ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ সাখাওয়াত হোসেন

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে দুর্নীতি

প্রকাশিত: ২০:২৫, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে দুর্নীতি

গত ২০ জুলাই পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে পুলিশের আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, আমরা পুলিশকে দুর্নীতিমুক্ত, মাদকমুক্ত দেখতে চাই। এদিকে গত ১৬ আগস্ট রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ অডিটরিয়ামে আয়োজিত আলোচনা সভায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত পুলিশ সদস্যরা নজরদারিতে রয়েছেন। অর্থাৎ, প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা, নিয়মানুবর্তিতা, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি, সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতার আবরণে আবদ্ধ হওয়ার প্রয়াসে বাংলাদেশ পুলিশ অগ্রগামী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। পুলিশের দু’জন শীর্ষ কর্মকর্তার বক্তব্যে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, পুলিশ বাহিনীতে নিযুক্ত পুলিশ সদস্যরাই পুলিশের ভেতরে, বাইরে দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার পাশাপাশি মাদক সেবন ও মাদক ব্যবসায় বিভিন্ন কারণ ও পরিস্থিতির আবেদনের জন্য জড়িত এবং প্রত্যেকটি অনাকাক্সিক্ষত বিষয় পুলিশের ভাবমূর্তিকে সাধারণ জনগণের নিকট ম্রিয়মাণ করে তুলেছে। উল্লেখ্য, দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়, পুলিশ বাহিনীতে লোকবল নিয়োগ, পদায়ন ও বদলিতে ঘুষ লেনদেনও হচ্ছে। পুলিশের অপরাধ সভায় তৎকালীন তেজগাঁও জোনের ডিসি বলেছেন, রেঞ্জ ডিআইজিরা ওসি পদায়নে ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকা করে ঘুষ নেন। আবার পুলিশ সুপাররা এসআই, এ এস আই ও কনস্টেবল পদায়নে ঘুষ নেন। ফলে এ ঘুষের টাকা ওঠাতে গিয়ে ওসি থেকে শুরু করে নিচের পদের সদস্যরা মাদক বাণিজ্যসহ নানা অবৈধ কাজে যুক্ত হন। ফলে মাদক বাণিজ্য বন্ধ করা যাচ্ছে না। মাদক বাণিজ্য বন্ধ করতে হলে ওসি থেকে নিম্নপদের পদায়নে ঘুষ লেনদেন বন্ধ করতে হবে। অন্যদিকে ৩০ আগস্ট ২০১৮ প্রকাশিত টিআইবির প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশের সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এমতাবস্থায়, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বাংলাদেশ পুলিশের দুর্নীতির মাত্রা ও ব্যাপকতা করোনাকালে কিছুটা কম হলেও টেকনাফের সদ্য সাবেক ওসি প্রদীপের মতো কর্মকর্তাদের সম্বন্ধে বাংলার আপামর জনসাধারণ জানতে পেরেছে। সিনহা হত্যাকাণ্ডের সত্যানুসন্ধান না হলে হয়তো প্রদীপের ন্যায় উজ্জ্বল কর্মকর্তার সন্ধান পাওয়া যেত না! হলফ করে বলা যায় বাংলাদেশের প্রত্যেকটি থানার ওসিদের আয় রোজগার এবং সম্পদের প্রকৃত ঘটনা অনুসন্ধান করলে প্রদীপের ন্যায় আরও অনেকেই বেরিয়ে আসবে। পুলিশ সদস্যরা যখন রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন কানুনের ব্যত্যয় ঘটায়, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছেমতো জনগণের সঙ্গে পুলিশিং করে থাকে, তখনই মূলত দুর্নীতির বিষয়টি সামনে চলে আসে। বিশেষভাবে বলা যায়, ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য কিংবা অন্যকে সুবিধা পাইয়ে দেয়ার প্রত্যয়ে পুলিশ সদস্যদের আইনকানুনের অবনমন ঘটানোই পুলিশ দুর্নীতি। বাংলাদেশে সাধারণত দু’ধরনের পুলিশ দুর্নীতির খবর পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে সামনে যা পাবে তাই অনৈতিকভাবে গ্রহণ করা। যেমন, রেস্টুরেন্টে ফ্রি খাবার খাওয়া, ফ্রিতে কাপড় ওয়াশ করানো কিংবা শপিংমলে পণ্য ক্রয়ে বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আবার রাস্তা ঘাটে ট্রাফিকের সময় পুলিশ সদস্যদের টাকা গ্রহণ করার ছবিও পত্রিকার পাতায় দেখা যায়। অন্যটি হচ্ছে; পুলিশ সদস্যদের ডিমান্ডের (চাপে পড়ে উৎকোচ প্রদান করতে বাধ্য হয়) ওপর ভিত্তি করে সুনির্দিষ্ট হারে পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন এজেন্ট ও ভুক্তভোগীদের নিকট থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করে থাকে। যেমন, তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া, তথ্য পাচার করা, দুষ্কৃতকারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সুরক্ষা রাখার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা ইত্যাদি। পুলিশ কেন অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে এর কার্যকারণ বের করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলেই জনসাধারণের মধ্যে স্বস্তি ও পুলিশের প্রতি আস্থার জায়গা তৈরি হবে এবং এ ক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মের উদ্দীপ্ত গবেষকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অপরাধবিজ্ঞানী লরেন্স শেরম্যান এ বিষয়ে মতামত দিয়েছেন- পুলিশ সদস্যরা যে সকল কারণে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন সে জন্য বেশ কিছু কারণকে তিনি সামনে নিয়ে এসেছেন। তিনি এও উল্লেখ করেছেন, ক্যারিয়ারের শুরুতে অধিকাংশ পুলিশ সদস্য নীতি নৈতিকতার মিশেলে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকেন। বিভিন্ন ঘটনা ও প্রতিক্রিয়ার যোগসাজশে তাদের মধ্যে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন চলে আসে। পুলিশের দুর্নীতিতে জড়িত হবার প্রথম কারণ হচ্ছে, সহকর্মীদের প্ররোচনা ও চাপের বশবর্তী হয়ে অপরাধে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। শুরুর দিকে পিটি ক্রাইম (ছোট অপরাধ) যেমন, ফ্রি খাবার খাওয়া, গাড়িতে ভাড়া পরিশোধ না করা ইত্যাদি অপরাধের সঙ্গে পরিচিত হয়ে থাকে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, অন্যান্য অফিসার ও সহকর্মীরা কি ধরনের কাজ করে থাকে সেগুলো অবহিত হয়ে পরবর্তীতে যোগদান করা অফিসাররা সেসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়। তৃতীয় ও শেষ কারণ হচ্ছে, সিরিয়াস অপরাধের ক্ষেত্রে বিবাদীর কাছ থেকে অধিক সংখ্যক টাকা গ্রহণ করে থাকে। মাদক পাচার, মাদক ব্যবসা, বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদি অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের সহায়তা ও ব্যবসা পরিচালনায় সুযোগ প্রদানের নিমিত্তে বিরতিহীনভাবে পুলিশ কর্মকর্তারা অর্থনৈতিক সুবিধা লাভ করে থাকে। অন্যভাবে বলা যায়, একটি প্রতিষ্ঠান যখন সামগ্রিকভাবে কলুষিত হয়ে যায় তখন সেখান থেকে ফেরার বিকল্প উপায় বের করা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। কেননা, প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও অস্বচ্ছতা দীর্ঘদিন ধরে চলমান একটি নিয়মের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুর দিকে হয়তো কয়েকজন অফিসার অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। পরবর্তীতে সময় এবং পরিস্থিতির উপযোগিতায় অধিকাংশ অফিসারই দুর্নীতির সঙ্গে একীভূত হয়ে কাজ করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় পুরো প্রতিষ্ঠান যখন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে যায়, তখন প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর বিকল্প চিন্তা করতে হবে আধুনিক পুলিশিং-এর স্বার্থে। পুলিশ সাবকালচারই পারে নতুন একজনকে যেমনিভাবে দুর্নীতিমুক্ত করতে, আবার ঠিক তেমনিভাবে দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে। সেখানে মূলত সামগ্রিক পরিবেশ বিশেষ করে নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, প্রমোশন, পদায়ন এবং ট্রান্সফার প্রত্যেকটি বিষয়ের ক্ষেত্রে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার প্রয়োজন রয়েছে। পুলিশের মূল কাজই হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা, জনগণের মধ্যকার শান্তি ও নিরাপত্তাকে জোরদার করা। কিন্তু কিছু সংখ্যক পুলিশের দুর্নীতি সাধারণ মানুষের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা সামগ্রিক পরিস্থিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। প্রথমত, পুলিশের দুর্নীতিও অপরাধ এবং অপরাধীদের প্রলুব্ধ করে থাকে। দ্বিতীয়ত, পরিস্থিতি অনুকূলে রাখতে অন্যান্য অপরাধকে সাপোর্ট করে থাকে পুলিশের দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যরা। তৃতীয়ত, পুলিশের দুর্নীতি সামগ্রিক বিচারব্যবস্থার স্বাভাবিকতাকে নষ্ট করে দেয়। চতুর্থত, পুলিশের দুর্নীতি পুলিশ বিভাগের পেশাগত উৎকর্ষকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। পঞ্চমত, পুলিশের দুর্নীতির কারণে লাখ লাখ ডলার (মানি লন্ডারিং) বাংলাদেশে সরকারের কোষাগারে জমা হচ্ছে না। শেষত, পুলিশের দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের পুলিশের ওপর থেকে আস্থা ও বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশ পুলিশের সংস্কৃতি থেকে ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাজনীতিকরণসহ সকল প্রকার অনিয়ম রোধ করতে হলে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া, পদায়ন, পদোন্নতি ও ট্রান্সফারের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তারও আগে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে, পুলিশ প্রধানের ইতিবাচক আচার আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি, যদিও নানা চাপ ও সীমাবদ্ধতার কারণে সবকিছু সম্ভব হয়ে উঠছে না। তথাপি নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি, Police Internal Oversight (PIO) এর কার্যক্রমকে আরও বেগবান ও সক্রিয় হিসেবে কর্মপ্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখতে হবে। এছাড়াও, প্রথাগত পুলিশিং-এর নিয়ম ভেঙ্গে প্রযুক্তিভিত্তিক ইনোভেটিভ, বিজ্ঞানভিত্তিক ও আধুনিক পুলিশিং-এর ওপর গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। বিট পুলিশিং কার্যক্রমকে বাস্তবায়ন ও বেগবান করতে হবে কমিউনিটির জনগণের মঙ্গলের নিমিত্তে তাদের পরামর্শের ভিত্তিতে। কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী ও কমিউনিটি অরিয়েন্টেড করার স্বার্থে উদ্যোগ ও আশু ব্যবস্থা গ্রহণ অবশ্যাম্ভাবী। বিশেষ করে কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার ছাপ রাখতে হবে। পুলিশ পাবলিকের মধ্যকার যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব অঘোষিতভাবে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, সেটিকে কমানোর জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে আধুনিক পুলিশিং-এর প্রয়োজনীয়তায়। বিশেষ করে প্রত্যেক থানায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আসা এএসপিদের পদায়ন করতে পারলে পুলিশের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড ক্রমান্বয়ে কমে আসবে। শেষত, মনে রাখতে হবে জিরো টলারেন্স পুলিশিং-এর নীতি সকল শ্রেণীর মানুষের ওপর সমান গুরুত্ব বিবেচনায় প্রয়োগের নিমিত্তে বাংলাদেশ পুলিশের সফলতা নির্ভরতা করে থাকে। লেখক : প্রভাষক, ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×