নোভেল করোনাভাইরাসের আক্রমণে থমকে গেছে সারা বিশ্ব। নতুন নতুন আক্রান্ত ও মৃত্যুর খবরে প্রতিদিনই ভারি হয়ে উঠেছে পৃথিবীর বাতাস। করোনা শুধু মানুষের জীবনের গতি ও অর্থনীতির গতিকেই মন্থর করেনি, থমকে দিয়েছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রসহ সারাবিশ্বের সকল কার্যক্রম। বৈশ্বিক এই দুর্যোগের প্রভাবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনও স্থবির।
মারাত্মক এই ছোঁয়াচে ভাইরাসের কারণে ১৮ মার্চ থেকে পরবর্তী নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত সারাদেশের সকল সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বাতিল করেছে তাদের কার্যক্রম, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিও গত ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ রেখেছে সব মিলনায়তন। এছাড়া নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৪টি সংগঠন সম্মিলিত বৈঠকে গত ২২ মার্চ থেকে সকল ধরনের শ্যুটিং বন্ধ ঘোষণা করেছে। যার কারণে নাটকের সংলাপ, নৃত্যের মুদ্রা আর সুরের মূর্চ্ছনায় এখন আর মুখরিত হয় না রাজধানীসহ দেশের মঞ্চগুলো। লাইট, ক্যামেরা, এ্যাকশন, কাট এর চিরচেনা সেই শব্দগুলোও শিল্পীদের কাছে এখন অপরিচিত। আর সেট সাজিয়ে শিল্পীর জন্য অপেক্ষার প্রহর গোনা নির্মাতাদের কাছে এখন যেন সোনালী অতীত। মোট কথা বৈশ্বিক এই মহাদুর্যোগের প্রভাবে জমকালো সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এখন কেবলই বিষাদের সুর। আর এই প্রভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অস্বচ্ছল ও নিম্নœআয়ের মানুষেরা। মিলনায়তন কেন্দ্রিক অনুষ্ঠানে কণ্ঠশিল্পী, অভিনয়শিল্পী ও যন্ত্রশিল্পীদের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মঞ্চ ব্যবস্থাপক, সেট ডিজাইনারসহ এ পেশার সঙ্গে জড়িত নানা শ্রেণীর মানুষ। আর নাটক ও চলচ্চিত্রসহ সকল ধরনের শ্যুটিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করা প্রোডাকশন্স বয় থেকে শুরু করে মেকাপ আর্টিস্ট, লাইটম্যান, সহকারী পরিচালক, ট্রলি বয়, ক্যামেরা ক্রু ও শিল্পীরাও বেকার হয়ে পড়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে গোটা সাংস্কৃতিক অঙ্গন চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে বলে মনে করছেন সংস্কৃতিকর্মীরা। নিরাপদ ও সাবধানতার সঙ্গে চরম এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠে সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে বেগবান করার লক্ষ্যে সংস্কৃতিকর্মীদের রয়েছে নানা ধরনের পদক্ষেপ। নিজেদের নানা উদ্যোগের বিষয়ে জনকণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেছেন সংস্কৃতির বিভিন্ন অঙ্গনের সঙ্গে সম্পৃক্তরা।
আসাদুজ্জামান নূর ॥
শুধু সাংস্কৃতিক অঙ্গনই নয় সারবিশ্বই এখন চরম প্রতিকূলতার মধ্যে রয়েছে। আগে বাঁচতে হবে এবং সুস্থ থাকতে হবে। অতিমাত্রায় জনসমাগমের কারণে এই ভাইরাসটিতে সংক্রমিতে হওয়ার যেহেতু ঝুঁকি রয়েছে সেই কারণেই সংস্কৃতিকর্মীরা সব ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাতিল করেছে। আর এর প্রভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অস্বচ্ছল শিল্পী ও কলাকুশলীরা। যাত্রাশিল্পী, লোকশিল্পী ও যন্ত্রশিল্পীসহ যারা দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল অনুষ্ঠান বন্ধ থাকাতে তারা বেকার হয়ে পড়েছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে দুস্থদের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে আমরা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষে একটা উদ্যোগ নিয়েছি। যার যার সামর্থ অনুযায়ী ফান্ড রাইজ করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোই এখন সংস্কৃতিকর্মীদের মূল লক্ষ্য। সংস্কৃতির পাশাপাশি অর্থনীতিতেও করোনার প্রভাব পড়েছে। টিভি বিজ্ঞাপন ও টিভি নাটক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কিছুটা সময়তো লাগবেই।
রামেন্দু মজুমদার ॥
এখন যে অবস্থা তাতে এই করোনার প্রভাব যে আমাদের জীবনের ওপর কি পড়বে সেটাই তো আমরা নিশ্চিত নই। আগে তো বাঁচি তারপরে নাটকের কথা ভাবা যাবে। আমি এই করোনা নাটকের ওপর কি প্রভাব ফেলবে এটা সম্পর্কে একেবারেই এখন ভাবছি না। আমার কেবলই ভাবনা আমাদের জীবনের ওপরে এই করোনা কি প্রভাব ফেলে, সাধারণ মানুষের ওপর কি প্রভাব ফেলে এটাই আমার এখন চিন্তা। তারপর আমরা যদি সবাই বেঁচে থাকি আবার নতুন করে নাটক জেগে উঠবে। এখন জীবনটাই আসল, বেঁচে থাকাটাই বড় কথা।
গোলাম কুদ্দুছ ॥ সভাপতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট
করোনা একটা বৈশ্বিক দুর্যোগ। বিশ্ব পরিস্থিতির উন্নতি হলে আমাদেরও উন্নতি হবে। দেশের সকল ক্রান্তিকালে সংস্কৃতিকর্মীরা পাশে ছিল, এখনও আছে আর ভবিষ্যতেও থাকবে। সংস্কৃতিকর্মী ও জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করেই আমরা সকল ধরনের অনুষ্ঠান বাতিল করেছি। এই মহাদুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমরা সকল সংস্কৃতিকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছি। রাষ্ট্রের পাশাপাশি আমরাও এগিয়ে আসব। এই সঙ্কটে সবারই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে দেয়া উচিত। এই ধরনের দুর্যোগে রাষ্ট্রের পাশাপাশি সংস্কৃতিকর্মীদেরও অনেক দায়িত্ব রয়েছে। আমরা এখন ফান্ড রাইজিং করছি। দুস্থ ও অস্বচ্ছল শিল্পীদের পাশে আমরা সাধ্যমতো দাঁড়াব। মানবিক সমাজ গঠন ও দেশকে গতিশীল করার লক্ষ্যে আমরা সারাদেশের সংস্কৃতিকর্মীরা মানুষের পাশে দাঁড়াবো এবং নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাবো। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট থেকে আমাদের আরও নানা ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মোমেনা চৌধুরী ॥
সারাবিশ্ব যখন অনাচারে ভরে গেছে। নারীর প্রতি যখন সহিংসতা চরমে তখনই এই করোনা আমাদের জন্য হুমকি স্বরূপ এসেছে। অভিনয়ের পাশাপাশি আমি কোয়ান্টামের সঙ্গেও জড়িত। তাই কোয়ান্টামের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে দম ধরে রাখার কৌশল শিখাচ্ছি।
যাতে করে ফুসফুস ভাল থাকে। এছাড়া ইয়োগার বিষয়েও জনগণকে উৎসাহিত করছি। একজন শিল্পী হিসেবে জনগণকে সচেতন করার এর চেয়ে ভাল সুযোগ আর কি হতে পারে। মানুষ যখন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে বিচ্যুত তখন করোনা সবাইকে সৌজন্যবোধ শিখাচ্ছে।
মানুষ যখন তার পাপের সীমা লঙ্ঘন করে তখন সৃষ্টিকর্তা তাদের শাস্তি দিয়ে থাকেন।
যেই আমেরিকা সারাবিশ্বে কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা করছে সেই আমেরিকাই এখন অসহায়। আল্লাহ বলেছেন ‘আমি দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সবই দেখি, কিন্তু তোমরা কেউই দেখ না’। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ভয়ে মানুষ এখন অন্যায় করাও ছেড়ে দিয়েছে। যেই মানুষ নানা ধরনের অনাচারে লিপ্ত ছিল করোনার ভয়ে সেই মানুষেরা এখন ঘরে আছে। ভ্রাতৃত্ববোধে আছে। পারিবারিক বন্ধনে আছে। বিশ্বের আবহাওয়াও এখন দূষণমুক্ত। সমুদ্রের ডলফিনগুলোও এখন সৈকতে এসে খেলা করছে। যার কারণে আমি করোনাকে ইতিবাচকভাবেই দেখি। অস্থির এই বিশ্বে এই করোনার দরকার ছিল বলেই আমি মনে করি। এটা প্রকৃতির প্রতিশোধ।
তবে এই পরিস্থিতি আমরা খুব শীঘ্র্রই কাটিয়ে উঠবো বলেই আমি আশা রাখি। শিল্পীরা যেহেতু সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে সেহেতু এই দুর্যোগের সময় সকল শিল্পীদের মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে। মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমরা যেহেতু এখন হোম কোয়ারেন্টাইনে আছি সেহেতু ভার্চুয়াল মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার কাজটি আমাদের করতে হবে। এ জন্য সব শিল্পীদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে।
তারিন ॥
করোনা শুধু বাংলাদেশের নয়, বৈশ্বিক সমস্যা। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকার আন্তরিক ও কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। শুধু সাংস্কৃতিক অঙ্গনই নয়, সব সেক্টরই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সব কিছুতেই এখন স্থবিরতা। আমাদের নাট্যাঙ্গনে যারা দৈনিক মজুরিভিত্তিতে কাজ করে তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে টিবয় থেকে শুরু করে মেকাপ আর্টিস্ট, ক্যামেরাম্যান, লাইটম্যানসহ আরও অনেকে। সবারই আয়ের উৎস কিন্তু মিডিয়া। কারোরই বিকল্প আয়ের কোন ব্যবস্থা নেই। এই টাকা দিয়েই তাদের রুটি রুজির ব্যবস্থা হয়। সংসার চালিয়ে আবার অনেককে কিস্তিও দিতে হয়। তাদের জন্য কিছু করা অর্থাৎ তাদের পাশে দাঁড়ানোটা এখন আমাদের নৈতিক দায়িত্ব বলেই আমরা মনে করি। অস্বচ্ছল শিল্পী ও টেকনিশিয়ানদের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে এ্যাকটরস ইক্যুইটি, ডিরেক্টরস গিল্ডসহ বিভিন্ন সংগঠন একত্রিত হয়ে আমরা তথ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছি। তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। অন্তত দুই মাস যাতে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা যায় সেজন্য কিছু একটা করার প্রচেষ্টা ও সদিচ্ছাও আমাদের রয়েছে। এই সরকারও সংস্কৃতি অনুরাগী সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে আমরা সহযোগিতা পাব বলেই আশা রাখি। সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদেরও আমরা অনুরোধ করব তারা যাতে এই দুর্যোগের সময় সংস্কৃতির উন্নয়নে এগিয়ে আসে। সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে এতে করে এই সঙ্কট থেকে আমরা খুব শীঘ্রই মুক্তি পাবো। তবে সরকারের পাশাপাশি আমাদের জনগণকেও সচেতন হতে হবে।
নূনা আফরোজ ॥
শিল্পের যতগুলো শাখা আছে তার মধ্যে থিয়েটারেই বোধকরি করোনার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে বা পড়বে। সবই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে কিন্তু থিয়েটার ফিরবে সব শেষে। কারণ করোনার যে মূল তত্ত্ব শারীরিক দূরত্ব থিয়েটার তার শতভাগ বিপরীত তত্ত্বে চলে। করোনা মানুষ থেকে মানুষকে বিযুক্ত করার কথা আর থিয়েটার মানুষে মানুষে যুক্ত করার কথা বলে। আমরা যারা থিয়েটার না করে থাকতে পারি না তারা ঠিকই থিয়েটারে শীঘ্রই ফিরবো বা বলতে পারি এখনও প্রতিদিনই থিয়েটার করছি যতটা ঘরে বসে এগিয়ে থাকা যায়। শুধু মঞ্চের আলোয় দাঁড়াতে পারছি না। কিন্তু দর্শককে ফিরতে একটু সময় লাগবে। আর দর্শক ছাড়া তো থিয়েটার সম্পূর্ণ হয় না। একদল জীবন্ত মানুষ পারফর্ম করবে আর একদল জীবন্ত মানুষ তা দেখবে এটাই তো থিয়েটার। আমি যেহেতু থিয়েটার করবোই তাই বিকল্প অনেক ভাবনাই ভাবছি থিয়েটার নিয়ে।
তানভীন সুইটি ॥
শিল্পী ও কলাকুশলীদের সুস্থতার জন্য এই মুহূর্তে আমরা কোয়ারেন্টাইনে আছি। শ্যুটিং বন্ধ থাকাতে আমাদের শিল্পী ও কলাকুশলীরা বেকার হয়ে পড়েছে। তবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দৈনিক মজুরিভিত্তিতে কাজ করা জুনিয়রশিল্পী ও টেকনিশিয়ানরা। প্রোডাকশন্স বয় থেকে শুরু করে মেকাপ আর্টিস্ট, ক্যামেরাম্যান, লাইট ম্যান, ক্যামেরা ক্রু এরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। কারণ সবার রুটি-রুজি হয় এই অঙ্গন থেকেই। এই দুঃসময়ে তাদের জন্য কিছু করাটা আমাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৪টি সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়ে অপেক্ষাকৃত অস্বচ্ছলদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। ছোট আর বড় বলতে কেউ নেই, আমরা সবাই সমান। করোনা সেটি আবারও প্রমাণ করে দিল। এই প্রতিকূলতায় আমাদের একে অন্যের পাশে দাঁড়াতে হবে। ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই।