্যস্ত হচ্ছে মানুষ। বাঙালীর যাপিত জীবনের ছবি বহু যুগের বহু কালের ব্যবধানে একটি কমন ফ্রেমে বন্দী হয়েছিল। প্রতিদিনের জীবনাচারে, চর্চায়, রুচিতে, অভ্যাসে, বদভ্যাসে তাকে চেনা যেত। অভ্যস্ত জীবনে এসেছে পরিবর্তনও। কিন্তু কোভিডের কালে যে পরিবর্তন, যেভাবে বদলে যাওয়া তা এক কথায় বিস্ময়কর। কিছু পরিবর্তন একেবারে হঠাৎ করেই। কিছু ধীরে ধীরে। অতো বোঝাও যায়নি। কিন্তু বদলেছে। এই বদলে যাওয়া অনেক বিবেচনায়ই অস্বাভাবিক। কিন্তু লম্বা সময় ধরে চলায় আর অস্বাভাবিক লাগছে না। বরং একে বলা হচ্ছে নিউ নরমাল। কোভিডের কালে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে মানুষের চেহারায়। কারও মাঝে পুরো বদন দেখা বা দেখানোর তাগিদ নেই। ছেলে বুড়ো এমনকি চমৎকার সেজে বাইরে বের হওয়া তরুণীটি নাক মুখ মাস্কে ঢেকে নিচ্ছেন। এভাবেই চলছে শ্বাস নেয়ার কাজ। মুখ ঢেকে কথা বলছেন। তেমন সমস্যা হচ্ছে না। কোভিড নতুন এই অভ্যাস গড়ে দিয়েছে। এখন মাস্ক না পরলে কেমন যেন অপ্রস্তুত মনে হয়। অনেকে পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে মাস্ক পরছেন। ব্যবহারকারীর চাকরি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা থাকতে দেখা যাচ্ছে মাস্কে। পরিত্যাগ করার পরিবর্তে ফুল পাতার ছবি, সিনেমার চরিত্র ইত্যাদি বসিয়ে মাস্ক আরও আকর্ষণীয় করার চেষ্টা হচ্ছে। এবং এই চেষ্টাকে অদ্ভুত আর মনে হচ্ছে না। বাঙালী দেখা হলে হ্যান্ডশেক করবে না, জড়িয়ে ধরবে না পরস্পরকে, কে ভেবেছিল? এখন? ভুলেও কেউ কারও দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন না। দিলে বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলছেন সবাই। এ ধরনের আচরণকে রীতিমতো শত্রুর আচরণ বলে গণ্য করা হচ্ছে! কোলাকুলি গলাগলিও নেই। দু-দুটি ঈদ উদ্যাপিত হয়েছে কোলাকুলি ছাড়া। বর্তমানে যতটা সম্ভব দূরে থেকে সৌজন্য বিনিময় করা হচ্ছে। শুরুর দিকে অনেকে ‘ভুল’ করে হাত বাড়িয়ে দিতেন। এখন ‘শুদ্ধ’ করে নিয়েছেন! প্রতিদিনের চাকরি ব্যবসা শিক্ষা জীবন সব কিছুতেই এখন চলছে নিউ নরমাল। স্কুলের বাচ্চাদের কথাই যদি ধরি, সূর্য উঠল কি উঠলো না, এইটুকুন বাচ্চা ঠিক ঘুম থেকে উঠে পড়ত। নিজ থেকে উঠত। বাবা-মা গালে চুমু খেয়ে কিংবা মৃদু ভর্ৎসনা করে উঠাতেন। তার পর চোখ কচলাতে কচলাতে ওয়াশরুমে। দাঁত ব্রাশ কর রে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নাস্তা সারো রে। ভারি বইয়ের ব্যাগটা পিঠে তুলে নিয়ে স্কুল বাসের পানে ছুটো রে। ক্লাসের শুরুতে ঘুমঘুম চোখ। ক্রমে স্বাভাবিক হওয়া। এবং অতঃপর ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে বাড়ি। আর এখন ধরাবাধা রুটিনের কথা ছেলে-মেয়েরা যেন মনেই করতে পারছে না। কারণ তাদের স্কুলই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল সবার আগে। এর পর ছয় মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। স্কুল নেই। এখন বড়দের মতো দেরি করে ঘুমানো। দেরি করে ওঠা। কী কান্ড! ক্লাস হচ্ছে বটে। টিচার কম্পিউটার স্ক্রিনে। এ-ও নিউ নরমাল এখন। কোভিড কাল শুরুর আগে বেশির ভাগ কর্মজীবী মানুষ সকালে স্নান গোসল সেরে বের হতেন। এখন সন্ধ্যা বা রাতে বাসায় ফিরে শাওয়ার নিচ্ছেন। ভাদ্রের গরমেও চালু আছে গিজার। একবার নয়, অনেকেই দিনে দু’বার গোসলে অভ্যস্ত হয়েছেন। ঘর গৃহস্থালীতেও বড় পরিবর্তন এসেছে। গৃহকর্তাকে ঘন ঘনই দেখা যাচ্ছে রান্নাঘরে। ঘরের মেঝে ঝাড়ু দেয়ার ছবি, মুছার ছবি হাসিমুখে ফেসবুকে আপলোড করছে আধুনিক পুরুষ। সাধারণ ছুটির সময়গুলোতে এসব অভ্যাস রপ্ত করেন তারা। এখন বেশ অভ্যস্ত। নিউ নরমাল। সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত অনেক রীতি এবং আচার অনুষ্ঠানেও পরিবর্তন এসেছে। আগে দুনিয়া সুদ্ধ মানুষকে দাওয়াত না করে বিয়ে অনুষ্ঠানের কথা ভাবাই যেত না। পকেটে পয়সা থাকুক বা না থাকুক, ব্যাপক খরচ করতে হবে। তারপরও মন রক্ষা করা সহজ হতো না। আমন্ত্রণপত্র নিজ হাতে বিলি করতে না পরার জন্য অগ্রিম ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয় বর কনের পিতা মাতাকে। আর এখন ঘন ঘন বিয়ে হচ্ছে। কে কখন বিয়ে করছেন, জানারই তেমন সুযোগ নেই। কলমা পড়ে বিয়ে করা যাকে বলে, সেটা হচ্ছে। এবং চরম নিন্দুকও এর নিন্দা মন্দ করছেন না। সরকার রাজনীতি রাষ্ট্রীয় জীবনও পুরোপুরি আগের মতো নেই। নিউ নরমাল হয়েছে অনেক কিছু। যখন তখন জনসভার নামে ঢাকাবাসীর দুর্ভোগ বাড়ানো হচ্ছে না। নেতাদের বক্তৃতার জন্য বড় বড় মঞ্চ হচ্ছে না গ্রামে গঞ্জে। যুগোপযোগী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সরকার তার কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। নিউ নরমাল লাইফে এমন আরও অনেক ভাল মন্দ যোগ হয়েছে। আমরা দেখছি চরম নিষ্ঠুরতাও। এ প্রসঙ্গে হাসপাতালগুলোর উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। দেশের হাসপাতাল এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা নিয়ে আগেও অসংখ্য অভিযোগ ছিল। কিন্তু কোভিডের কালে এসে দেখা যাচ্ছে বড় ধরনের নিষ্ঠুরতা। রোগীর স্বজনরা একটার পর একটা হাসপাতালে ছুটছেন। কিন্তু নানা ছুঁতো দেখিয়ে রোগী ভর্তি নেয়া হচ্ছে না। কী কোভিড, কী ননকোভিড বিনা চিকিৎসায় অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে! কয়েকদিন আগেও এক কিশোরী মেয়েকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে দাঁড়িয়ে অঝর ধারায় কাঁদতে দেখা গেল। মৃত বাবার সামনে দাঁড়িয়ে সবাই কাঁদে। কিন্তু এই মেয়েটির সামনে তার বাবা বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছিল। কেমন হতে পারে সে কান্না? করোনাকালের আগে এ দৃশ্য কল্পনা করলেও অনেকের বুক কেঁপে উঠত। এখন আর উঠছে কি? উঠলে ঘটনার বিশেষ প্রতিবাদ হতো। বিরাট কোন হুলস্থূল হয়ে যেত। কিন্তু এসবের কিছুই হয়নি। কারণ প্রতিদিনই এমন ঘটনা ঘটছে। তাই এটিও নিউ নরমাল! সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক ভাঙ্গন। তারও চেয়ে অদ্ভুত গঠন নির্মিতি। কবে কোথায় গিয়ে থামা? কেউ জানে না। এই না জানাও এখন নিউ নরমাল!
×