ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জিকোর অনন্য কীর্তি

প্রকাশিত: ০৯:৫৮, ২৫ মার্চ ২০২০

জিকোর অনন্য কীর্তি

এশিয়ায় সপ্তাহের সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশের ক্লাব বসুন্ধরা কিংসের গোলরক্ষক আনিসুর রহমান জিকো। গত ১১ মার্চ এএফসি কাপের ম্যাচের পর সেরা পাঁচ পারফর্মেন্স বিবেচনা করে ফুটবলপ্রেমীদের জন্য ভোটিংয়ের ব্যবস্থা করে এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (এএফসি)। পাঁচ ফুটবলারের মধ্যে দুজনই ছিলেন বসুন্ধরা কিংসের। অন্যজন আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড হার্নান বার্কোস (জাতীয় দলে লিওনেল মেসির সাবেক সতীর্থ)। শুক্রবার ছিল ভোট গ্রহণের শেষ দিন। ১ হাজার ৯৫৪ জন ভোট দিয়েছেন। মোট ভোটের মধ্যে ৭৫ শতাংশ ভোট পেয়ে সেরা হন জিকো। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন তার সতীর্থ বার্কোস। তিনি পান মাত্র ১৪ শতাংশ ভোট। অন্য তিনজনের কেউই ১০ শতাংশের বেশি ভোট পাননি। আনিসুর রহমান জিকো মালদ্বীপের টিসি স্পোর্টসের বিপক্ষে তিনটি পেনাল্টি শট রুখে দিয়েছিলেন। ওই ম্যাচে বার্কোস হ্যাটট্রিকসহ চার গোল করেছিলেন। চার গোল করলেও ৯০ মিনিটের ম্যাচে তিনটি পেনাল্টি শট ঠেকিয়ে চমক দেখিয়েছিলেন জিকো। বসুন্ধরার স্প্যানিশ কোচ অস্কার ব্রুজোন যেটাকে বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম বিশেষ ঘটনা বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত এএফসি কাপের ম্যাচে টিসি স্পোর্টসকে বসুন্ধরা কিংস ৫-১ গোলে হারিয়েছিল। এর আগে গত মৌসুমে এএফসি কাপে ঢাকা আবাহনীর মামুনুল ইসলামের গোল এএফসি কাপের সপ্তাহের সেরা গোল হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল ভোটে। এর আগে ১৯৯৭ সালে আলফাজ আহমেদ এএফসির প্লেয়ার অব দ্য মান্থ হয়েছিলেন। মাদ্রসার সহপাঠীদের নিয়ে বিকেলে যখন বল নিয়ে ধান কেটে ফেলা জমিতে নেমে পড়তেন তখন বেছে নিতেন ফরোয়ার্ড পজিশনটা। কখনও পেশাদার ফুটবলার হবেন, কিংবা কখনও জাতীয় দলের জার্সিতে দেশের জন্য খেলবেন এমনটি কল্পনাতেও ছিল না। তবে ফুটবল খেললে স্ট্রাইকারই হবেন- এমন ইচ্ছে ছিল। বাকি পজিশনগুলো তার পছন্দের ছিল না। বিশেষ করে গোলপোস্ট তো নয়ই। সবাই বল নিয়ে মাঠজুড়ে ছোটাছুটি করবেন আর সে পোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে দেখবেন, কখন বল আসবে কখন ধরবেন বা ঠেকাবেন- এসব কারণে গোলরক্ষক হওয়াটা মোটেও পছন্দের ছিল না সেই আনিসুর রহমান জিকোর। অথচ গোলপোস্ট অপছন্দ করা সেই জিকোই এখন বাংলাদেশ ছাপিয়ে খ্যাতি পেয়েছেন এশিয়ার ‘দ্য ওয়াল’ হিসেবে! কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারার বালুচরের যুবক জিকো সম্প্রতি এএফসি কাপে সপ্তাহসেরা পারফর্মার নির্বাচিত হয়েছেন। এশিয়ান ফুটবলের অভিভাবক সংস্থাটির নিজস্ব ওয়েবসাইট দর্শকদের ভোটের মাধ্যমে বাছাই করা ৫ জনের একজনকে সেরা নির্বাচিত করেছে। গত বছর বসুন্ধরা কিংসের জার্সিতে দুর্দান্ত পারফর্মেন্স দেখিয়েই আলোচনায় এসেছিলেন কক্সবাজারের লবণ ব্যবসায়ী মনজুর আলম ও গৃহিণী দিলদার বেগম দম্পতির বড় ছেলে জিকো। তার ছোট ভাই উচ্চ মাধ্যমিকে পড়েন, তিন বোন বড়। ২০১৩ সালে ক্লাব ফুটবলে অভিষেক চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বিভাগ লিগে কল্লোল সংঘের হয়ে। এরপর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে ফরাশগঞ্জ, মুক্তিযোদ্ধা, চট্টগ্রাম আবাহনী, সাইফ স্পোর্টিং ক্লাব হয়ে চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংসে। স্বপ্নের পরিধি ছাড়িয়ে পেশাদার ফুটবলার হয়েছেন। অপেক্ষায় আছেন লাল-সবুজ জার্সি গায়ে পোস্টের নিচে দাঁড়ানোর। গত ১১ মার্চ এএফসি কাপে বসুন্ধরার জার্সিতে মালদ্বীপের টিসি স্পোর্টসের তিনটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে আবারও আলোচনায় এসেছেন এই গোলরক্ষক। এবার ঘরোয়া গ-ি পেড়িয়ে জিকোর নৈপুণ্যের দ্যুতি ছড়িয়েছে গোটা এশিয়ায়। তাইতো এএফসির ওয়েবসাইট তাকে দিয়েছি ‘দ্য ওয়াল’ উপাধি। যে পোস্টের নিচে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে এশিয়ায় নামডাক, জিকোর অপছন্দ ছিল সেই গোলপোস্ট। কিভাবে ফুটবলার হলেন, কিভাবে হলেন গোলরক্ষক- সেই গল্পটাই বলছিলেন জিকো। ‘চকরিয়ার ডুলাহাজারা ইসলামিয়া আরাবিয়া দাখিল মাদ্রাসায় তখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র জিকো। বিকেল হলেই সহপাঠীদের নিয়ে বল নিয়ে নেমে যেতেন পাশের ধান কেটে ফেলা জমিতে। খেলতেন স্ট্রাইকার পজিশনে। তবে নিজ মহল্লায় যখন নিজেরা দুই দলে ভাগ খেলতেন তখন কোন গোলরক্ষক পাওয়া না গেলে সে দায়িত্ব পড়ত জিকোর ওপর। নিজের অনিচ্ছার পরও দাঁড়াতে হতো গোলপোস্টের নিচে। এভাবেই স্ট্রাইকার জিকো হয়ে গেলেন গোলরক্ষক। মহল্লার ফুটবলে জিকোর খেলা নজরে আসে এলাকার বড় ভাই জমিরের। ২০১৩ সালে জমির তখন পুরনো ঢাকার ক্লাব ফরাশগঞ্জের অধিনায়ক। স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে জিকোর খেলা দেখে তাকে ঢাকায় খেলার প্রস্তাব দেন জমির। টিকে যান ফরাশগঞ্জের ট্রায়ালে। এর আগেই তিনি ক্লাব ফুটবলে খেলেন চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বিভাগের দল কল্লোল সংঘে। টাইব্রেকার ঠেকানোর অভ্যাস তখন থেকেই জিকোর। ‘পুলিশ দলের সঙ্গে আমাদের পয়েন্ট সমান হলে একটি ম্যাচ খেলতে হয় চ্যাম্পিয়নশিপ নির্ধারণের জন্য। ম্যাচটি গোলশূন্য ড্র হওয়ায় ভাগ্য নির্ধারণ হয় টাইব্রেকারে। তিন-তিনটি শট ঠেকিয়ে আমি দলকে চ্যাম্পিয়ন করিয়েছিলাম’- বলছিলেন জিকো। গত বছর স্বাধীনতা কাপে বসুন্ধরা কিংসকে চ্যাম্পিয়ন করানোর পেছনে বিশাল অবদান ছিল জিকোর। কোয়ার্টার ফাইনালে রহমতগঞ্জের বিরুদ্ধে টাইব্রেকারের তিনটি এবং সেমিফাইনালে আবাহনীর বিরুদ্ধে টাইব্রেকারে দুটি শট ঠেকিয়েছিলেন তিনি। এছাড়া ফেডারেশন কাপেও দুটি পেনাল্টি ঠেকিয়েছিলেন। তবে কক্সবাজারের এ যুবক অনন্য উচ্চতায় উঠেছেন এএফসি কাপে তিনটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে। ‘বড় আসরে সেরা হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এটা কেবল আমার অর্জন নয়, বাংলাদেশের ফুটবলেরও অর্জন। আবারও প্রমাণ হলো এশিয়ার ফুটবলেও আমরা বাংলাদেশকে ভালভাবে উপস্থাপন করতে পারি। আমাদের দেশের ফুটবলের জন্য ইতিবাচক দিক এটা’-এএফসি সপ্তাহসেরা পারফর্মার হওয়া প্রসঙ্গে জিকো। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নির্দিষ্ট কোন গোলরক্ষক তার প্রিয় নয়। যখন যে ভাল খেলেন তখন তার খেলাই ফলো করেন। বাংলাদেশেও তাই। তবে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক গোলরক্ষক আমিনুল হককে বেশি ফলো করতেন আনিসুর রহমান জিকো। জাতীয় দলের স্কোয়াডে আছেন অনেকদিন ধরে। তবে এখনও আন্তর্জাতিক ম্যাচে পোস্টেও নিচে দাঁড়ানো হয়নি। থাইল্যান্ড ও কাতারের ক্লাবের বিরুদ্ধে খেলেছেন। এখন জিকোর একটাই অপেক্ষা-কবে অবসান হবে জাতীয় দলের জার্সিতে অভিষেক। ২০০৯ সালে ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু জিকোর। কক্সবাজার অ-১৬ ট্রায়াল দিয়ে উত্তান। ২০১৩ সালে কক্স সিটির হয়ে চ্যাম্পিয়নশিপ লীগ খেলে। এখন দেখার বিষয়, আগামীতে অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে আরও কতটা উন্নতি করেন জিকো।
×