ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

কোভিড-১৯ এবং ঈদ-অর্থনীতি

প্রকাশিত: ২১:১৮, ২২ মে ২০২০

কোভিড-১৯ এবং ঈদ-অর্থনীতি

এবারের ঈদ-উল-ফিতর এমন একটি সময়ে দেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যেখানে আসলে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার মনে আতঙ্ক চিন্তা ও দুশ্চিন্তার শাখা-প্রশাখা বেড়ে চলেছে। কোভিড-১৯-এর কারণে সরকার প্রথম থেকেই প্রতিটি মানুষের ঘরে অন্ন পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রশাসন যন্ত্র, সংসদ সদস্যবর্গ, পুলিশ বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মী বিশেষত ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে কাজে লাগাচ্ছে। একমাত্র মহান রাব্বুল আলামিন জানেন কবে থেকে এ অসহনীয় কোভিড-১৯ কে মানুষের জন্য সহনীয় করবেন? টিকা কবে আবিষ্কৃত হবে? সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে আসবে। মানুষ বোধহয় মধ্য বয়সের শেষ লগ্নে এসে কিছুটা নষ্টালজিক হয়ে ওঠে। তাই তো বার বার মক্তিযুদ্ধের ঈদের সময়ের স্মৃতি ভেসে ওঠে। আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল ছোট্ট মসজিদ। সেটি এখন বড় হয়েছে। কিন্তু সেবার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং রাজাকার ও আলবদরদের ভয়ে সাধারণ মানুষ ঈদের জামাতে অংশ নিতে পারেনি। তারপরও গোটা কয়েক মুসল্লির মধ্য থেকে ঈদের জামাতের পরপরই দু’জনকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে গিয়েছিল বলে জেনেছিলাম। আজ স্বাধীন বাংলাদেশের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানে না। সেদিন যেভাবে বাংলার কৃষক মজুর– শ্রমিক শিক্ষক চিকিৎসক ব্যাংকার সাংবাদিকসহ সবাই ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, আজকেও একটি অনাকাক্সিক্ষত করোনাভাইরাসের কারণে বাংলার মানুষ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই বঞ্চিত হচ্ছে। ঈদকে ঘিরে যে প্রায় দু’লাখ কোটি টাকার সকল খাত মুক্ত করে সার্বিক লেনদেন হয়ে থাকে। এবার তা ম্রিয়মাণ প্রায়। তারপরও জননেত্রী শেখ হাসিনা সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে ঈদের আনন্দ পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। পঞ্চাশ লাখ মানুষের ঘরে ২,৫০০ টাকা করে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে পৌঁছে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং যা বাস্তবায়িত হচ্ছে। এটি অত্যন্ত সুখের কথা। তবে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে কেবল মোবাইল ব্যাংকিং-ই শুধু নয়, এমনকি নর্মাল ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রেও চার্জেস সিডিউলে ইচ্ছেমতো চার্জ ব্যাংক বোর্ড স্ববোর্ড থেকে পাস করিয়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় বাংলাদেশ ব্যাংক ইদানীং চার্জেস সিডিউল পর্যালোচনা করে না। অতিরিক্ত চার্জ আদায় করলেও কোন ধরনের নির্দেশনা দেয় না। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যাংকিং কর্মসূচী সরকারের জন্য সহায়ক হবে। এবারের ঈদ একটি ভিন্নমাত্রা নিয়ে এসেছে। যারা ফ্রন্টলাইন কাজ করছেন তাদের পরিবার-পরিজন তাদের জন্য দুশ্চিন্তায় থাকবেন। আবার ঘরে বসে থেকেও যে করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের স্বস্তি থাকবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। ঈদে সালাম করা যাবে না। ফলে ছোট ছোট বাচ্চারা সালামি থেকে বঞ্চিত হবে। অন্যদিকে সামাজিক নিয়ম মেনে দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে কোলাকুলি করা যাবে না। এমনকি হাত মেলানোও সম্পূর্ণভাবে নিয়ম বিরুদ্ধ। আসলে ঈদের যে আনন্দ তা অনেকখানি ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে। বেসরকারী খাতে যারা আছেন তারা বেতন-ভাতাদি, বোনাস অনেকেই পাননি। ফলে কেমন করে সংসার চালাবেন সে দুশ্চিন্তায় অস্থির। সবাই তো চাইতেও পারছে না। এদিকে যারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ছিল, তারাও তাদের বিনিয়োগের অর্থ তুলে আনতে পারছে না। অন্যদিকে ঈদকে ঘিরে কেনাকাটার যে ধুম, সচরাচর গড়ে যায়, তা থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকারের প্রয়াসে ডিজিটালাইজেশন বেশ ভালভাবে শুরু হয়েছে। তবে কিছু কিছু অনলাইন ব্যবসায়ী আবার ক্যাশ অন ডেলিভারি বন্ধ করে দিয়েছে। অনলাইনে একটি পণ্য দেখাচ্ছে, বাস্তবে দিচ্ছে অন্য একটি। কেউ কেউ আবার দামের মাত্রা এত বেশি প্রথম দিকে হাঁকাচ্ছিল যখন ক্রেতারা বুঝতে পেরে, একটুখানি সাশ্রয়ের জন্য সামাজিক দূরত্ব না মেনেই যে কয়টি শপিংমল বা মহল্লার দোকান আছে সেগুলোতে সীমিত সামর্থ্যরে সর্বোত্তম ব্যয়ের জন্য ছুটছেন। তখন অনলাইন ব্যবসায়ীদের কোন কোন সাইটে আবার দাম কমানোরও হিড়িক পড়েছে। ঈদের আনন্দের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যও সীমিত আকারে চলছে। এতে কিছুটা হলেও অর্থনীতির লাভ হচ্ছে। অথচ অনলাইন ব্যবসায়ীরা যদি ঠিকভাবে পণ্য বিক্রি করত, তবে সরকার ভ্যাট আদায় করতে পারত আরও অধিকহারে এবং করোনাভাইরাসের কারণে মানুষ কম অসুস্থ হতো। কারোর সাধ জাগেনি, ইচ্ছে করে আনন্দ আয়েশের জন্য পণ্য কিনতে বাজারে ছুটতে। বরং নিরুপায় হয়ে একটি বৃহৎ অংশ দোকানে গিয়েছে। তারা পণ্য ক্রয় করেছেÑ কিন্তু ভ্যাট দিয়েছে কিনা সেটি তো আর তখন রাজস্ব বোর্ডের জানা থাকল নাÑ যদি কমদামী ও বেনামী প্রতিষ্ঠান হয়ে থাকে। তবে বাটার ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা অনলাইনে যে পণ্য বিক্রি করছেÑ ভ্যাটের পরিমাণও রশিদে উল্লেখ করে দিচ্ছে। এটি ইতিবাচক হিসেবে মনে করি। এবার ঈদ যেন কবি এমিলি ডিকিনসনের কাব্যকে বাস্তবে বিমূর্ত করে তুলেছেÑ যার বাংলা আমি রূপান্তর করছি ঃ ‘একাকিত্ব যা খুব বেশি সহজাত নয়/এবং অনুমিত হয় খুব শীঘ্রই/যেহেতু নদীর গভীরতা কবরের মতো/পরিসীমা নির্ধারণ করার জন্যে।’ আসলে নিস্তরঙ্গ জলধির মতো ঈদ হয়ত যারা পরিবার-পরিজন নিয়ে কাটাচ্ছেন তাদের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু যারা হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন, কিংবা আইসোলেশনে আছেন তাদের জন্য ঈদের আনন্দ অনেকখানি ম্লান হয়ে যাচ্ছে। আবার যারা দায়িত্বশীল পদে থেকে দায়িত্ব পালন করে বাড়ি ফিরবেন, ছোট ছেলে-মেয়ে থাকলে আগে থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। সেদিন ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকে মিট গুগলে উদ্যোক্তা অর্থনীতির ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ এবং শিক্ষকবৃন্দের আলাপ হচ্ছিল। একজন দায়িত্বশীল টিভি সাংবাদিক যিনি উদ্যোক্তা অর্থনীতির মাস্টার্সে দ্বিতীয়বারের মতো মাস্টার্স ডিগ্রী নিচ্ছেন, বলছিলেন যখন বাড়ি ফেরেন আগে থেকে ফোনে স্বামীকে বলেছেন বাচ্চাকে দূরে সরিয়ে রাখতে। জীবাণুমুক্ত হয়ে পরে বাচ্চাকে কাছে আসতে দেন। একই অভিজ্ঞতা তো আমাদের দেশে যারা ফ্রন্টলাইনে কাজ করছেন তাদের সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ঈদের দিনটিও এর ব্যতিক্রম হবে না। তাদের জন্য ঈদ আনন্দের হোক। ঈদতো বাঙালীদের কাছে সর্বজনীন উৎসবের মতো। ঈদের সঙ্গে অর্থনীতির চাকা ঘোরার লেনদেন সার্থকভাবে সরকার গত দশ বছর ধরে করে আসছে। দুটো ঈদে পরিবার পরিজন নিয়ে নাড়ীর টানে মানুষ গ্রামে যান এবং বেশ কিছুদিন গ্রামে থাকার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এবারে তার কিছুটা নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটবে। লকডাউনের জন্য যদিও ঢাকার বাইরে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তারপরও কেউ কেউ গ্রামে নাড়ির টানে যাচ্ছেন। প্রতি বছর ঈদের মৌসুমে নানা ধরনের খাবার সামগ্রী বিক্রি করে উৎপাদনকারী, মধ্যস্বত্বভোগী এবং বিক্রয়কারীদের যে আয়-রোজগার হয় তার পরিমাণ ষাট হাজার কোটি টাকার মতো হলেও এবারে সিংহভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। পোশাক তৈরির ক্ষেত্রে দর্জিদের সিংহভাগই বন্ধ। কিছু খোলা থাকলেও তাদের এক-চতুর্থাংশও আয় রোজগার হচ্ছে না। জুতো বেল্ট, কসমেটিক্স, জুয়েলারির বাজারও মন্দা। পরিবহন বাণিজ্য আকাশ-রেল-স্থল-নৌপথ প্রায় বন্ধ। ফলে পরিবহন শ্রমিকরাও সমস্যায় আছেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি এনজিওগুলো যে অর্থ-বিনিয়োগ করেছে তা অনাদায়ী। তাদের অনেক কর্মী এবার কর্মহীন অবস্থায় ঈদ করছে। অন্যদিকে ঈদকে ঘিরে ফ্যাশন ডিজাইন হাউসের প্রায় দুহাজার কোটি টাকার মতো ব্যবসার মুনাফা অর্জিত হচ্ছে না। করোনাভাইরাস যেন মানুষের জীবন থেকে আনন্দ ম্লান করে দিচ্ছে। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো যেমন আনন্দের, তার চেয়ে বেশি পরিবার পরিজনের আর্থিক নিরাপত্তা। সরকারের বহুমাত্রিক প্রয়াসের কারণে মানুষ অভুক্ত থাকবে না। কিন্তু ঈদের যে আনন্দ মেলা ও সর্বজনীনতা তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে-বিদেশে অনেকে পর্যটনে যায়। বিশেষ করে দেশের পর্যটন শিল্পের ক্ষেত্রে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হবে না। ভোগ্যপণ্যের বাজারে এবারে ঈদের সময়ে মোট ব্যয় গত বছরের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশের বেশি হবে না। বরং কোভিডের সঙ্গে যুক্ত ওষুধ, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সামগ্রীর ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবেও বিশাল ব্যয় হচ্ছে। গগলস, মাস্ক, গ্লাভস, ফেইস শিল্ড, পিপিই বিভিন্ন মানের বিভিন্ন দামে মানুষ এবার ওষুধের দোকান কিংবা খোলাবাজার থেকে সংগ্রহ করছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের পাশাাপাশি। এক্ষেত্রে অবশ্য একটি মোটা খরচ মানুষ ঈদকে ঘিরে ব্যয় করে চলেছেন। আসুন ঈদ উপলক্ষে সরকার প্রধান থেকে শুরু করে যারা প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষভাবে করোনা যোদ্ধা-পুলিশ, সেনাবাহিনী, র‌্যাব, সাংবাদিক, ব্যাংকার, ডেলিভারিম্যান এবং সত্যিকার অর্থে চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী, চিকিৎসক নার্স ল্যাব টেকনিশিয়ান ওয়ার্ড বয় এবং এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার ও মৃতদেহ দাফন কিংবা পোড়ানোর কাজকারী প্রত্যেককে নিজের ঘরে বসে যার যার ধর্মমতে তাদের জন্য স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। এবার ঈদ যেন জীর্ণতা দূর করে দেয়। দূর করে দেয় আমাদের অসৎ ভাবনাগুলো। শুভ ভাবনার উদয় হোক সবার মধ্যে। লেখক : ম্যাক্রো ও ফিনান্সিয়াল ইকোনমিস্ট এবং অধ্যাপক [email protected]
×