ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভাষা

প্রকাশিত: ১২:১৫, ৩১ জানুয়ারি ২০২০

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভাষা

(পূর্ব প্রকাশের পর) সংবিধানের আরেকটি স্তম্ভ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।’ এ প্রসঙ্গে তপন পালিত যথার্থই লিখেছেন- ‘এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু ইংরেজী সেক্যুলারিজমের বাংলা করেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতা এবং এর নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, যার বিরোধিতা মৌলবাদীরা যেমন করেছে, বামপন্থীরাও করেছে। মৌলবাদীরা বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা বলেছে। আরবি ও উর্দু অভিধানে সেক্যুলারিজমের অনুবাদ করা হয়েছে লা দ্বিনীয়া এবং দুনিয়াই। এ দুটি শব্দের বাংলা অনুবাদ হচ্ছে ধর্মহীনতা ও ইহজাগতিকতা। বঙ্গবন্ধু সেক্যুলারিজমের বাংলা করেছেন ধর্মনিরপেক্ষতা, যার অর্থ রাষ্ট এবং রাজনীতি থেকে ধর্ম পৃথক থাকবে। বামপন্থীরা বলেছেন সেক্যুলারিজমের বাংলা অনুবাদ হবে ইহজাগতিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা নয়। তিনি জেনে বুঝেই সেক্যুলারিজমের বাংলা ধর্মনিরপেক্ষতা করেছেন।’ এখানে বঙ্গবন্ধু কেবল তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ব্যাখ্যা করেননি, একজন সফল পরিভাষাবিদ হিসেবেও তাঁর স্বাক্ষর রেখে গেছেন। সংবিধান প্রণয়নের আগে থেকেই ১৯৭২ সালে বিভিন্ন জনসভায় বার বার বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহ ব্যাখ্যা করেছেন: ‘আমরা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করি। তার মানে ধর্ম বিরোধী নয়। মুসলমান মুসলমান ধর্ম পালন করবে, হিন্দু হিন্দু ধর্ম পালন করবে, খ্রীস্টান, খ্রিস্টান ধর্ম পালন করবে, বৌদ্ধ, বৌদ্ধ ধর্ম পালন করবে। এক ধর্ম অন্য ধর্মের ওপর অত্যাচার করবে না। ধর্মের নামে জুয়াচুরি, পকেটমার, লুটতরাজ, ব্যবসা আর পশ্চিম পাকিস্তানের পয়সা খাইয়া রাজনীতি করা চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি চলবে না। ধর্মের নামে লুট করা চলবে না। ...আমার কুরআনের আয়াতে আছে তোমার ধর্ম তোমার কাছে। তোমার ধর্ম তোমার কাছে, আমার ধর্ম আমার কাছে। এটাই হলো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। বাংলাদেশ তাই থাকবে। তাই আমি আশা করি।’(২৬/০৬/১৯৭২, নোয়াখালী, পৃ. ৯৮)। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের ইতিহাস থেকে ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার-আলবদর পয়দার প্রমাণ তুলে ধরে বাংলাদেশ থেকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। আর তাই ইতিহাস ও ধর্মগ্রন্থের নজির দেখিয়ে একজন অর্থতাত্ত্বিকের মতো রাষ্ট্রের চারটি আদর্শকে অব্যর্থ ভাষায় তিনি ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর ঐ সময়ের ভাষণগুলোতে। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু কেবল স্বাধীনতার কথাই বলেননি, আমাদের মুক্তির কথাও বলেছিলেন; সেই মুক্তির অঙ্গীকারই ’৭২-এর সংবিধানের চারটি মূল স্তম্ভ রূপে প্রকাশ পেয়েছে। তাই তো বাঙালীর প্রথম সংবিধান উপস্থাপনে রাষ্ট্রপতির ভাষণটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেষ করেছিলেন এই বলে- ‘...ভবিষ্যত বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ গঠন করতে পারে, তাহলে আমার জীবন সার্থক, শহীদের রক্তদান সার্থক।’ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাঙালী জাতীয়তাবাদ এর ভিত্তিতে। বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষার জন্য জেলে গেছেন। এই ভাষা-আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তিনি বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন দেখেছেন। হাজার বছর ধরে বাঙালী জাতি নিজেদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছে। সেই জাতির জন্য একটি দেশ এনে দিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। তিনি মাতৃভাষার ঋণের কথা ভুলে যাননি। ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য দেশের মর্যাদা লাভ করে। এর আট দিন পর, ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন মাতৃভাষা বাংলায়। জাতিসংঘে এটি ছিল প্রথম বাংলায় ভাষণ। এতে করে বাংলা ভাষা বিশ্ব দরবারে পেয়েছে সম্মানের আসন, আর এই ভাষাভাষী মানুষেরা পেয়েছে গর্ব করার অবকাশ। বিশ্বপরিসরে এর আগে এমন করে বাংলা ভাষাকে কেউ পরিচয় করিয়ে দেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে প্রথম বাঙালী হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। তাঁর অবদানে বিশ্বের দরবারে প্রথম বাংলা ভাষা পরিচিত পেয়েছিল। কিন্তু জানামতে, বিশ্বাঙ্গনের কোথাও তিনি বাংলায় বক্তব্য রাখেননি। ১৯৯৮ সালে অমর্ত্য সেন অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান। তিনিও তাঁর বক্তব্যটি রেখেছিলেন ইংরেজীতে। ড. মুহম্মদ ইউনুস ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি তাঁর ৩৫ মিনিটের ভাষণের মধ্যে মাত্র দেড় মিনিট বাংলায় বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর পরে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে চেতনায় ধারণ করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিতে পেরেছেন সুদৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ে। এরপর তিনি যতবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গিয়েছেন, ততবার বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষার স্বীকৃতি দেয়ার দাবি করেছেন। অন্তর্জাল থেকে জানা যায়- বিশ্বব্যাপী ৩৫ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। তবে বাংলা ভাষা বলতে বিশ্ব বাংলাদেশকেই বুঝে। মাতৃভাষা বিবেচনায় বাংলা এখন চতুর্থ। ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক দিয়ে সপ্তম। ইউনেসকো ২০১০ সালে বাংলাভাষাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুরেলা ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্বের ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা পড়ানো হয়। বাংলা ভাষার এত গৌরব সত্ত্বেও সারা বিশ্বে তার তেমন কোন প্রচারের ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ সরকার। তারচেয়েও বেদনার কথা এদেশের শতাধিক সরকারী-বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগই নেই। অন্যন্য বিষয়ও পড়ানো হয় ইংরেজী মাধ্যমে। ইংরেজী মাধ্যমে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে বাঙালী জনসাধারণের সেবার চকরিতে তারা এখন নিয়োগ পান! জাতির পিতার মাতৃভাষায় জাতিসংঘে দেয়া ভাষণটিতে একাত্তরে বাংলাদেশ কেন সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিল, কী তার সেক্রিফাইস, কোন্ ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রটির এসব ইতিহাস চমৎকারভাবে উঠে আসে। রাষ্ট্রপরিচালনার নীতি ব্যাখ্যা করে সারাবিশ্বের নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন বাঙালীর মহান নেতা। নাতিদীর্ঘ ভাষণের সূচনায় বঙ্গবন্ধু বলেন ‘আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সঙ্গে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগিদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালী জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বাঙালীর দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘স্বাধীনভাবে বাঁচিবার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাঁচিবার জন্য বাঙালী জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাঁহারা বিশ্বের সকল জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাক্সিক্ষত ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লাখ লাখ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন।’ ভাষণে তিনি স্বাধীন বাংলার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া বীর শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। একইসঙ্গে বাংলাদেশের সংগ্রামে সমর্থনকারী সকল দেশ ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম সার্বিক অর্থে শান্তি এবং ন্যায়ের সংগ্রাম ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আর সে জন্যই জন্মলগ্ন হইতেই বাংলাদেশ বিশ্বের নিপীড়িত জনতার পাশে দাঁড়াইয়া আসিতেছে।’ সেই সময়ের বিশ্ব রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ পাওয়া যায় তাঁর সেই ভাষণে। বাঙালীর মহান নেতা বলেন ‘একদিকে অতীতের অন্যায় অবিচারের অবসান ঘটাইতে হইতেছে, অপর দিকে আমরা আগামী দিনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হইতেছি। আজিকার দিনের বিশ্বের জাতিসমূহ কোন্্ পথ বাছিয়া নিবে তাহা লইয়া সঙ্কটে পড়িয়াছে। এই পথ বাছিয়া নেয়ার বিবেচনার উপর নির্ভর করিবে আমরা সামগ্রিক ধ্বংসের ভীতি এবং আণবিক যুদ্ধের হুমকি নিয়া এবং ক্ষুধা, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে মানবিক দুর্গতিকে বিপুলভাবে বাড়াইয়া তুলিয়া আগাইয়া যাইব অথবা আমরা এমন এক বিশ্ব গড়িয়া তোলার পথে আগাইয়া যাইব যে বিশ্ব মানুষের সৃজনশীলতা এবং আমাদের সময়ের বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি আণবিক যুদ্ধের হুমকিমুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রূপায়ণ সম্ভব করিয়া তুলিবে। এবং যে বিশ্ব কারিগরি বিদ্যা ও সম্পদের পারস্পরিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে সুন্দর জীবন গড়িয়া তোলার অবস্থা সৃষ্টি করিবে।’ এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রথম হইতেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এই নীতিমালার উপর ভিত্তি করিয়া জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করিয়াছে।’ কেবলমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশই কষ্টলব্ধ জাতীয় স্বাধীনতার ফল ভোগ করতে সক্ষম করে তুলবে বলে মত দেন তিনি। প্রতিবেশি রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস বাংলাদেশের অভ্যুদয় বস্তুতপক্ষে এই উপমহাদেশে শান্তির কাঠামো এবং স্থায়িত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অবদান সৃষ্টি করিবে। ইহা ছাড়া আমাদের জনগণের মঙ্গলের স্বার্থেই অতীতের সংঘর্ষ ও বিরোধিতার পরিবর্তে মৈত্রী ও সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে।’ বাঙালীর উদারতার সবটুকু বহির্প্রকাশ ঘটিয়ে বক্তৃতায় তিনি বলেন ‘আমরা আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত ও নেপালের সঙ্গে শুধুমাত্র প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কই প্রতিষ্ঠা করি নাই, অতীতের সমস্ত গ্লানি ভুলিয়া গিয়া পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক করিয়া নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করিয়াছি।’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অবস্থার প্রতি শ্রদ্ধা এবং অন্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিবেশী সকল দেশের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বজায় বজায় রাখিবে। আমাদের অঞ্চলের এবং বিশ্বশান্তির অন্বেষায় সকল উদ্যোগের প্রতি আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকিবে।’ বাঙালীর ক্ষমতা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানতেন বঙ্গবন্ধু। সে কথা বিশ্ববাসীকে আরও একবার জানিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘জনাব সভাপতি, মানুষের অজেয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস, মানুষের অসম্ভবকে জয় করার ক্ষমতা এবং অজেয়কে জয় করার শক্তির প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস রাখিয়া আমি আমার বক্তৃতা শেষ করিতে চাই। আমাদের মতো যেইসব দেশ সংগ্রাম ও আত্মদানের মাধ্যমে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে, এই বিশ্বাস তাঁহাদের দৃঢ়। আমরা দুঃখ ভোগ করিতে পারি। কিন্তু মরিব না। টিকিয়া থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করিতে জনগণের দৃঢ়তাই চরম শক্তি। আমাদের লক্ষ্য স্বনির্ভর। আমাদের পথ হইতেছে জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও যৌথ প্রচেষ্টা।’ বক্তৃতার শেষ অংশে খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের অবতারণা করে তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজেদের শক্তির উপর আমাদের বিশ্বাস রাখিতে হইবে। আর লক্ষ্য পূরণ এবং সুন্দর ভাবিকালের জন্য আমাদের নিজেদের গড়িয়া তুলিবার জন্য জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমেই আমরা আগাইয়া যাইব।’ এমন চমৎকার ভাষায় অদ্ভুত সুন্দর স্বপ্নের কথা জানিয়ে বক্তৃতা শেষ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিরজনক শেখ মুজিবুর রহমান। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক, যিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধুকে প্রথমেই অনুরোধ করা হয়েছিল, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ইংরেজীতে বক্তৃতা করবেন।’ কিন্তু প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার প্রতি সুগভীর দরদ ও মমত্ববোধ থেকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই।’ জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্পর্কে বলা হয়, ‘বক্তৃতায় ধ্বনিত হয়েছে মুজিবের মহৎ কণ্ঠ।’ জাতিসংঘ মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়াল্ডহেইম তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় আমি আনন্দিত ও গর্বিত। বক্তৃতাটি ছিল সহজ, গঠনমূলক এবং অর্থবহ।’ জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণের প্রত্যক্ষদর্শী নেতা তোফায়েল আহমদের ভাষায় ‘মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা প্রদানে বঙ্গবন্ধুর এই সিদ্ধান্তটি ছিল তাঁর সমগ্র জীবনের স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক পরিণতি। সেদিন বক্তৃতারত বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকিয়ে কেবলই মনে হয়েছে, তিনি যেন বহু যুগ ধরে এমন একটি দিনের অপেক্ষায় নিজকে প্রস্তুত করেছিলেন। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ, ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বের আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু মুজিব ছিলেন সর্বাগ্রে। তাঁর নেতৃত্বেই সেদিন অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্রসমাজ সফল ধর্মঘট পালন করেছিল। এর পর ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি, মহান ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তিনি কারাগারে বন্দী অবস্থাতেই আমরণ অনশন শুরু করেছিলেন। ১৯৭০ এর নির্বাচনোত্তর ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘রক্তের বিনিময়ে বাংলা রাষ্ট্রভাষা করবো, ইনশাল্লাহ্ বাংলা রাষ্ট্রভাষা হয়েছে।’ সে রাষ্ট্রভাষার সম্মান বাংলাকে কতুটুকু আমরা দিতে পারছি সে প্রশ্নে আজ আর নয়। বাংলাদেশ এখন বক্তৃতার দেশ বললে খুব ভুল হবে না নিশ্চই। নেতারা বলতে ভীষণ ভালবাসেন। গর্জন শোনা যায় প্রচুর। কিন্তু যে বক্তৃতা মানুষকে জাগায়, অন্ধকারে পথ দেখায় সে বক্তৃতা কই? উত্তর খুঁজতে একটু পেছন ফিরে তাকাতেই হয়। আর তখন একজনই তর্জনী উঁচিয়ে সামনে দাঁড়ান। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশে শুধু নয়, বহির্বিশ্বেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা করেছেন তিনি। অথচ তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা বিশ্লেষণ হলেও, তার অন্য শতাধিক ভাষণ নিয়ে কোন আলোচনা বিশ্লেষণ তেমন চোখে পড়ে না। এমনকি আলোচিত ৭ মার্চের ভাষণেরও ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বা শৈলীবিজ্ঞান সম্মত কোন আলোচনা হয়েছে বলে মনে হয় না। প্রত্যাশা করা যায় অচিরেই এ ধরনের আলোচনায় অনেকেই এগিয়ে আসবেন। এতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠিত হবে পূর্ণগৌরবে। প্রণীত হবে ভাষানীতি; এর ভিত্তিতে গৃতীত হবে ভাষা-পরিকল্পনা। উন্নতি হবে বাংলাদেশের শিক্ষার মানের। দেশে ভাষার ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের পথে বাংলাদেশে এগোবে আরও কয়েক ধাপ। (শেষ)
×