
.
কারাগারে বিশেষ নিরাপত্তায় রাখা হয়েছে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে একটি মামলায় রাজসাক্ষী হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর বৃহস্পতিবার রাতেই তাকে নেওয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বিশেষ সেলে। সেখানে তিনি এখন বেশ আরাম আয়েশেই সময় কাটাচ্ছেন। তার খাবার দাবার ও অন্যান্য সুবিধাও বাড়ানো হয়েছে। বলা চলে- কারাগারে এখন তার নতুন জীবন শুরু হয়েছে।
উল্লেখ্য, জুলাই বিপ্লব চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় স্বেচ্ছায় রাজসাক্ষী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করায় বৃহস্পতিবার সেটা আদালত গ্রহণ করেন। আইনের পরিভাষায় যাকে বলা হয়- ‘অ্যাপ্রুভার’ বা রাজসাক্ষী। একটি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তিনি নিজে আসামি হলেও এখন থেকে তিনি আর আসামি নন। রাজসাক্ষী হিসেবে বিশেষ সুযোগ সুবিধা পাবেন। কারা বিধি অনুযায়ী তাকে সেই সুিবধাই নিশ্চিত করা হচেছ বৃহস্পতিবার রাত থেকে।
জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ মোতাহার হোসেন দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, রাজসাক্ষী হবার পর কারাগারের বিধিমোতাবেক তিনি নিরাপত্তাসংক্রান্ত সুবিধা পাচ্ছেন। তাকে সেটাই নিশ্চিত করা হয়েছে। যেহেতু আদালতের নির্দেশ-সেভাবেই পালন করা হয়েছে।
বিশেষ নিরাপত্তা বলতে কি বোঝায় এমন প্রশ্ন করা হলে আইজি প্রিজন বলেন, উনাকে (চৌধুরী মামুন) রাত থেকেই আগের কারাকক্ষ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে পৃথক কক্ষে, যেখানে তিনি একাকী থাকবেন। যেখানে তিনি নিরাপদবোধ করবেন, সেখানেই তাকে রাখা হবে। এটাই নিয়ম। কারাগারে তো আলাদা জায়গা আছে এ ধরনের প্রয়োজনে। তাকে বিশেষ সুযোগ সুবিধা বলতে জেলকোড অনুযায়ী যা যা পাবার তিনি সেটাই পাবেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে আব্দুল্লাহ আল-মামুন অপরাধের দায় স্বীকার করেন এবং রাজসাক্ষী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে আদালত সেটা আমলে নেয়। মুহূর্তেই সে খবর ছড়িয়ে পড়ায় এখন তিনি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুুতে।
দেশের প্রচলিত কারা আইনে রাজসাক্ষীদের প্রাপ্ত সুবিধাদি সম্পর্কে জনমনে কৌতূহল সৃষ্টি করে। এতে অনেক গণমাধ্যমকর্মী সন্ধ্যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে জড়ো হয়ে জানতে চায় সাবেক আইজিপির বর্তমান হাল হকিকত সম্পর্কে। কারাসূত্র জানায়, আদালত থেকে কড়া নিরাপত্তায় কারাগারের নেওয়ার সময়েই নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় পড়েন তিনি। সেটা অনুধাবন করতে পেরে কারা কর্তৃপক্ষও সতর্ককতামূূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এমনকি সন্ধ্যায় কারাগার কর্তৃপক্ষ থেকে গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে জানানো হয়- আদালত থেকে কোনো নির্দেশনা এখন পর্যন্ত তারা পায়নি। নির্দেশনা পেলে পরবর্তীতে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে কারা অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া ও উন্নয়ন) মো. জান্নাত-উল ফরহাদ গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, সবার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল-মামুনের বিষয়ে আদালতের কোনো নির্দেশনা পাওয়া গেলে পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারা কর্তৃপক্ষ রাত পর্যন্ত কোনো আদেশ পায়নি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে অভিযোগ গঠনের আদেশের সময় ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেলে দায় স্বীকার করেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এসময় ট্রাইব্যুনাল তার রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন মঞ্জুর করে আদেশ দেন। এরপর জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি তার লিখিত বক্তব্যে আদালতকে জানান, যারা এ অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে চান তিনি। এ সময় চৌধুরী মামুনের আইনজীবী জায়েদ বিন আমজাদ সাবেক পুলিশপ্রধানের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার জন্য প্রার্থনা করেন। ট্রাইব্যুনাল এ বিষয়ে যথাযথ আদেশ দেবেন বলে জানান চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আসামি হিসেবে রয়েছেন। আসামিদের মধ্যে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান ভারতে পলাতক।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে কেরানীগঞ্জ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়ার পর পাশের একটি বিশেষ কারাগারে একক সেলে রাখা হয়ে তাকে। এতদিন তিনি কারাগারে বন্দি সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও আওয়াামী লীগ নেতাদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারতেন। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাজসাক্ষী হওযার পর তাকে কারাগারের পৃথক সেলে রাখা হয়। নিরাপত্তাঝুঁকি বিবেচনায় এখন থেকে তিনি একক সেলেই থাকবেন। চৌধুরী মামুনকে আদালত থেকে কারাগারে নেওয়ার পর নিরাপত্তার কারণে বিশেষ কারাগারে আলাদা কক্ষে রাখা হয়। তার সঙ্গে চাইলেই অন্য কোনো বন্দি দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারবেন না। তার নিরাপত্তার দিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। তবে বৃহস্পতিবার রাত থেকেই তাকে ভালো মানের খাবার দেওয়া হচ্ছে। তিনি যা খেতে চাইছেন, তাই দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি তার ব্যবহৃত পোশাক ও অন্যান্য জিনিসপত্রও প্রদানেও বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে।
আ্ইনের ভাষায়- কোনো অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বা সে সম্পর্কে গোপন তথ্যের অধিকারী কোনো ব্যক্তি ক্ষমা পাওয়ার শর্তে অপরাধের সমগ্র ঘটনা, মূল অপরাধী ও সহায়তাকারী হিসেবে জড়িত সকল অপরাধী সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ও সত্য ঘটনা প্রকাশ করে বিজ্ঞ আদালতে যে সাক্ষ্য প্রদান করে তাকে ‘অ্যাপ্রুভার’ বা রাজসাক্ষী বলা হয়ে থাকে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৭, ৩৩৮ ধারা এবং সাক্ষ্য আইনের ১৩৩ ধারায় এ সম্পর্কে বলা আছে। রাজসাক্ষী হবার সুবিধা হিসেবে আইনে বলা আছে- রাজসাক্ষী হওয়ায় সাবেক আইজিপি মামুনকে আদালত সাধারণত ক্ষমা করে দিতে পারে অথবা তার শাস্তির মেয়াদ কমানো হতে পারে। এ ছাড়া তাকে বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়া হতে পারে। এ ধরনের কারাবন্দি বা রাজসাক্ষীকে অনেক সময় নিরাপত্তা প্রদান করা হয়। কারণ তিনি অন্য আসামিদের দ্বারা হুমকির সম্মুখীন হতে পারেন। কিছু ক্ষেত্রে রাজসাক্ষীকে অন্যান্য কিছু আইনি সুবিধাও দেওয়া হতে পারে, যা বিচারক পরিস্থিতি বিবেচনা করে নির্ধারণ করেন। তবে রাজসাক্ষীর জবানবন্দি অবশ্যই সত্য হতে হবে এবং তা অন্যান্য সাক্ষ্য-প্রমাণের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। যদি রাজসাক্ষী মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, তবে তার এই সুবিধা বাতিল হয়ে যেতে পারে এবং তাকেও আসামির মতো বিচারের সম্মুখীন হতে হয়।
২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠন করার পর এটাই প্রথম কোনো মামলায় রাজসাক্ষী হওয়ার নজির তৈরি হয়েছে। এর আগে সে সময় গ্রেনেড হামলা মামলায় মুফতি হান্নানকে রাজসাক্ষী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অপর একটি মামলায় তার মৃত্যুদন্ড হওয়ায় আর রাজসাক্ষী করার উপায় ছিল না। তারপর চৌধুরী মামুনই প্রথম আইসিটির আসামি যাকে রাজসাক্ষী করা হয়েছে। এটাই এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’তে পরিণত হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে এ নিয়ে ব্যাপক কৌতূহলী আলোচনা সমালোচনা চলছে।
প্যানেল