ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আকাশজুড়ে ঘুড়ি

উৎসবমুখর রাজধানীর বাড়ির ছাদ

প্রকাশিত: ২১:৪০, ৭ জুন ২০২০

উৎসবমুখর রাজধানীর বাড়ির ছাদ

মোরসালিন মিজান ॥ এমন দুঃসহ কাল আগে আর আসেনি। মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছে না। বের হলেই বিপদ। অগত্যা দিনের পর দিন ঘরেই কাটাতে হচ্ছে। আর এ ঘরবন্দী জীবনকে একটু সহজ করতে, উপভোগ্য করতে কত না চেষ্টা! তবে বিশেষভাবে চোখে পড়ছে ঘুড়ি ওড়ানোটাই। হঠাৎই ঢাকার আকাশ ঘুড়িতে ছেয়ে গেছে। না, কোন একদিনের কথা বলা হচ্ছে না। এখন প্রতিদিনের রুটিনে ঢুকে গেছে ঘুড়ি ওড়ানো। বিকেল হতে না হতেই তরুণেরা কিশোরেরা ঘুড়ি আর নাটাই হাতে নিয়ে বাসার ছাদে ওঠে পড়ছে। সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত সেখানেই থাকছে তারা। বড়দের বুড়োদেরমনের আনন্দে ঘুড়ি ওড়াতে দেখা যাচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না মেয়েরাও। অঘোষিত লকডাউনের ফলেই রাজধানী শহরে ফিরেছে গ্রামীণ এ ঐতিহ্য। এ দৃশ্য শুধু দেখার আনন্দও কম নয়। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে ঘরবন্দী মানুষ। আজ মুক্তি মিলবে। কাল মুক্তি মিলবে। মেলে না। বরং যতদিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে শঙ্কা। পৃথিবীর দেশে দেশে বাড়ছে মৃত্যু। বাংলাদেশও মারাত্মক ঝুঁকিতে। সম্প্রতি খুব সীমিত আকারে অফিস ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি খুললেও, জরুরী না হলে বাইরে বের হওয়া বারণ। কবে অবস্থা স্বাভাবিক হবে তারও কোন আভাস নেই। মন তাই মাঝে মাঝে বিষাদে ভরে ওঠছে। হতাশা ঘ্রাস করতে চাইছে। আর এ হতাশা থেকে মুক্তি পেতে ছাদে ছাদে আয়োজন করা হচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্যের ঘুড়ি উৎসব। ঘুড়ি ওড়িয়ে বিচ্ছিন্নতার কষ্ট ভোলার চেষ্টা করছে মানুষ। সময়টাকে আনন্দঘন করে তুলছে। লক্ষ্য করে দেখা গেছে, স্কুল কলেজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ হয়ে যাওয়ার কিছুদিন পর থেকেই ঘুড়ি ওড়ানো শুরু হয়। সাধারণ ছুটি কার্যকর হলে বিভিন্ন বয়সী মানুষ এতে যোগ দেন। প্রথমদিকে পুরান ঢাকার বিভিন্ন বাসার ছাদে ঘুড়ি ওড়েছে। গেন্ডারিয়া, লালবাগ, ওয়ারী, টিকাটুলি, নবাবপুর, শাখারী বাজার, লক্ষীবাজার, তাঁতী বাজার, রায় সাহেব বাজারসহ বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় ঘুড়ি ওড়াতে দেখা গেছে। ক্রমে তা ছড়িয়ে পরে গোটা শহরেই। নতুন ঢাকার হাতে গুনা কয়েকটি এলাকা ছাড়া বাকি সব জায়গাতেই কম বেশি ঘুড়ি ওড়তে দেখা যাচ্ছে এখন। কিছু ঘুড়ি পাতলা কাগজ দিয়ে তৈরি। কিছু আবার পলিথিন দিয়ে। মূল কাঠামোটি বাঁশ অথবা নারিকেল পাতা থেকে সংগ্রহ করা পাতলা সরু শলা দিয়ে গড়া। প্রায় একই রকম দেখতে হলেও, একেক ঘুড়ির একেক নাম। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুরান ঢাকার আকাশে ওড়ছে পঙ্খীরাজ, চাপালিশ, চোখদ্বার, মালাদ্বার, চশমাদ্বার, কাউঠাদ্বার, চানদ্বার, ইত্যাদি নামের ঘুড়ি। নাটাইও এক জাতের নয়। বাটিওয়ালা, মুখবান্ধা, মুখছাড়াÑ আরও কত কী! গে-ারিয়ায় নিজেদের বাসার ছাদে প্রায় প্রতিদিন ঘুড়ি ওড়ান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহেদ। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত সাকরাইনের সময় আমরা অনেক ঘুড়ি কিনে রেখেছিলাম। সব ওড়ানো হয়নি তখন। করোনার কারণে ঘরে আছি। এখন তাই সব খুঁজে বের করে ওড়াচ্ছি। শুধু ওড়ানো নয়, কাটাকটি খেলাও চলছে। এভাবে করোনার প্রাদুর্ভাবের কালে নিজেকে চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করছেন বলে জানান তিনি। নতুন ঢাকার মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, আসাদ গেট, লালমাটিয়া, মনিপুরাী পাড়া, তেজগাঁও, আগারগাঁও, মিরপুরসহ বেশকিছু এলাকার আকাশে প্রতিদিন ঘুড়ি ওড়ছে। শনিবার বিকেলে মনিপুরী পাড়ার একটি বাসার ছাদ থেকে আকাশের দিকে তাকাতেই চোখ ছানাভরা। যেদিকে চোখ যায়, ঘুড়ি আর ঘুড়ি! পাশের বাসার একটি ছাদে কিশোর পুত্র ও কন্যাকে নিয়ে ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন এক বাবা। অদূরে আরেকটি ছাদে নাটাই হাতে মেয়েদের একটিদল। এখানেই শেষ নয়, নড়বড়ে শরীরের এক প্রবীণও ঘুড়ি নিয়ে ব্যস্ত। সবারই চোখ আকাশে। মেঘমুক্ত আকাশে পাতলা কাগজ ও পলিথিনে তৈরি ঘুড়ি। কোনটির লেজ বা লেঞ্জা নেই বললেই চলে। কোনটির আবার ইয়া লম্বা লেজ। এসব ঘুড়ির সুতো অতি সাধারণ। খুব কাছ দিয়ে ওড়ছিল। পাশাপাশি কেউ কেউ কাটাকাটি খেলায় ব্যস্ত ছিলেন। তানিম নামের এক তরুণ চোখের পলকেই দু’টি ঘুড়ি কেটে দিল। অন্য ছাদ থেকে ওড়ানো ঘুড়ি কাটতে পেরে ভীষণ খুশি সে। বলল, আমার সুতোয় কাঁচের গুড়ো মাখানো। তাছাড়া ঘুড়ি দিয়ে ঘুড়ি ধরার কৌশল জানা আছে আমার। সাধারণ সুতোর ঘুড়ি তাই চাইলেই কেটে দিতে পারি। মজার ব্যাপার হলো, যার ঘুড়ি কাটা পড়ল তিনিও অখুশি হয়েছেন বলে মনে হলো না। জুবায়ের নামের সে তরুণ বলছিলেন, করোনায় এত মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে। মারা যাচ্ছে। টেলিভিশনে এসব দেখে খারাপ লাগে। চাপ বোধ করি। এ অবস্থায় ঘুড়ি হাতে যেটুকু সময় কাটানো যায় সেটুকুই আনন্দের। স্বস্তির। অবশ্য ঘুড়ি সংগ্রহ করাও এখন বেশ মুশকিলের কাজ। আগে সংগ্রহ করা ঘুড়িগুলোই মূলত ওড়ানো হচ্ছে এখন। কেউ কেউ নতুন করে কাওরান বাজার থেকে সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন। শাখারী বাজার অনেক দূরে। এরপরও সেখান থেকে কিছু ঘুড়ি আসছে। এর বাইরে কোন কোন অনলাইন শপ থেকে ঘুড়ি কেনা যাচ্ছে। দুই থেকে পাঁচদিনের মধ্যে বাসায় পৌঁছে যাচ্ছে ঘুড়ি। ফেসবুক পেজের মাধ্যমেও বিক্রি হচ্ছে। ‘ঘুড়ি’ নামে একটি পেজে গিয়ে দেখা যায়, এটি পরিচালিত হচ্ছে রাজশাহী থেকে। পেজের মাধ্যমে অর্ডার নিয়ে সারাদেশেই ঘুড়ি সরবরাহ করা হচ্ছে। এভাবে করোনাকে ভুলে থাকার, ভাল থাকার কার্যকর অনুষঙ্গ হয়ে ওঠেছে ঘুড়ি।
×