প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের অপ্রতিহত বিস্তার এবং মানবজীবন নিধনের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বিশ্বজুড়ে এক নির্দয় ও ভয়ঙ্কর মনস্তাত্ত্বিক, সম্ভাব্য স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক মন্দা-সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। ঝুঁকি মোকাবেলায় সচেতনতা, সতর্কতা অবলম্বন এবং পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণে বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসী ঐক্যবদ্ধ। উন্নত-অনুন্নত বিশ্ব, ধনী-গরিব, রাজা-প্রজা, শাসক-প্রশাসক, ধর্ম-বর্ণ, দল-মত নির্বিশেষে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির উদ্ভাসন নবতর এক অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এ সময়কালে বাঙালীর সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যিক অবগাহন বাংলার নববর্ষে শোকাবহ সংযোগ। কতিপয় অন্ধকারের শক্তি যারা নববর্ষ উদ্যাপনকে দীর্ঘ সময় হিন্দুয়ানী অনুষ্ঠান বলে বিভ্রান্ত করা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, তাদেরই কেউ কেউ হয়তো এ সুযোগে বলা শুরু করেছে ১লা বৈশাখ পণ্ড হয়ে গেছে।
কিন্তু ধার্মিক ও জ্ঞাননির্ভর সমাজ সমীক্ষণ প্রতিষ্ঠায় যাদের অবদান অম্লান, তাদের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত নববর্ষ কোন দৃশ্যমান আনুষ্ঠানিকতা নয়। আবহমান বাংলার চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনা-চর্যার অনানুষ্ঠানিক প্রতীয়মান দিদৃক্ষা বটে। এর মূলে রয়েছে সত্য-সুন্দর-মঙ্গল-কল্যাণ ও আনন্দবোধের অনবদ্য জীবন প্রবাহের রূপান্তরের অসাধারণ অনুষঙ্গ। হিজরী সনকে অবজ্ঞা নয়, হিজরী ৯৬৩ সালকে তাৎপর্যপূর্ণ মর্যাদায় সূর্যকে মানদ- ধরে এটিকে সৌরবর্ষ বা ফসলি সনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স¤্রাট আকবর। তাঁরই শাসনকালে সৌর বছর (বঙ্গাব্দ) ও চান্দ্রবর্ষকে (হিজরী) এককমাত্রায় নির্ধারণে রাজজ্যোতিষী আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজীর সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশ বিবেচনায় শুভক্ষণ গণনার দিন হিসেবে ১ বৈশাখকে নববর্ষ উদযাপনের দিন ধার্য করা হয়।
প্রাসঙ্গিকতায় উল্লেখ করা যায় রবি ঠাকুরের অমর ‘শিশুতীর্থ’ কবিতার কয়েকটি পঙক্তি। ধর্মের নামে অপপ্রচারণার বিরুদ্ধেই তিনি বলেছেন, ‘চলেছে পঙ্গু, খঞ্জ, অন্ধ আতুর,/ আর সাধুবেশী ধর্মব্যবসায়ী,/ দেবতাকে হাটে-হাটে বিক্রয় করা যাদের জীবিকা।’ এই প্রসঙ্গে জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম তাঁর ‘কা-ারী হুঁশিয়ার’ কবিতায় বলেছেন, ‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,/ কা-ারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ।/ ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?/ কা-ারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!’ একদিকে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ক্ষুদ্র সঙ্কীর্ণকতা, অন্যদিকে ব্রিটিশ বেনিয়াদের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে কবি সোচ্চার কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন, ‘আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?/ স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাড়াল।/দেব-শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি/ভূ-ভারত আজ কসাইখানা,-আসবি কখন সর্বনাশী?’
উপরোল্লিখিত পন্থায় এভাবেই মানবিকতা, ধার্মিকতার জয়গানে সভ্যতা নন্দিত হয়েছে এবং ধর্মান্ধ, অকল্যাণকর, জীর্ণতা, কূপম-ূকতা, পুরনো গ্লানি বা কালিমা ইত্যাদি বরাবরই পরাজিত ও নিন্দিত হয়েছে। স্বদেশ মানস রচনায় বাঙালী সংস্কৃতি, কৃষ্টি-ঐতিহ্য সর্বোপরি ইতিহাসের আলোকে রক্ষণশীল ও পশ্চাৎপদ চিন্তা-চেতনাকে পরিহার করে আধুনিক ও প্রাগ্রসর অভিধায় জাতিসত্তাকে যথাযথ প্রতিভাত করার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি বাংলা নববর্ষকে দান করেছে অনবদ্য মাঙ্গলিক যাত্রাপথ। বিশেষ করে দেশের প্রায় বত্রিশ শতাংশ তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে ইতিবাচক প্রবহমানতায় অপসংস্কৃতিকে পরিহার করে প্রত্যভিজ্ঞা সুস্থ বাঙালী সংস্কৃতি-মুক্তির অরিন্দম রাগিণী হিসেবেই গ্রহণযোগ্য হয়েছে। এই অশ্রান্ত তরুণসমাজই কঠিন মহামারী প্রতিরোধে তাদের নান্দনিক ও মানবিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
বাংলার সমাজ ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, বর্তমান ভৌগোলিক সীমারেখা নিয়ে বাংলাদেশ নামক এই অঞ্চলের মানব-গোষ্ঠীর কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, ধর্ম, চিন্তা- চেতনা ইত্যাদি ইতিহাসের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সংমিশ্রণ, সংযোজন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে আজকের অবস্থানে উপনীত হয়েছে। বস্তুত গাঙ্গেয় এ ব-দ্বীপ এলাকায় বাঙালীরা বসবাস শুরু করেন এ অঞ্চলে আর্যদের আগমনের প্রায় পনেরো শ’ বছর আগে। দ্রাবিড় সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত এই জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের উৎসে ছিল কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি। আর্যদের দখলে আসার পর রাজনীতি, ভাষা-সংস্কৃতি ইত্যাদির বিষয়ে আর্য ও অনার্যদের মধ্যে সংঘাত শতাব্দীর পর শতাব্দী অব্যাহত থাকলেও শ্রী দুর্গাচন্দ্র সান্যালের ভাষায়, ‘বৈদিক যুগ থেকে আর্যরা অনার্য সভ্যতা গ্রহণ শুরু করে।’
মোহাম্মদ আবদুল হাই সঙ্কলিত ও সম্পাদনায় ’বাঙালীর ধর্মচিন্তা’ গ্রন্থের ভূমিকায় চমৎকারভাবে উল্লিখিত বিষয়ের অবতারনায় উল্লেখ করেছেন যে, মোগল আমলের বাংলা সমাজ প্রধানত হিন্দু, মুসলমানÑএ দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অবস্থান তখন প্রায় অবলুপ্তির পথে ছিল। বাঙালী সমাজের এ দুটি সম্প্রদায়ের পরস্পরবিরোধী মৌলিক আদর্শগত বিভাজনটি বিকশিত হয়েছিল ধর্ম, দর্শন, আচার-আচরণ, নিরাকার-আকার, একেশ্বর ও বহুত্ববাদকে কেন্দ্র করে। এই বিভাজনই প্রকৃতপক্ষে বিরোধ, বিদ্বেষ, হিংসা, প্রতিহিংসা ইত্যাদির যাঁতাকলে এ দুই সম্প্রদায়কে আড়ষ্ট করে রেখেছিল। এ উভয় সম্প্রদায়ের সৃজনশীল গোষ্ঠী কেন জানি মনন-চিন্তনের বেড়াজালে নিজেদের আবদ্ধ করে স্ব স্ব ধর্ম ও সমাজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে সচেষ্ট ছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, একদিকে ভীষণ ধরনের ব্যবধান সৃষ্টি হলেও প্রাত্যহিক সমাজ জীবনে সহঅবস্থান, শ্রেণী চরিত্র, পারস্পরিক লেন-দেন, আদান-প্রদান ইত্যাদি এ দুই সম্প্রদায়কে আবার প্রেম-প্রীতি, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির অপরূপ মেলবন্ধনেও আবদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশে বাঙালী জাতি ছাড়াও বিভিন্ন উপজাতি যেমন - চাকমাদের ‘বিঝু’, ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’, তংচঙ্গ্যাদের ‘বিষু’, অহমিয়াদের ‘বিহু’ এবং সর্বোপরি পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর বৈসাবি উৎসবের মাধ্যমে বর্ষ বিদায় ও বরণ তাদের ঐতিহ্য ও আভিজাত্যকে সামাজিক সংহতি ও ঐক্যের বন্ধনকে সুদৃঢ় রাখার বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে এখনও বরেণ্য ভূমিকা পালন করছে। নিজস্ব বর্ষ পঞ্জিকার সূত্র ধরে নববর্ষের বিভিন্ন উৎসব উদযাপনের মাধ্যমে বংশ পরম্পরায় তারা সমাদৃত। বাংলাবর্ষ বিদায় ও নববর্ষের অবগাহন আজ শুধু গ্রাম বাংলায় নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি নগর, শহরসহ যে কোন অঞ্চলে এমনকি বিশ্বের নানা দেশে প্রবাসী বাঙালীদের আনন্দ উদ্যাপনের বিশেষ দিন হিসেবে তার মহিমায় ভাস্বর।
নববর্ষের বাংলা সনের ‘সন’ শব্দটি আরবী, পহেলা বৈশাখের ‘পহেলা’ শব্দটি ফরাসী এবং বছরের প্রারম্ভে ব্যবসা বাণিজ্যে প্রচলিত ‘হালখাতা’ শব্দটি ইসলামী। মুঘল স¤্রাট আকবর ৯৬৩ হিজরী (চান্দ্র বর্ষ) ২ রবিউসসানি, রোজ শুক্রবার, ইংরেজী ১৪ এপ্রিল ১৫৫৬ সাল থেকে ১ বৈশাখ পালনের রেওয়াজ শুরু করেন। সৌর বছর (বঙ্গাব্দ) ও চান্দ্রবর্ষ (হিজরী) উভয়ের অপূর্ব সন্ধিক্ষণে রাজজ্যোতিষী আমির ফতেউল্লাহ সিরাজীর সূক্ষè হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে শুভক্ষণ গণনার দিন হিসেবে ১ বৈশাখকে নববর্ষ উদযাপনের দিন হিসেবে ধার্য করা হয়।
আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে এই, বর্ষ গণনায় সে সময় প্রতিটি মাসের ৩০ বা ৩১ প্রতিটি দিনের নামও ছিল ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু স¤্রাট আকবরের পৌত্র স¤্রাট শাহজাহানই বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের নামানুসারে পুরো মাসকে সপ্তাহে বিভক্ত করে দিনগুলোর নামকরণ করেছিলেন এবং পাশ্চাত্য ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রবিবারকে সপ্তাহের ১ম দিন হিসেবে ধার্য করেছিলেন। সূর্য দেবতার নামানুসারে রবিবার, শিব দেবতার নামানুসারে সোমবার, মঙ্গল গ্রহের নামানুসারে মঙ্গলবার, বুধ গ্রহের নামানুসারে বুধবার, বৃহস্পতি গ্রহের নামানুসারে বৃহস্পতিবার, শুক্র গ্রহের নামানুসারে শুক্রবার এবং শনি গ্রহের নামানুসারে শনিবার রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
অতএব ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে, এই বঙ্গাব্দের প্রচলন এবং এই নববর্ষকে বরণ করার যে প্রক্রিয়া বা অনুষ্ঠান তা সকল কিছুই মুসলমান শাসকদেরই সৃষ্ট এবং চিরায়ত বাংলা সংস্কৃতিরই পরিবর্তিত বাহন। এটি শুধু বাঙালী জাতীয় কৃষ্টিকে সমৃদ্ধ করে না, বাঙালী সমাজের কৃষি ও অন্যান্য আর্থ-সামাজিক প্রতিটি প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকা-ে নতুন অলঙ্কারে ভূষিত। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করে শাশ্বত ঐতিহ্য ও কৃষ্টি চর্চায় বিকৃত মানসিকতার সন্নিবেশ ঘটানোর লক্ষ্যে এই অপ-প্রচারণা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই নববর্ষ প্রচলন ও উদযাপনে হিন্দুয়ানি বা হিন্দু সংস্কৃতির যে লেশমাত্র সংশ্লিষ্টতা নেই, এটি অত্যন্ত স্পষ্ট ও উজ্জ্বল।
অসাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মনিরপেক্ষতা প্রত্যয়টির উৎসমূলে ছিল ১৮০২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের অমিয় বার্তা। তাঁর ডানবুরি ব্যাপ্টিসদের কাছে লিখিত চিঠির আলোকে আমেরিকার সংবিধানে সংশোধন সাপেক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মূলত এই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সূচনাপাঠ হয়েছিল ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসী বিপ্লবের বিজয়গাঁথায়। ১৮৪৬ সালে ভাষা ও সাহিত্যে এই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন ব্রিটিশ লেখক জর্জ জ্যাকব হলিওয়েফ। এর একশ’ বছর পর ১৯৪৬ সালে এই উপমহাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ শব্দটি রাষ্ট্র চিন্তায় প্রথম ব্যবহার করেন জওহরলাল নেহরু। যদিও ভারত বিভাগের পূর্বে ও পরে মহাত্মা গান্ধী এই প্রত্যয়টির ব্যবহার শুরু করেন।
একই ধারায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। বাঙালীর ঐক্যের ও সম্প্রীতি-সৌহার্দ্যরে সাবলীল প্রজ্ঞার যোগসূত্র। এটিই ধর্মনিরপেক্ষতা, এটিই অসাম্প্রদায়িকতা। মোদ্দা কথা, সকল মানব একই স্রষ্টার সৃষ্ট। এই উপলব্ধি আজ বিশ্ব পরিম-লে নিরন্তর পরিক্রমায় বিশ্ববাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে করোনভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রভঞ্জন যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে মনস্তাত্ত্বিক শক্তিমানতা, উদারতা এবং নববর্ষের মতো বৈশ্বিক সম্প্রীতির সমীকরণে নবতর দীপ্যমান বিজয়-অধ্যায় সূচিত করেছে। জয় হোক মানবতার, জয় হোক সম্প্রীতির। বাংলা নববর্ষের ধূসর-দীপিত শুভেচ্ছায় মানব সভ্যতা করোনাযুদ্ধে জয়ী হোক- এই প্রার্থনাই নিবেদন করছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
করোনাকালে নববর্ষ ॥ সম্প্রীতির বৈশ্বিক সমীকরণ
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: