ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

লকডাউনে ডিজিটাল দুনিয়ার মজে থাকালে শিশুদের মানসিক সমস্যা হতে পারে

প্রকাশিত: ০৮:৫১, ৫ এপ্রিল ২০২০

লকডাউনে ডিজিটাল দুনিয়ার মজে থাকালে শিশুদের মানসিক সমস্যা হতে পারে

স্কুল বন্ধ। কোচিং বন্ধ। খেলা বন্ধ। বেরনো বন্ধ। ঘরবন্দি বাচ্চা তবে করবেই বা কী! দিনরাত তাই ভিডিও গেম। কার্টুন। সিনেমা। চিন্তিত বাবা-মা। স্ক্রিনটাইম এত বেড়ে গেলে চোখের আবার ক্ষতি হবে না তো! চক্ষু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “যে অর্থে চোখের ক্ষতি আমরা ভাবি, পাওয়ার বাড়া বা চোখের কোনও অসুখ হওয়া, সে সব কিছু হয় না স্ক্রিনটাইম বাড়লে। চোখে একটু বেশি চাপ পড়ে। যত বেশি সময় পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকে, তা সে স্মার্টফোন হোক কি নোটবুক, আই প্যাড হোক কি ই-বুক, টিভি বা ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, তত বেশি চাপ, যাকে আগে কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম বলা হত, এখন বলে ডিজিটাল আই স্ট্রেস। এর কতগুলি উপসর্গ আছে, যেমন, চোখ বা মাথাব্যথা, চোখ ক্লান্ত লাগা, ঝাপসা দেখা, চোখ লাল হওয়া, কড়কড় করা, ঘাড়ে-কাঁধে-পিঠে ব্যথা, ক্লান্তি, বিরক্তি ইত্যাদি। বাবা-মা একটু সতর্ক হলে এ সব সহজেই সামলে ফেলা যায়। কাজেই চিন্তা করার কিছু নেই।” কেন হয় ডিজিটাল স্ট্রেস : মিনিটে যত বার শ্বাস চলে তত বারই চোখের পলক পরার কথা। অর্থাৎ, মিনিটে ১৮ বার। যাতে কিছু তৈলাক্ত ও কিছু জলীয় পদার্থ সমান ভাবে চোখের মণির উপর ছড়িয়ে পড়ে চোখকে সুস্থ ও সবল রাখতে পারে। এক মনে কম্পিউটার বা মোবাইল নিয়ে খেলে গেলে ১৮ বারের বদলে ৫-৯ বার পড়ে পলক। জল ও তেলের অভাবে চোখ শুকোতে থাকে। দেখা দেয় ড্রাই আই সিনড্রোমের উপসর্গ। এসির হাওয়ায় ঘরের আদ্র্রতা অনেক কমে যায় বলে ঠান্ডা ঘরে বসে কাজ করলে সমস্যা বাড়ে। এ ছাড়া অনেক ক্ষণ টানা বসে থাকলে মণিকে ক্রমাগত স্ক্রিনের চারপাশে ঘোরাতে হয় বলে পেশিতে চাপ পড়ে চোখ ক্লান্ত হয়। সেই ক্লান্তি ছড়িয়ে পড়ে শরীরে। চোখ ব্যথার রেশ ছড়ায় মাথায়, ঘাড়ে। সমাধানের উপায় : “ওষুধপত্র সবই আছে। প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়। নিয়মও আছে বিস্তর। সে সব মানলেও সমস্যা কম থাকে। কিন্তু চোখ ঠিক থাকলেই তো আর সব হয় না! এ ভাবে সময় নষ্ট করলে অন্য ক্ষতিও হয়। কাজেই সে সব দিকেও খেয়াল রাখুন,” বললেন জ্যোতির্ময় দত্ত। এর পাশাপাশি চোখের সমস্যা কম রাখতে কী অভ্যাস তৈরি করতে হবে, তা দেখে নিন। • ৪-৫ বছর বয়সের আগে বাচ্চার হাতে মোবাইল দেবেন না। নিজের সুবিধের জন্য টিভির সামনেও বসিয়ে রাখবেন না। যদি ইতিমধ্যেই সে রকম করে থাকেন, এখন হঠাৎ বন্ধ করতে পারবেন না। তবে সময়টা যাতে কমিয়ে আনা যায়, এই লকডাউনের সময়ে সেই চেষ্টা করুন। ৫ বছরের পর ২ ঘণ্টা, ৬-১০ বছর বয়স হলে ৪ ঘণ্টা, উঁচু ক্লাসে পড়লে বড়জোর ৬ ঘণ্টার বেশি টিভি বা মোবাইলের পিছনে সময় দেওয়া ঠিক নয়। কী ভাবে সেই অভ্যাস গড়ে তুলতে পারবেন, তা ভাল করে ভেবেচিন্তে ঠিক করুন। বাচ্চা কার্টুন বা সিনেমা দেখলে তবু ঠিক আছে। কিন্তু গেম খেলার অভ্যাস থাকলে বিপদ। কারণ, খেলার সময় মন এত একাগ্র থাকে যে পলক পড়া আরও কমে যায়। কাজেই নিয়ম করে দিন যে দিনে একটার বেশি গেম খেলবে না। সেই সময় বাচ্চাকে গল্প বললে বা তার সঙ্গে খেললে কি ঘরের কাজে তাকে সঙ্গী করে নিলে নতুন অভ্যাস গড়ে তোলা যায় কি না দেখুন। • চোখের ক্ষতি কমাতে ল্যাপটপ, টিভি, মোবাইলের উজ্জলতা ও কনট্রাস্ট কমিয়ে রাখুন। ঘরের আলো যেন তার চেয়ে কম উজ্জ্বল হয়। দরকার হলে দু-একটা আলো নিভিয়ে দিন। খোলা জানলা বা চড়া আলো পিছনে না থেকে যেন পাশে থাকে, বাঁ-দিকে থাকলে বেশি ভাল। না হলে পর্দায় তা প্রতিফলিত হয়ে সমস্যা বাড়াবে। খেয়াল রাখবেন বাচ্চা যেন অন্ধকার ঘরে মোবাইল বা টিভি না দেখে। • টিভি দেখার সময় বাচ্চা, বুড়ো সবাই ৮-১০ ফুট দূরে বসুন। ঠিক করে নিন যে বাড়ির কেউই দিনে এক-আধ ঘণ্টার বেশি টিভি দেখবেন না। অন্য সময় একসঙ্গে বসে গল্প করবেন কি বই পড়বেন কি গঠনমূলক কিছু করবেন। নিজেদের অভ্যাস বদলালে তবেই বাচ্চার অভ্যাস বদলাতে পারবেন। • কম্পিউটারে বসলে মনিটর যেন ২০-২২ ইঞ্চি দূরে চোখের সমান্তরালে বাচ্চার বিপরীতে ১০ ডিগ্রি হেলে থাকে। চোখের লেভেল থেকে স্ক্রিন একটু নীচে থাকলেও চোখে কম চাপ পড়ে। • এক ফুট দূরে রেখে মোবাইল দেখার অভ্যাস করান। অর্থাৎ, বই পড়ার সময় যে দূরত্ব থাকে। যদি দেখেন সে আরও কাছে এনে দেখছে, লকডাউন খুললেই চোখ দেখিয়ে নেবেন। অনেক সময় মাইনাস পাওয়ার এলে এ রকম হয়। • মোবাইলে স্ক্রিন যত বড় হয় তত ভাল। ট্যাব হলে আরও ভাল। • আধঘণ্টার বেশি এক জায়গায় টানা বসে থাকতে দেবেন না। কাছে এসে একটু গল্প করুন, খেলুন, কম করে ৫-১০ মিনিট। বা তার পছন্দের কোনও কাজে ব্যস্ত করে দিন। মোবাইল নিয়ে খেলার সময় মাঝেমধ্যে জলের ঝাপটা দিয়ে চোখ-মুখ ধুয়ে দিন। • দু-এক ঘণ্টা বাদে বাদে যেমন হাত সাবান-জলে ধুইয়ে দিচ্ছেন, একগ্লাস জল বা অন্য কোনও তরলও খাওয়াবেন। • ২০ : ২০ : ২০-র এক নিয়ম আছে। অর্থাৎ, ২০ মিনিট অন্তর মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে ২০ ফুট দূরের কোনও বস্তুর দিকে ২০ সেকেন্ড তাকিয়ে থাকা ও ২০ বার চোখ পিটপিট করা। এতে চোখে চাপ কম পড়ে। এই সময় বাচ্চাকে ব্যাপারটা শিখিয়ে দিন। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। • গদিআঁটা চেয়ারে সোজা হয়ে বসতে বলুন। পা যেন মাটিতে পৌঁছয়। এতে ঘাড়ে-কোমরে চাপ কম পড়বে। • বাচ্চার চোখে যদি পাওয়ার থাকে, ৬ মাস বাদে বাদে চক্ষু চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া বাধ্যতামূলক। এখন যদি সেই ডেট থেকে থাকে লকডাউন কাটলেই যাতে দেখাতে পারেন সেই ব্যবস্থা করে রাখুন। • নিয়ম মানার পরও যদি সমস্যা হতে থাকে দিনে ২-৩ বার নকল চোখের জলের ড্রপ দিতে হতে পারে। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন। • নিশ্চিন্ত থাকুন, এখন আর কিছু করার নেই বলে যতই টিভি দেখুক, যতই মোবাইল ঘাঁটুক, চোখের বা শরীরের কোনও স্থায়ী ক্ষতি হবে না। তা বলে কোনও ক্ষতিই হবে না, এমন কিন্তু নয়। মনোচিকিৎসকরা জানিয়েছেন, “সারাক্ষণ ডিজিটাল দুনিয়ায় পড়ে থাকলে সাধারণ অমনোযোগ থেকে শুরু করে অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার নামে মানসিক সমস্যা হতে পারে। বাড়তে পারে ওজন। কার্টুন বা গেমের মতো মজার দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকার পর পড়াশোনার মতো নীরস বিষয় আগ্রহ কমে যেতে পারে। কাজেই এ সব দিকেও বিশেষ নজর রাখুন। এখন তো হাতে বেশ খানিকটা সময় এসে গিয়েছে, কাজেই বাচ্চাকে একটু বেশি সময় দিন। বাইরের দুনিয়া চিনতে শেখান। নিজেরাও চিনুন। ফেসবুক, হোয়্যাটসঅ্যাপে মজে থাকার বদভ্যাস কাটিয়ে ফেলুন নিজেরাও। পুরো পরিবারেরই মঙ্গল হবে তাতে।” সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
×