ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্ষণ কি ধর্ম ও মানবাধিকার বিরোধী নয়?

প্রকাশিত: ০৯:২৯, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ধর্ষণ কি ধর্ম ও মানবাধিকার বিরোধী নয়?

এ কথা আগেও লিখেছি যে, ধর্ষকের বিরুদ্ধে তথাকথিত মৌলানাদের তেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যায় না। এটি আশ্চর্যজনক এবং তাৎপর্যপূর্ণও বটে। অনেক ইমাম-মৌলানার নারীর স্বাধীন চলাফেরা, পোশাক, উচ্চশিক্ষা, নারী-পুরুষের একত্রে চাকরি করার ওপর বিতর্কিত বক্তব্য শুনতে পাওয়া যায়। এমনকি নারীকে তেঁতুলের সঙ্গেও তুলনা করা হয়! অথচ, শিশু, বালিকা, তরুণী, এমনকি কিশোর, বালককে ধর্ষণকারী, যৌন নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে মসজিদে নামাজ শেষে খুৎবায় এবং পাড়া-মহল্লায় তেমন কঠোর সমালোচনা করতে শোনা যায় না! ধর্ষকদের বিচারে সোপর্দ করতে, দণ্ড দিতেও উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। অথচ এটি ধর্ম বিরোধী চরম একটি অপরাধ। পুরুষ কি শুধু ধর্ষিতা যদি তার স্ত্রী, বোন, কন্যা হয়- তাহলেই প্রতিবাদ করবে? অন্যের স্ত্রী, বোন, কন্যার ধর্ষণের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করবে না? তবে, এর চাইতে অনেক নির্মম-নিষ্ঠুর পিতার তথ্যও সংবাদপত্র সূত্রে জানা যাচ্ছে। এসব বিকারগ্রস্ত পিতাকে পিতা বললে সে সম্পর্কটিকে অসম্মান করা হয়। অথচ এমন পিতা নিজ কন্যাকে ধর্ষণ করেছে, নিজ কন্যাকে তার কোন বাড়িওয়ালা বা প্রতিবেশীকে নিয়মিত বছরব্যাপী ধর্ষণ করতে দিয়েছে। হয়তো কোন সুবিধা আদায়ের বদলে অবুঝ-অসহায় কিশোরী তার পক্ষে অবোধ্য ক্রিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় রুটিনের মতো। এমন অকল্পনীয় মানবতার স্খলন সহ্যের অতীত হয়ে উঠেছে। মনে পড়ছে, কোন এক প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত অবস্থায় এক তরুণী সহকর্মী বলেছিল, তার উঠতি বয়সী দুই খালাত বোনকে কিভাবে তার খালু, অর্থাৎ ঐ দুই কিশোরীর যৌন লোলুপ পিতার হাত থেকে রক্ষার জন্য তার খালা, মা ও নিজে কি করা যায় সে উপায় বের করার চেষ্টায় কঠিন সময় পার করছে। স্বাভাবিকভাবেই আমাকেও কি উপায় হতে পারে তরুণীটি জিজ্ঞেস করেছিল। পরামর্শ দিয়েছি। কিন্তু সেসব ঐ ক্ষিপ্ত অসুরের মতো মহিষ পুরুষের হাত থেকে কচি দুটি প্রাণ রক্ষা করতে পেরেছিল কিনা। জানতে পারিনি। তবে, ভুলিনি তাদের। ভাবছি, বাঙালী পুরুষেরা এখন আমাদের ’৭১-এর বীরাঙ্গনাদের, ধর্ষণকারী ঐ পাক সেনাদের কাছে মুখ দেখাবে কিভাবে? কিভাবেই বা আমরা বলবÑ ‘৭১-এ খান সেনারা আমাদের কয়েক লাখ বাঙালী নারীকে ধর্ষণ করেছে, অনেককে অন্তঃসত্ত্বা করেছে! সমাজ দেহকে দুর্নীতি, মাদক, জঙ্গী, মৌলবাদমুক্ত করার চেষ্টার পাশাপাশি এই চরম অগ্রহণযোগ্য মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিকে সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে। যার কোন বিকল্প নেই। এটি ধর্মজীবী শ্রেণীর মানুষ, যারা ধর্মের কোরান-হাদিস অনুসারী, পবিত্র চরিত্র রক্ষার, রোজা, নামাজ, মিলাদ পড়ান, তাদেরও এই সামাজিক ব্যাধি নিরসনের জন্য নানা উপায় বের করে অন্তত নিজ পাড়া, মহল্লাকে ধর্ষকমুক্ত বা ধর্ষণের মতো অপরাধমুক্ত করতে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শুনেছিলাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন সারাদেশের মসজিদে শুক্রবারের জুমার নামাজে যে খুৎবা ইমাম পাঠ করবেন, সেটি প্রণয়ন করেছে এবং সারাদেশে বিতরণ করা হয়েছে। সম্ভবত এই খুৎবায় জঙ্গী-মৌলবাদ বিরোধী, মাদকবিরোধী বক্তব্য আছে। আমার প্রশ্ন, এই খুৎবায় ধর্ষকবিরোধী বা ধর্ষণবিরোধী কোন বক্তব্য আছে কি? এর কারণ অনেক। প্রথমত, ধর্ষণ হচ্ছে পুরুষ কর্তৃক সংঘটিত একটি অপরাধ। এদিকে ইমাম, মৌলানা সবাই পুরুষ। পুরুষের কাছে হয়তো এই অপরাধটি, যেটি দীর্ঘকাল অন্দরমহলে, সাধারণভাবে সামন্ত, ভূমি-কৃষিনির্ভর ধনীর অন্দরমহলে বিনা বাধায় প্রায় একটি রীতিতে পরিণত হওয়া ‘গরিবের মেয়ে’ ‘দাসীর মেয়ে’ দের জন্য নির্ধারিত অপরাধটি যে পাপ কাজ, বা গুনাহর কাজ, সেটি দীর্ঘকাল গণ্য করা হয়নি! অন্তঃসত্ত্বা হলে ধর্ষিতার মূল্যহীন প্রাণ নদী বা মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হতো! এসব তো সত্য কাহিনী। সমাজের নিয়মে কিছু লোক সে যুগে সামন্ত-জমিদারের বদান্যতা ও দানে জীবিকা চালাত। সুতরাং, সে যুগে তারা নিজস্ব মতামত দেবে, এমন কল্পনা অসম্ভব ছিল। কিন্তু এখন এই জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তির যুগে, বিশেষ করে যখন বাঙালী জাতি ’৭১-এর স্বাধীনতার যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়েছে, কয়েক লাখ নারী পাকিস্তানী সেনার হাতে ধর্ষিত হয়েছে, তারপর যখন বালিকা, কিশোরী, তরুণীরা শিক্ষা গ্রহণ করে কর্মজগতে প্রবেশ করছে, এমন একটি যুগে ‘ধর্ষণ’ আগের যে কোন সময়ের চাইতে অনেক বেশি বড় মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা। বর্তমানে, শিশু অধিকার, মানবাধিকার- দুটিই ভয়াবহভাবে লঙ্ঘন করে ধর্ষণকারী জাতিকে, সুশীল সমাজকে, সরকারকে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে, সর্বোপরি প্রশাসন ও ধর্মরক্ষাকারী গোষ্ঠীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। আমাদের এখন প্রশ্নÑ ১. একজন সাংসদ তার এলাকায় জঙ্গী, মাদক সেবী, দুর্নীতিবাজ, নদী-ভূমি দখলবাজদের বিরুদ্ধে যেমন পদক্ষেপ নেবেন, নিচ্ছেন, কেন তিনি নিজ এলাকাকে ধর্ষকমুক্ত বা ধর্ষণমুক্ত করতে পারবেন না? ইচ্ছা থাকলে অবশ্যই একজন সাংসদ জেলা, উপজেলা প্রশাসক, পুলিশ কর্মকর্তা ধর্ষণের মতো অপরাধ ঐক্যবদ্ধ আন্তরিক প্রচেষ্টায় কমিয়ে আনতে পারেন। ২. ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য, এলাকার শিক্ষক, ইমাম-মৌলানা-উকিল, সাংবাদিকদের সাহায্য নিয়ে স্ব স্ব এলাকার বখাটে, স্কুল-ছুট, বেকার, মাদকাসক্তদের তালিকা করে নজরদারিতে রেখে তাদের স্বকর্মসংস্থানসহ মাঝে মাঝে সভা, উঠান বৈঠক ইত্যাদি অনুষ্ঠানে এবং স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শিশু দিবস, নারী দিবসে তাদের দিয়ে কিছু প্রচার কাজ করিয়ে তাদেরকে সংশোধন করতে পারে। যেমনÑ শহীদ জায়া, শহীদের সন্তানদের উপহার দেয়া, এলাকার বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের হাতে উপহার তুলে দেয়া, শহীদ বেদীতে ফুল দেয়া, অনুষ্ঠানে তাদেরকে বক্তা হিসেবে ‘পাড়াকে’ শান্তিপূর্ণ ও সুখী কিভাবে করা যায়, এ বিষয়ে মত প্রকাশ করতে দেয়াÑ এভাবে তারা নিজেদের সমাজে মূল্যবান মনে করবে এবং ধর্ষণকে বিশাল অপরাধ হিসেবে গণ্য করে ধর্ষককে বিচারের আওতায় আনতে উদ্যোগী হবে। নিজেও এসব কাজ থেকে বিরত থাকবে। মেয়েদের স্কুল-কলেজে যাওয়া-আসার পথকে নিরাপদ রাখতে এলাকার তরুণদের নিয়ে উপজেলা পরিষদ কর্মকর্তা, পুলিশ, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-সদস্যদের যেমন দায়িত্ব দিতে হবে, তেমনি ছাত্র, তরুণ রাজনৈতিক দলের সদস্যদেরকেও দায়িত্ব দিতে হবে। এসব অপরাধে অপরাধীদের দ্রুত বিচার করতে হবে এবং দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে। অনেক দেশে একটি অত্যন্ত অমানবিক বিচার ব্যবস্থা রয়েছে- ধর্ষিতাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়! অথচ ধর্ষিতা নিজেই একটি বড় অপরাধের শিকার হয়েছে। এক্ষেত্রে ধর্ষিতাকে ধর্ষকের ক্ষতিপূরণ দান ও ধর্ষকের মৃত্যুদ- হওয়ার কথা। নারীকে বিশ্ব এখনও ভোগের বস্তু মনে করলে ওসব দেশ উন্নতির পথে কখনওই এগোতে পারবে না। ধর্ষকের মৃত্যুদ- কার্যকর হলে যে অপরাধ হ্রাস পাবে, সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ তার নিজস্ব ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে একেবারে ভিন্ন ধরনের দেশ ও সমাজ। এ জাতি ধর্মনিরপেক্ষ, নারীবান্ধব, শিশুবান্ধব আবার বিজ্ঞান প্রযুক্তিবান্ধব দেশ। এখানে ধর্ষণ বা নারীকে ভোগের বস্তু করা যাবে না। তবে নারী ও সমাজকে আরও অনেকটা পথ এগোতে হবে। উন্নত দেশ হতে হলে মানবাধিকার এবং নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মতো অপরাধকে শূন্য হারে নিয়ে আসতে হবে। নতুবা উন্নত জাতি হিসেবে বাঙালী পরিচয় দিতে পারবে না বিশ্বে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×