ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মমতাজ লতিফ

সাহেদ-শহিদের রামরাজত্ব কিভাবে সম্ভব?

প্রকাশিত: ২১:৫০, ১৬ জুলাই ২০২০

সাহেদ-শহিদের রামরাজত্ব কিভাবে সম্ভব?

কিভাবে সম্ভব এই অবিশ্বাস্য ঘটনাগুলো সংঘটিত করা? সরকার থেকে ‘আমরাই ধরেছি’ বলাটা এ ঘটনাগুলোকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করেনি। জনমানুষ শুধু আশ্চর্য হয়নি, বরং দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির ঘোষণাকে সরকারে থাকা একটি গোষ্ঠী সরকারের ভাবমূর্তি ধ্বংসের লক্ষ্যেই কাজ করেছে বলে খুব শঙ্কা বোধ করছে। তারা শুধু যে বিদ্যুত বিতরণ সংস্থায় দেশবিরোধী কার্যক্রম চালাতে দেখল তা নয়। বরং শহিদ নামের এক সাংসদের দরিদ্র শ্রমিকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা কামানো, তাদের সঠিক মজুরি না দেয়া, মানিলন্ডারিং, তাকে সহায়তাকারী ঐ দেশে নিযুক্ত দূতাবাসের কর্মকর্তা বিনা দ্বিধায় ও বিনা বাধায় বছরের পর বছর এ অন্যায় কা- ঘটিয়ে চলেছে, অথচ এখনও স্বদেশ থেকে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি দেখে মানুষ আশ্চর্য হচ্ছে। তার ওপর স্বামী-স্ত্রী দু’জনই এমপি হলো অর্থের লেনদেনের মাধ্যমে! মানুষ মনে করে স্বামী-স্ত্রী দু’জনই এমপি হতে পারবে নাÑ এমন একটি আইন থাকা প্রয়োজন ছিল। অন্তত এরশাদের মৃত্যুর পর এই আইন প্রণয়ন করা যেত। এর আগে বরিশাল অঞ্চলের ড্রাগের এক গডফাদারের এমপি হওয়া নিয়ে মানুষ বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিল। চট্টগ্রামের একজন এমপিকে নিয়েও বিস্তর সমালোচনা হয়েছিল। এখন আবার উত্থান হয়েছে সাহেদ নামের এক দুর্বৃত্ত প্রতারকের, যার সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বা অন্য কোনভাবে ঘনিষ্ঠ পরিচিতজন হিসেবে দেখা যাচ্ছে সরকারের শুধু স্বাস্থ্য বিভাগ নয়, মন্ত্রী, সচিব, কর্মকর্তাদেরও। একটা প্রশ্ন সবার মনে ঘুরছে- একজন সাধারণ মানুষ বা কোন পেশাজীবী কি সহজে মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, আমলা, উচ্চ পদের নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের এত কাছাকাছি সাহেদের মতো যেতে পারে? সেখানে কি প্রটোকলের কোনরকম বাধা থাকে না? হাসপাতালটি (রিজেন্ট) প্রকৃত অর্থে কোন হাসপাতালই নয়, সেটির কোন লাইসেন্স পাবারও কথা নয়। শোনা যাচ্ছে- প্রতারক সাহেদের এই রিজেন্ট হাসপাতালের লাইসেন্স আগেই ছিল! সেটি স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের পরিদর্শন করে দেখে নেয়ার কথা। এ হাসপাতালকে কোভিড-১৯-এর জন্য ডেডিকেটেড করার সময় নাকি জানা গেছে এটির লাইসেন্স ৪/৫ বছর আগেই বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি, পরিচালক, মন্ত্রণালয়ের সচিব, কর্মকর্তাদের নির্দেশ ছিল হাসপাতালটি যেন দ্রুত লাইসেন্স নবায়ন করতে পারে। আমরাও সরকারী কর্মকর্তা ছিলাম। এই ঘটনাটিকে শিশুতোষ গল্প বলেই মনে হচ্ছে। ২০১৫ সালের চিঠির কথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি জানতেন না? অথবা র‌্যাব তো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা, তারা কোন্ হাসপাতাল কি কারণে সিলগালা করতে গেছে তাও দেখা যাচ্ছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তেমন অবহিত ছিলেন না। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, সাহেদ একদিনে অত বড় প্রতারক, ভ- ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেনি। দিনে দিনে অর্থলোভী ক্ষমতাবান হতে কিছু মানুষ তাকে অতি বড় ধরনের অন্যায় পথে অসৎ উপায় অবলম্বন করে দানবীয় রূপ ধারণ করতে সহযোগিতা, আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে! সাহেদ তাদের কিভাবে পুরস্কৃত করেছে বা প্রতিদান দিয়েছে তা হয়তো অচিরেই জানা যাবে। প্রথম দিনই সময় টিভিতে তার স্ত্রীর বক্তব্য শুনলাম। তার অকল্পনীয় প্রতারণা, টর্চার সেল, বাড়িওয়ালার অসহায়ত্বের খবর-ছবি দেখলাম। অবশ্যই তাকে কোন না কোন উচ্চমহল প্রটেকশন দিয়েছে এমনই মনে করছে জনগণ। উচ্চ মহলকে স্মরণ রাখতে হবে যে, হাসপাতালের কোনরকম শর্ত, সুবিধা না থাকা সত্ত্বেও রিজেন্ট হাসপাতালকেÑ তাও আবার দুই শাখা, কোভিড-১৯-এর পরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্য যারা ‘চুক্তি’ করেছে তাদের সবাইকে কোন গূঢ় স্বার্থ কায়েমের জন্য, অযোগ্যতা, অদক্ষতার জন্য দায়ী একদিন হতেই হবে। খনার বচন বলে- চোরের দশদিন, গৃহস্থের একদিন। সেটি একদিন জানা যাবেই। একটা প্রশ্ন থেকে যায়, এই প্রতারক সাহেদ দু’বছরের জেল খেটেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে! তারপর তো সে জেলখাটা আসামি হিসেবেই চিহ্নিত হবার কথা। কেন সে রাজনৈতিক দলের সরকারের কোন কোন মহল থেকে প্রশ্রয় লাভ করে আবার তার প্রতারণার ভিন্ন কৌশল ব্যবহার করার, সেসব প্রতারণা চালিয়ে যাবার এবং অনৈতিকভাবে বিপুল অর্থ উপার্জনের সুযোগ পেল সেটি ভেবে আমরা শঙ্কিত। বারবার মনে হচ্ছে, কুয়েতে শহিদ এমপি নিজস্ব প্রতারণার কূটকৌশলে কুয়েতী এমপি-মন্ত্রীদের ব্যবহার করে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছে। আর এই সাহেদ আমাদের নাকের ডগায়, সরকারের উচ্চ মহলের প্রশ্রয়ে একের পর এক প্রতারণার ঘটনা ঘটিয়ে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছে। তবে, প্রতারকরা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দানকারীর নাম গ্রেফতার হলেই জনসম্মুখে জানিয়ে দেবে বলে হুমকি দেবে- এ তো অতি স্বাভাবিক। যেমন, কুয়েতে শহিদ এমপি কুয়েতীদের নাম জানিয়ে দিয়েছে। স্বস্তির কথা এই যে, সাহেদ-শহিদ দু’জনই গ্রেফতার হয়েছে অপকর্মের জন্য। আমরা দীর্ঘকাল ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের অসম্পন্ন বিচার কাজ, যেটি বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন, সেটি সম্পন্ন করার লক্ষ্যে প্রচারণা চালিয়েছি। যেটি আমাদের কাছেও সে সময় অবিশ্বাস্য মনে হতো, সেই পরম কাক্সিক্ষত যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধপন্থী মহাজোট ২০০৮-এর নির্বাচনে জিতে এসে সংসদে ম্যাজরিটি দল হিসেবে গণ্য হতে পেরেছিল বলেই বড় বড় খুনী হত্যাকারীর ফাঁসির দ- হয়েছে। এখন মফস্বলের স্থানীয় খুনী-রাজাকার, মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারী নারী ধর্ষকদের বিচার চলছে। আমরা চাই সর্বশেষ রাজাকারের দ- না হওয়া পর্যন্ত বিচার কাজটি যেন সক্রিয় থাকে এবং জাতি একদিন কলঙ্কমুক্ত হয়। কিন্তু রাজাকারেরা তাদের দানবীয় রক্ত বীজ রেখে যাচ্ছে। এখন একদিকে ধর্মের নামে খুন করার লক্ষ্য নিয়ে জঙ্গী দল হিজবুত তাহরীর, আল্লাহর দল সক্রিয় হয়ে উঠতে চেষ্টা করছে, অন্যদিকে এসব প্রতারকচক্র অবশ্যই ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের মুখোশ পরা নেতা, সরকারবিরোধী কর্মকর্তাদের আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে জন্ম নিয়ে দেশবিরোধী কাজে লিপ্ত। ক্যাসিনোপর্ব শেষ হয়েছে, তবে আসামিদের দ- হয়েছে কিনা জানি না। বালিশকা-, পর্দা কা- কি অবস্থায় রয়েছে তাও জানি না। কুয়েতে দ-িত শহিদ, তার প্রশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ এখনও দেশে গৃহীত হয়নি। প্রতারক সাহেদ অবশ্য গ্রেফতার হয়েছে। তবে যে পুলিশ একদিনেই প্রায় সব খুনের আসামিকে গ্রেফতার করে তারা এমন এক প্রতারককে কেন প্রথম দিনেই গ্রেফতার করতে পারল না, এটা একটা প্রশ্ন। এখন মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর সেই ’৭২ থেকে মধ্য ’৭৫ পর্যন্ত সময়কালকে। একদিকে চলছিল বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার, মন্ত্রী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে চরম চরিত্র হননকারী প্রচারণা। ফলে গুজবের পাহাড় গড়ে উঠেছিল। অপরদিকে চলছিল চরম দুর্বৃত্তায়ন, চুরি এবং বঙ্গবন্ধুর কোন নির্দেশ বাস্তবায়ন না হওয়া বা আমলাদের দ্বারা বাস্তবায়ন না করার এক গভীর ষড়যন্ত্র। তৈরি হচ্ছিল একটি পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষ বা খাদ্যাভাব তৈরির অপচেষ্টা। অথচ বঙ্গবন্ধু কৃষিতে বিপ্লব এনেছিলেন। দেশের ভেঙ্গে পড়া অবকাঠামো এক বছরে দ্রুত নির্মাণ করেন। এক কোটি শরণার্থীকে পুনর্বাসন, যুদ্ধশিশুদের দত্তক প্রদান, বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের কাজ করেন। শিক্ষা জাতীয়করণ, বিনামূল্যে শিক্ষা ও পাঠ্যপুস্তক প্রদান, বড় শিল্প জাতীয়করণ করেন। টিসিবি, কসকর ন্যায্যমূল্যের দোকান করেন পণ্য কালোবাজারি ঠেকাতে। আরও হাজারো কর্মকা- করতে তিনি ব্যস্ত ছিলেন। অথচ তরুণদের একটি দল, তেমনি পাকিপন্থী সেনা, আমলা ও যুদ্ধাপরাধী দল তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়ন করেনি এবং তাঁর হত্যাকা-ের পথ প্রশস্ত করে। এখন যেমন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে এই করোনা দুর্যোগের মধ্যেও জাতির অসহায় অবস্থাকে পুঁজি করে একদল প্রতারকের উত্থান ঘটিয়ে তাঁর এবং তাঁর সরকারের, সর্বোপরি উন্নয়নের পথে যাত্রা করা দেশের ভাবমূর্তি ধ্বংসে একটি গোষ্ঠী অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এদিকে আমরা আগাম বন্যা, দ্বিতীয় বন্যার পুনরাবৃত্তি দেখে, লাখ লাখ অভিবাসী শ্রমিকদের শূন্য হাতে ফিরে আসতে দেখে, লাখ লাখ মধ্যবিত্তকে, নিম্নবিত্তকে চাকরি হারাতে দেখে চরম আতঙ্কিত। যতটা সম্ভব সাহায্য দেয়া হচ্ছে। কিন্তু তা সামাল দেয়া কঠিন হবে শেষ পর্যন্ত। এ অবস্থায় গার্মেন্টে কর্মকর্তাদের বেতন হ্রাস করেছে। সরকারকেও এত উচ্চ বেতন অন্তত এক বছর হ্রাসকৃত হারে দিতে অনুরোধ করব। দেখছেন তো, উচ্চ বেতনধারীরাই প্রতারকদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়, কৃষক-শ্রমিক নয়। জানি না, কত টাকা লাগে একটি পরিবারের! মানুষ একদিন মারা যায়, কিন্তু সঙ্গে এত অর্থবিত্ত নিতে পারে না। এটিই আমাদের বড় সান্ত¡না। লেখক : শিক্ষাবিদ
×