ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার ধাক্কায় বেচাকেনা নিয়ে দুশ্চিন্তায় খামারিরা অনেকের আয়-রোজগার কমায় এ বছর কোরবানি কম হওয়ার আশঙ্কা গ্রামেগঞ্জে এখনও জমে ওঠেনি হাট

১ কোটি ১৯ লাখ পশু ॥ কোরবানির জন্য প্রস্তুত

প্রকাশিত: ২২:১৯, ১১ জুলাই ২০২০

১ কোটি ১৯ লাখ পশু ॥ কোরবানির জন্য প্রস্তুত

ওয়াজেদ হীরা ॥ একদিকে করোনা মহামারী অন্যদিকে কড়া নাড়ছে মুসলমানদের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব কোরবানির ঈদ। ঘরবন্দী রোজার ঈদের পর কোরবানির ঈদ নিয়েও শঙ্কা কাটছে না। তবে ত্যাগের এই ঈদে কোরবানির জন্য পর্যাপ্ত দেশী পশু প্রস্তুত থাকলেও বিক্রি নিয়ে শঙ্কা আর দুশ্চিন্তায় রয়েছেন খামারিরা। ঈদের জন্য এক কোটি ১৯ লাখ গবাদি পশু প্রস্তুত রয়েছে। তবে করোনায় পশু পরিবহন, ক্রেতা সমাগম ও দাম ঠিকমতো পাবেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন খামারি ও বিক্রেতারা। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ ও সব ধরনের সহায়তার কথাও বলা হচ্ছে। তবুও খামারিদের শঙ্কা যেন কাটছে না। এবারও কোরবানিতে পশু নিয়ে কোন শঙ্কা নেই। দেশের খামারিদের প্রস্তুত করা চাহিদার চেয়ে ১০ লাখের মতো বেশি পশু আছে। ভারতীয় পশুও আনা হবে না। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসাবে দেশে ১ কোটি ১৯ লাখ পশু রয়েছে আর কোরবানি হতে পারে ১ কোটি ১০ লাখের মতো। গতবার ১ কোটি ৬ লাখ কোরবানি হয়েছিল। ফলে দেশের পশুই মেটাবে কোরবানির চাহিদা। তবে এবার বিক্রি নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে খামারিদের। করোনার থাবায় খামারি থেকে পশু ব্যবসায় যারা জড়িত সবার হিসেবই যেন পাল্টে গেছে। গত প্রায় ছয় মাসের বেশি সময় ধরে কোরবানির জন্য পশু হৃষ্টপুষ্টকরণ শুরু করেন দেশের খামারিরা। অনেকে কোরবানিতে পশু বিক্রি করে আবার পরের বছরের জন্য প্রস্তুতি নেন। এবার দেশে চার মাসের বেশি সময় ধরে করোনাভাইরাসের বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এতে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কপালে। অনেকের আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি মধ্যবিত্ত অনেকেই যারা বরাবর পশু কোরবানি দেন এবার নাও দিতে পারেন। এতে পশু বিক্রি কম হলে পশুর দামও কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে খামারিদের মধ্যে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের খামারিদের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন উদ্বেগ ও পশু বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা জানা গেছে। সাধারণত ঈদের প্রায় এক মাস আগে থেকেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাটগুলোতে নিয়মিত বেপারি ফড়িয়াদের আনাগোনা থাকলেও এবার এখনও সেরকমভাবে শুরু হয়নি। এতে আরও দুশ্চিন্তা বেড়েছে খামারিদের। পশু কোরবানি কম হওয়ার আশঙ্কা ॥ অন্যান্য বছরে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ঈদ-উল-আজহা পালন করলেও এবার সে রকম হবে না বলে মনে করা হচ্ছে। করোনায় বিশাল একটি জনগোষ্ঠী এখন আর্থিকভাবে সঙ্কটের মধ্য দিয়ে দিন পার করছে। তারা এবার পশু কোরবানির কথা ভাবতেই পারছেন না। মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত যারা একাধিক পশু কোরবানি দিতেন, তারাও এবার পশু সংখ্যা কমাবেন। অনেকেই এবার করোনাজনিত কারণে পশু হাটে যেতে অনাগ্রহী। সব মিলিয়ে এবার পশুর চাহিদা থাকবে কম বলে মনে করছেন অনেকেই। এবার সারাদেশে পশু হাটের সংখ্যা কমেছে। আগ্রহী ইজারাদাররা হাটের ইজারা মূল্যও কমিয়ে দিয়েছেন। ডেইরি ফার্মারস এ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে দেশে সারা বছরে যত গবাদিপশু বিক্রি হয়, তার অর্ধেকেরও বেশি হয় কোরবানির পশুর হাটে। দেশে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আগে সারাদেশে দিনে ৪৫ কোটি টাকার গরু কেনাবেচা হয়েছে। সাধারণত মাংস বিক্রির জন্য কসাইদের কাছে এসব গরু বিক্রি হয়। কিন্তু গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে দিনে গড়ে ১০ কোটি টাকার বেশি গরু কেনাবেচা হয়নি। ডেইরি ফার্মারস এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান বলেন, শিক্ষিত তরুণরা ইদানিং গবাদিপশুর খামার গড়ে তুলেছেন। ভাল লাভ পাওয়ায় সাধারণ কৃষকেরাও গরু-ছাগল লালন-পালন বাড়িয়ে দিয়েছেন। করোনায় গত কয়েক মাসের অবিক্রিত গরু-ছাগলও কোরবানির ঈদে যুক্ত হবে। করোনা পরিস্থিতি চলতে থাকলে হাটেও ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম কম হতে পারে। আর্থিক মন্দা, করোনায় স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিসহ নানা কারণে অন্যান্য বারের চেয়ে এবার কোরবানি ২০ শতাংশের মতো কম হবে। বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল ইউটিউবার এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান আজিম বলেছেন, গত বছর কোরবানির পশুহাটগুলোতে প্রচুর গরু অবিক্রীত ছিল। এবার আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছে, অনেকেই কোরবানি দিতে পারবেন না। কারণ, অনেকে এখন চাকরিহীন, নিম্নবিত্তরাও কর্মহীন। যারা আট-দশটা পশু কোরবানি দিতেন, তারা দু-তিনটা দেবেন। অনেকে কোরবানির জন্য বাজেট কমাবেন। কুষ্টিয়ার গরুর বেপারি জুলহাস মুঠোফোনে বলেন, এলাকার হাট বাজার তেমন জমজমাট নয়। গাইবান্দার খামারি আমিনুল ইসলাম বলেন, এ বছর এখনও বেপারিদের আনাগোনা শুরু হয়নি। গতবার এক মাস আগে থেকে কয়েকবার খামারে আসে। দুশ্চিন্তায় আছি পশু বিক্রি কেমন হবে তা নিয়ে। একাধিক বিক্রেতা পাইকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় করোনাভাইরাস ও পর্যাপ্ত পশু মজুদের কারণে উদ্বেগে পড়েছেন খামারিরা। অন্যান্য বছর কোরবানির কয়েক মাস আগে থেকেই ফড়িয়ারা খামারিদের পেছনে ঘুরতে শুরু করলেও কোরবানির মাত্র ২০ দিনের মতো অথচ গ্রামের হাটগুলো তেমন জমে ওঠেনি। ফড়িয়া বা আগাম ক্রেতার দেখাও মিলছে না খামারে। টাঙ্গাইলের খামারি হাসান মিয়া বলেন, বাজার এখনও জমেনি। খুবই খারাপ। আমার নিজের পালন করা গরু আছে ১২টি। এখনও ভাল দামের ক্রেতা পাইনি। এদিকে, করোনা পরিস্থিতিতে সরকার বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। ইতোমধ্যেই কোরবানির পশু ও বাজার নিয়ে বৈঠক করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন গত বছরের মতো এবারও চাহিদার চেয়ে প্রস্তুত রয়েছে কয়েক লাখ বেশি কোরবানিযোগ্য পশু। পশুর সঙ্কট হবে না এবারও। নানা প্রান্তের খামারিদের সুবিধার্থে পশুর হাটে থাকবে কড়া নজরদারিও। হাটে স্বাস্থ্যবিধিও থাকবে বলে জানা গেছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে এ নিয়ে বৃহস্পতিবার মন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় জানানো হয়েছে, এ বছর সারাদেশে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু রয়েছে প্রায় ১ কোটি ১৯ লাখ। গত বছরের চেয়ে এক লাখ পশু বেশি প্রস্তুত রয়েছে। গত বছর সারাদেশে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু ছিল প্রায় ১ কোটি ১৮ লাখ। আর এ বছর প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ১ কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০টি গবাদিপশু কোরবানির জন্য মজুদ রয়েছে। যার মধ্যে হৃষ্টপুষ্টকৃত গরু-মহিষের সংখ্যা ৪৫ লাখ ৩৮ হাজার এবং ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৭৩ লাখ ৫৫ হাজার ও অন্যান্য ৪ হাজার ৫০০টি। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর মনে করছে কোরবানি হতে পারে সর্বোচ্চ ১ কোটি ১০ লাখের মতো। তবে প্রস্তুত রয়েছে আরও অনেক বেশি পশু। ২০১৮ সারে ১ কোটি ১৫ লাখ পশু প্রস্তুত ছিল এবং কোরবানি হয়েছিল ১ কোটি ৫ লাখের মতো। বেশি পরিমাণে কোরবানিযোগ্য পশু প্রস্তুত থাকায় দেশীয় পশুতেই কোরাবানি সম্ভব বলে মনে করছে মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টরা। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, এ বছরও দেশে কোরবানির জন্য গবাদিপশুর পর্যাপ্ত জোগান রয়েছে। কোরবানির জন্য কোন অবস্থাতেই বিদেশ থেকে গবাদিপশু আনার অনুমতি দেয়া হবে না। করোনার কারণে গবাদিপশু বিপণনে এ বছর আমরা অনলাইন বাজারের ওপর জোর দেয়ার চেষ্টা করছি। কোরবানির পশুর হাটে সুস্থ-সবল গবাদিপশু সরবরাহ ও বিক্রয় নিশ্চিতকরণ নিয়ে অনুষ্ঠিত ওই সভায় মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম আরও বলেন, আসন্ন ঈদ-উল-আজহায় স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পর্যাপ্ত গবাদিপশু সরবরাহ ও বিপণনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে কোরবানি করে পরিবেশ রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোরবানির পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক থাকতে হবে, সচেতন হতে হবে, নিজের দায়িত্ববোধ ও নৈতিকতা দিয়ে কাজ করতে হবে। এ ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ উৎপাদন ও সরবরাহে সংশ্লিষ্টদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। সভায় সভাপতির বক্তব্যে মন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের প্রতিবছর কিছু খারাপ অভিজ্ঞতা হয়। কোরবানির পশু পরিবহনে রাস্তায় চাঁদাবাজি হয়, দীর্ঘসময় প্রাণীকে ট্রাকে আটকে রাখতে হয়। এবার আমরা চাই কোনরকম চাঁদাবাজি হবে না। যে অঞ্চলে সুযোগ আছে সেখান থেকে ট্রেনে পরিবহন হবে। খামারিদের খামারে পশু বিক্রয় হলে সেখান থেকে ইজারাদার টোল আদায় করতে পারবে না। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী জানান, গবাদিপশু বিপণন ও পরিবহন সমস্যা সমাধানে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে হটলাইন স্থাপন করা হবে। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তারা সর্বক্ষণিক হটলাইনে সম্পৃক্ত হবেন। গবাদিপশুর বাজারগুলোতে প্রায় ১২০০ মেডিক্যাল টিম কাজ করবে, যাতে রুগ্ন গবাদিপশু বাজারে না আসতে পারে। একইসঙ্গে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে মনিটরিং টিম গঠন করা হবে। কোরবানির হাটে স্বাস্থ্যবিধি প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রওনক মাহমুদ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, দফতর সংস্থার প্রতিনিধি এবং প্রাণিসম্পদ খাতের উদ্যোক্তা ও খামারিরা সভায় অংশগ্রহণ করেন। এদিকে, শিক্ষিত তরুণরা এই সেক্টরে যুক্ত হওয়ায় দ্রুতই পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যপট, উন্নতিও হচ্ছে প্রাণিজ সেক্টরে। গত কয়েক বছরে দেশীয় পশু লালন-পালন করে অনেক বেকার তরুণদের জীবনের গল্প পাল্টে গেছে। ছোট খামার থেকে কেউ গড়েছে বড় খামারও। যেই তরুণরা শিক্ষা জীবন শেষে চাকরির পেছনে ছুটতে তারাই কেউ কেউ এখন চাকরি দিচ্ছে নিজের গড়া ফার্মে। আর সেইসঙ্গে পশু সম্পদে সমৃদ্ধ হয়েছে দেশ। ২০১৫ সালের পর থেকেই দেশে পশু সম্পদ সেক্টরে পরিবর্তন দৃশ্যমান। বাড়তে থাকে খামারিদের সংখ্যাও। খামারিদের পাশাপাশি পশুর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। পাশাপাশি গত কয়েক বছরে কমে এসেছে ভারতীয় বৈধ পথে গরু আনার সংখ্যাও। গাজীপুরের খামারি মোহাম্মদ রাশেদুল একসময় চাকরির পেছনে ছুটে না পেয়ে অল্প পুঁজিতে গড়ে তুলেন গরুর খামার। সেই খামার বড় করার পাশাপাশি এখন শ্রমিক রেখেছেন। তিনি বলেন, একসময় স্বপ্ন ছিল চাকরিজীবী হব এখন সফল ব্যবসায়ী হওয়ার ইচ্ছায় কাজ করি। জানা গেছে, দেশের নানাপ্রান্তে গড়ে উঠেছে গরু ছাগলের খামার। গত কয়েক বছর ধরে এই খামার গড়ে ওঠার প্রবণতা আরও বেড়েছে। এত খামার গড়ে ওঠার কারণ হিসেবে জানা গেছে, সচ্ছলতা এবং সাবলম্বী হচ্ছেন অনেক বেকার যুবক। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে মোটাদাগে টাকা হাতে আসাও একটি কারণ। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের খামার শাখার কর্মকর্তা ড. এবিএম খালেদুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের খামারিরাই কয়েক বছর ধরে কোরবানির চাহিদা মেটাচ্ছে। এবারও ব্যতিক্রম নয়। খামারি বাড়ছে, পশু উৎপাদন বাড়ছে, আমাদের প্রাণিজ সম্পদে সমৃদ্ধিও হচ্ছে। এ বছর সব মিলিয়ে খামারির সংখ্যা ৬ লাখের ওপরে। গত এক বছরে প্রায় ত্রিশ হাজার খামারি বেড়েছে। গতবার ছিল পাঁচ লাখ ৭৭ হাজার ৪১৬ জন। ২০১৮ সালে খামার ছিল ৪ লাখ ৪২ হাজার ৯৯১টি। বছর বছর খামারির সংখ্যা যে বাড়ছে তার বড় একটা অংশ তরুণ। খামারি সালাউদ্দিন এবার খামারে ১৮টি গরু লালন-পালন করেছেন। তিনি বলেন, সন্তানের মতোই পশু লালন-পালন করতে হয়। খরচও বেড়েছে। এবার করোনায় কি হবে বুঝা যাচ্ছে না, আশা আছে লাভের। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, এই বছর করোনাকালীন অনেকেই কাজ হারিয়ে বাসায় কৃষি, মৎস্য ও পশু পালনে আবার সম্পৃক্ত হচ্ছেন। ভারত থেকে গরু আসবে না ॥ দেশে পবিত্র ঈদ-উল-আজহার আগে এ বছর ভারত থেকে গরু আনা ঠেকাবে সরকার। সীমান্তে ‘বিট খাটালের’ মাধ্যমে গরু আনার অনুমতি এ বছর দেয়া হয়নি। গত মাসের শেষে চামড়াশিল্প নিয়ে সরকারের এক টাস্কফোর্সের সভায় এ তথ্য জানান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (আনসার ও সীমান্ত) মোঃ সাহেদ আলী। তিনি বলেন, এবার দেশীয় খামারিরা যাতে গবাদিপশুর ভাল দাম পান, তা নিশ্চিত করতে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে দেশে বর্ডার দিয়ে বৈধপথে গবাধিপশু এসেছে ২৩ লাখ। যা ২০১৪ সালে কমে আসে ২০ লাখে। এছাড়াও ২০১৫ সেটি বৈধ পথে গবাধিপশু আসা আরও কমে যায়। সেবার ৮ লাখ পশু আসে সীমান্ত দিয়ে। ২০১৬ সালে ১১ লাখ, ২০১৭ সালে ৯ লাখ, ২০১৮ সালে ৭ লাখ। বছর বছর গরু কমে আসার সংখ্যাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেন প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কর্মকর্তারা। সীমান্ত দিয়ে গরু যত কম আসবে দেশের খামারিরা তত লাভবান হয়। পশুর হাটে থাকবে স্বাস্থ্যবিধি ॥ সারাদেশের মতো রাজধানীতেও পশুর হাট বসবে। রাজধানীতে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে ২৫টি হাট বসানোর কথা রয়েছে। নোভেল করোনাভাইরাসের মধ্যে পশুর হাট নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাটে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যবিধি থাকবে এবং তা মানা হবে। ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে’ পশুর হাট বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্বাস্থ্যবিধি তৈরি করছে যা প্রায় শেষ পর্যায়ে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অদিদফতর কর্তৃক স্বাস্থ্যবিধি চূড়ান্ত করা হলে স্থানীয় সরকার বিভাগ তা জনসাধারণকে জানিয়ে দিবে। পশুর হাট ব্যবস্থাপনা নিয়ে এক বৈঠক শেষে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম জানান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে কোরবানির পশুর হাট বসবে। একাধিক বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাংলাদেশে কোরবানির পশুর হাট বসানো সম্ভব না। তাছাড়া গত ঈদে (ঈদ-উল-ফিতর) মানুষের অবাধ চলাচলের কারণে সংক্রমণ বেড়েছে। এই ঈদে সেই সুযোগ না দেয়ার পক্ষে বিষেশজ্ঞরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বলেন, গবাদিপশু বেচাকেনায় যুক্ত থাকেন কয়েক লাখ খামারি-ব্যবসায়ী। বিক্রেতাদের কাছ থেকে ক্রেতা বা ক্রেতার থেকে বিক্রেতার মধ্যে ছড়াতে পারে। আসলে পুরো বিষয়টিই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আসলে এখানে স্বাস্থ্যবিধি মানা কতটুকু সম্ভব, সেটা ভাববার বিষয় বলেন তিনি। এদিকে, করোনা থেকে নিরাপদ থাকতে বয়স্ক, শিশু ও অসুস্থ ব্যক্তিদের পশুর হাটে যাওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনের দুই মেয়র। মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, শিশু ও বয়স্করা যারা বিগত বছরগুলোতে পছন্দের পশুটি কিনতে বিভিন্ন হাটে যেতেন, আমি অনুরোধ করব এ বছর আপনারা এভাবে গরুর হাটে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন। স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী দূরত্ব নিশ্চিত, পর্যাপ্ত হাত ধোয়ার ব্যবস্থা ও সচেতনতামূলক মাইকিং থাকবে। এসব হাট আমাদের কাউন্সিলর ও ম্যাজিস্ট্রেটরা সর্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখবেন। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসও ষাটোর্ধ বয়সী ব্যক্তিদের কোরবানির পশুর হাটে না যাওয়ার অনুরোধ করেছেন। দক্ষিণের মেয়র আরও বলেছেন, এবারের ঈদ-উল-আজহা যেহেতু করোনাভাইরাস মহামারীর সময়ে হচ্ছে, তাই উৎসব উদ্যাপনের পাশাপাশি সচেতন থাকতে হবে যেন করোনাভাইরাসের বিস্তৃৃতি না ঘটে। এ জন্য প্রতিটি নাগরিককে আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। যারা কোরবানির পশুর হাটে যাবেন, তারা মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস পরে যাবেন এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখবেন সেই অনুরোধ করছি। পাশাপাশি, বিদ্যমান স্বাস্থ্যবিধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করোনাকালীন এই কোরবানির পশুর হাট পরিচালনার জন্য ডিএসসিসিও আলাদা করে স্বাস্থ্যবিধি তৈরি করছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র বলছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো নির্দেশনাগুলো কয়েক ধাপে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে কোরবানির হাট কমিটির জন্য আলাদা নির্দেশনা দেয়া হতে পারে এবং কেনাবেচার জন্য আলাদা নির্দেশনা থাকতে পারে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক আব্দুল জব্বার বলেছেন, কোরবানির ঈদের পশু ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত। কোরবানির হাট ব্যবস্থাপনা, মেডিক্যাল টিম, এসব বিষয়ে আমরা মতবিনিময় করেছি। আমাদের সবই প্রস্তুতি আছে। আমাদের দেশীয় গরুও চাহিদার বেশি আছে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্র জানায়, সারাদেশে কোরবানির হাটগুলোর জন্য মোট ১২শ’ ভেটেরিনারি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। হাটে ভেটেরিনারি মেডিক্যাল টিমের কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য কেন্দ্রীয় মনিটরিং টিম ও বিশেষজ্ঞ টিম থাকবে। হাটে যে কোন পশুর চিকিৎসা পরামর্শসহ নানা ধরনের সেবা দিবে এই ভেটেরিনারি মেডিক্যাল টিম। ক্রেতা বিক্রেতাদের সুরক্ষায় থাকবে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ॥ পশুর হাটগুলোতে থাকবে কড়া নিরাপত্তা। নিরাপদে কেনাকাটা ও লেনদেনের স্বার্থে নিরাপত্তাবাহিনীর পাশাপাশি জালটাকা শনাক্তের বুথও থাকবে। পুলিশ র‌্যাবের সঙ্গে সমন্বয় করে মোবাইল কোর্ট থাকবে হাটে। এদিকে এ বছরও কোরবানির পশু কেনাবেচায় ভোক্তাদের অধিকার সুরক্ষায় পশুর হাটের তদারকিতে থাকবে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। অধিদফতরটির ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করে জানান, অধিদফতরের মহাপরিচালকের নির্দেশে সারাদেশের পশুর হাটে এ বছরও তদারকি চলবে। আর রাজধানীতে চারটি টিম কাজ করবে। নিয়মবহির্ভূতভাবে মোটাতাজা করা পশু চিহ্নিত করা ও পশুর হাটে গ্রাহক প্রতারণাসহ নানা অনিয়ম ঠেকাতে ভোক্তা অধিদফতরটি সরকারের অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করবে। কোরবানির পশু পরিবহনে সহায়তা করবে রেল ॥ শাক-সবজি, আমের পর এবার কোরবানির পশু পরিবহন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। করোনা পরিস্থিতিতে খামারি ও পশু কারবারিদের সহায়তা করতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ৭ জুলাই রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন এ ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, সাধারণ মানুষ, পশু ব্যবসায়ী ও খামারিদের সহায়তার জন্য কোরবানির পশু পরিবহনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শাক-সবজি ও ফলের মতো কোরবানির পশুও লাগেজ ভ্যানে পরিবহন করা হবে। বিশেষ করে রাজশাহী, পাবনা, নাটোর, গাইবান্ধা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ফরিদপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে পশু বেশি আসে। খামারি ও ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুসারে নির্দিষ্ট স্থান থেকে লাগেজ ভ্যানবাহী ট্রেন চালানো হবে। রেলমন্ত্রী জানান, মিটারগেজের একেকটি লাগেজ ভ্যানে ১৬টি গরু পরিবহন করা সম্ভব। ব্রডগেজে ২০ থেকে ২১টি গরুর ঠাঁই হবে। একটি গরু ঢাকা আনলে দেড় থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যে খরচ পড়তে পারে। চট্টগ্রামে গেলে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা লাগবে। ছাগল ও মহিষ পরিবহন করা যাবে। তবে উট ওঠানো যাবে না। উন্নয়নের গতিতে দেশের প্রাণিজ সেক্টর পাল্টে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে মানুষের ভাগ্যও। ছোট বড় খামার গড়ে নিজেদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন করছেন এগিয়ে নিচ্ছেন দেশকেও।
×