ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শুভ্রেন্দু ভট্টাচার্য শঙ্কর

হাসি নিয়ে যত কথা

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ৩ জানুয়ারি ২০২০

হাসি নিয়ে যত কথা

হাসি বিভিন্ন রকমের হয়, যেমন মুচকি হাসি, মুখ এক সাইড করে হাসি আমের মতো, বক্র হাসি, হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দেয় তোমাকে সাইজ করতে সময় লাগবে না, গুয়ামুরি হাসি, পাখির মতো কুর কুর করে হাসে, বিনা প্রয়োজনে হ হ করে হাসি, আবার ঢেউ খেলানো হাসি, এটা বিরতি দিয়ে হাসি, মনে হলো হাসি শেষ, কিন্তু আবার ঢেউ খেলে উঠে, বিরতিহীন হাসি, এ হাসি একবার শুরু হলে আর সহজে থামার জো নেই, হাসির জোয়ারে মাঝে মাঝে অন্যদের ধৈর্য চ্যুতি ঘটে। কেউ কেউ আবার প্রাণ খোলে হ হ করে ঘর কাঁপানো হাসি দেয়, আবার অনেক আছে বুঝে না বুঝে বেয়াক্কলের মতো হাসে, অন্যদের হাসতে দেখে তাল মেলাতে তারাও হাসে, মনে মনে কেউ একা একাও হাসে, হয়ত এমন একটা আজগুবি কথা কেউ বলছে যে সামনা সামনি হাসলে খারাপ দেখায়, তাই অকুস্থলে নিজেকে সামলে নিয়ে একা একা কথাটা মনে হলেই হাসি পায়। জায়গা বুঝে এই হাসির ঘটনাটি অন্যদের সঙ্গে শেয়ারও করে। বিমানবাবু কথা বললেই মনে হয় উনি হাসছেন, আসলে উনি হাসছেন না, উনার মুখের আদলই এ রকম- মুখ খুললেই মনে হয় উনি হাসছেন। আমার এক বন্ধু আলতাফ, কারণে অকারণে হু হু করে হাসত। আবার তার হাসির সঙ্গে তাল না মেলালে মাইন্ড করত, এটা একটা ফ্যাসাদ, হাসি না আসলে মানুষে কেমনে হাসে। ক্ষেত্র বিশেষে আবার ভদ্রতার খাতিরে অথবা সৌজন্য রক্ষায় হাসতে হয়; এ হাসি কিন্তু অন্তর ভেদ করে বের হয় না, এটা মুখ থেকে আসে, একটু হাসি হাসি ভাব করে মুখকে এদিক ওদিক করতে হয়। প্লেনে বিমান বালাদের হাসি কিন্তু রেডি মেইড, চোখাচোখি হলে এমন একটা হাসি বের হয় যেন মনে হয় ঠোটের কড়া লিপস্টিক এখনই গলে পড়ছে। আবার চোখের আড়াল হলেই মহাব্যস্ত ভাব নিয়ে ত্রস্তপদে হেঁটে চলে। এরা পুরো সময়টাই হাঁটার মধ্যে থাকে। আমার মনে হয় যাত্রীদের মন খুশি রাখার জন্য এদের হাসির ট্রেনিং দিতে হয়। কিছু মহিলার হাসি মাখা মুখ দিয়ে আপন পর নির্বিশেষে সকলকে আপন করে নেয়ার একটা অপরূপ ক্ষমা থাকে। এদের হাসি মাখা মুখ অনায়াসে সকলের শ্রদ্ধা ভালবাসা অর্জন করে। এরা মানুষের কাছ থেকে মায়ের মতো শ্রদ্ধা অর্জন করেন। মায়েদের হাসির সঙ্গে কিন্তু কারও হাসির তুলনা হয় না। সন্তানের কাছে মায়ের বিষণœ বদন কিন্তু খুবই বেদনাদায়ক। মায়ের মুখে হাসি সন্তানের অনেক দুঃখ কষ্ট লাঘব করে। পক্ষান্তরে সন্তানের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য অনেক মা সর্বস্ব ত্যাগ করতেও প্রস্তুত থাকেন। মাতৃ হারা সন্তান প্রয়াত মাকে স্মরণ করার জন্য নির্জন মুহূর্তে গেয়ে উঠে, ‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের বুকে ঝরে, মাকে মনে পড়ে, আমার মাকে মনে পড়ে।’ হাসি দিয়ে যে ভাবে মানুষের মন জয় করা যায়, আবার এই হাসির মাধ্যমে কেউ কেউ ভয়ঙ্কর কিছু ঘটার আগাম সঙ্কেতও দেয়। সিনেমা বা যাত্রা পালায় খলনায়করা প্রায়ই হাসি দিয়ে প্রতিপক্ষকে বুঝিয়ে দেয় তোমার দিন ঘনিয়ে আসছে। অনেক সময় আবার হাসি দিয়ে গুরুতর কোন বিষয়কে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেয়া হয়। কেউ কেউ কারও প্রতি তাচ্ছিল্যের ভাব প্রকাশ করতেও এক ধরনের হাসি দেয়। যেমন হাসি মুখে জানান দেয় তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ কিছু আন্দাজই করতে পারছ না অথবা এমন কি কথা বলেছ যার কোন মানে নেই। চাটুকাররা কারও মনোরঞ্জনের জন্য হাসিকে একটা মাধ্যম রূপে ব্যবহার করে। অনেক সময় বেআন্দাজ হাসির জন্য এরা বসের ধমকও খায়। চরম সাফল্য বা একটা অপ্রত্যাশিত ভাল খবরে অনেক সময় খুশিতে আনন্দাশ্রু ঝরে, এ ভাবের নাম হতে পারে হাসিকান্না। প্রেমের ক্ষেত্রে প্রেমিকার মুখের এক ঝিলিক হাসির জন্য প্রেমিক নিজের জীবন দিতেও প্রস্তুত থাকে। প্রেমিকার হাসি মুখ দেখলেই দয়িত ভাবে, আহা, মনটা ভরে গেল, হাসিতে যেন মুক্ত ঝরছে। কিছু হাসি অমলিন স্নিগ্ধতায় মাখা হাসি দেখলে মনটা ভরে যায়, মহিলা হলে মনে হয় ‘চাঁদের হাসি বান ডেকেছে’। কিছু মানুষ আছে যারা ফটো উঠতে হাসি মুখ করতে বললে মুখ আরও কঠিন করে ফেলে, আবার কেউ কেউ একটা সুন্দর হাসি দিয়ে ছবি তুলে। জীবন বাবু কারও ফটো তুলতে গেলেই বলবেন, ‘হাসি মুখ’; এখন এটা তার অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। কিছু অফিসারদের হাসিতে আবার একটা মাপ আছে। স্থান কাল পাত্র ভেদে তাদের হাসির ধরন পাল্টায়। জুনিয়রদের সামনে অনেকেই হাসেন না, মুখ গুমরো করে থাকেন, হাসাহাসি করলে ব্যক্তিত্ব কমে যায়, জুনিয়রের মন থেকে ভয় কেটে যায়, প্রশাসন টাইট থাকে না। অধস্তনের মনে ভীতির সঞ্চার করে তাদের সব সময় একটা ট্যানসনে রাখেন। এই বসই যখন তার বসের কাছে যান তখন মুখটা হাসিতে লেফে থাকে। বসের কথায় কোন সময় অকারণে হেসে উঠেন, কোণ বিষয়ে স্যার হা করার আগেই তিনি অজান্তেই ইএস স্যার বলে উঠেন। অকারণে হাসির জন্য এদের কেউ আবার বসের বিরক্তির উদ্রেক করেন। হাসির মর্ম আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না। একটু ¯েœহমাখা, প্রাণ ছোঁয়া হাসি দিয়ে, কমল স্বরে কথা বললে মানুষের মনে যে জায়গাটুকু পাওয়া যায় তা বিশ্ব জয়ের আনন্দেরই সমতুল্য। কোটি টাকা খরচ করেও মনে হয় সে আনন্দ পাওয়া যায় না, অন্যের মনে সে জায়গাটুকু পাওয়া যায় না। তাহলে হাসতে বাধা কোথায়? হাসতে তো পয়সা লাগে না। মনের জানালাকে একটু খুলে দিতে হয়। খুলে দেন, মন ভরে যাক নির্মল বাতাসে। হাসি দিয়ে এই বাতাসকে মুক্ত করে দিন। হাসতে না পারলে হাসির ব্যায়াম করুন; সকালের মুক্ত হাওয়ায় অট্ট হাসি দিয়ে ভেতরের সব ময়লা ঝেড়ে ফেলুন। বিচিত্র পরিস্থিতি, নানা অবস্থা ও পরিবেশের প্রতিক্রিয়ায় মানুষের মনের আবেগ প্রকাশে যে হাসির সৃষ্টি হয় সে হাসিতে সাধারণত দু’ধরনের আবেগের প্রকাশ হয়। প্রথমত স্বস্তি, হর্ষ, আনন্দ ও সুখানুভূতি, শান্তি। এ রকমের হাসিতে ইতিবাচক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ হয়। পক্ষান্তরে, সংশয়, সৌজন্য, বিব্রত বোধ, তাচ্ছিল্য, অশনিসঙ্কেত ইত্যাদি নেতিবাচক ভাব প্রকাশে যে হাসির প্রকাশ ঘটে, এ হাসিতে খুব একটা সাবলীল ভাব থাকে না; নেহাৎ প্রয়োজনের তাকিদে বা কিছু বুঝতে না পেরে সেই হাসির প্রকাশ ঘটে। এ হাসি মূলত উদ্দেশ্য প্রণোদিত বা অজ্ঞতা প্রসূত। ইন্দনেশিয়ায় একটা বহুল প্রচলিত কথা আছে, ‘A smiling Indonesian is not a happy Indonesian.’ কারণ, অনেক সময় বিদেশীদের কথ না বুঝেই ওরা হাসির কোরাস তুলে। মানুষ হাসতে চায়। জীবন যখন প্রতিনিয়ত ঘাত, প্রতিঘাত, দ্বন্দ্ব সংগ্রামে জর্জরিত, টিকে থাকার লড়াইয়ে আমরা যখন গলদ ঘর্ম তখন নিজে ও অপরের মুখে হাসি ফুটানোর জন্যে কতই না অক্লান্ত চেষ্টা। সৃষ্টির জন্মলগ্ন হতেই কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকারগণ তাদের সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে তাদের শিল্পীসত্তাকে উজাড় করে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে শেক্সপিয়ারের নাটকে মানব চরিত্রের বিচিত্র রহস্য উদ্ঘাটনে অনেক বৈপরীত্য, অসঙ্গতি, অদ্ভুত আচরণ, ভাব ভঙ্গি, কথা বলা ইত্যাদি হাস্যরসের মাধ্যমে এমন নির্লিপ্ত ভাবে পাঠক/দর্শকদের সামনে প্রকাশ ধরেছেন তাতে চরিত্রগুলো তাদের অদ্ভুত আচরণ, ভাব ভঙ্গির মাধ্যমে একদিকে যেমন হাস্যরসের সৃষ্টি বিনোদনে আপ্লুত করে করে মানুষকে নির্মল, অন্যদিকে দর্শক উপস্থাপিত চরিত্রগুলোর মধ্যে আপন চরিত্রের নানা দিকের প্রতিফলন দেখতে পায়, নিজের ভুল ত্রুটিগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এ নাটকগুলোর ক্লাউন, ফুল চরিত্রগুলো হাস্য কৌতুকের মাধ্যমে জীবনের কঠিন সত্য দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছে। এরা গুরুত্ব হীন নিম্নবর্গের মানুষ। কিন্তু তীক্ষè বুদ্ধি রসবোধে আপ্লুত গভীর জীবনবোধে এরা আমাদের জীবনকে আলোকিত করে, বিবেককে জাগিয়ে তুলে, সংশোধনের পথ দেখায়। ভবিতব্য সম্পর্কে এদের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জ্ঞান সহজাত। অনেক ক্ষেত্রে বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার পূর্বেই মনিবকে তারা দুর্যোগের পূর্বাভাস দেয় এবং তা দেয় হেয়ালির মাধ্যমে, ধাঁধার সৃষ্টি করে, হাসতে হাসতে কঠিন বার্তা দেয়; মনিব কোণ সময় বার্তার মর্ম বুঝে, কখনও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দেয়। ভবিতব্য অনিবার্য হয়ে উঠে, বিপর্যয় ঘটে যায়। প্রসঙ্গত সিরাজুদ উল্লাহ নাটকের গুলাম হুসেইন চরিত্র স্মর্তব্য। নবাবের বিরুদ্ধে যে গভীর চক্রান্ত চলছে এবং তার একান্ত আপনজনরাই যে নাবাবের বিপর্যয় ঘটাতে চক্রান্ত করছে তার আগাম বার্তা বিভিন্ন সময় হেয়ালি পূর্ণ কথা ও হাস্যকৌতুকের মাধ্যমে গুলাম হুসেইন নবাবকে দিয়েছে। কিন্তু নবাব এই বান্দার সব কথার গুরুত্ব না দেয়ায় তার করুন পরিণতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার স্বাধীনতাও ইংরেজরা হরণ করে নিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত আছে যেখানে এই অচ্ছুত লোকদের তীক্ষè বুদ্ধিদিপ্ত হাস্যরসে ভরপুর কঠিন সত্যের মর্ম বুঝতে না পেরে অথবা গুরুত্ব না দিয়ে সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়েছে, নির্মম পরিণতির শিকার হতে হয়েছে মানব জাতিকে। বাংলার ইতিহাসে গোপাল ভাঁড় এক অনবদ্য চরিত্র। হাস্যরসের মাধ্যমে মহারাজা কৃষ্ণ চন্দ্রের যে কোন জটিল সমস্যার সমাধান অবলীলাক্রমে গোপাল করে যেত। মুঘল বাদশা আকবরের সভাসদ বীরবল গভীর প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের অধিকারী। হাস্য কৌতুকের মাধ্যমে বিশাল মুঘল সা¤্রাজ্যের রাজনীতির অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করেছেন। আধুনিক কালের কমেডিয়ানদের মধ্যে চার্লি চ্যাপলিন, ভানু এবং আরও অনেক বিশ্ব বিখ্যাত কৌতুক অভিনেতা শুধু মাত্র মানুষকে নির্মল আনন্দ দেয়ার জন্য অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। শিল্প কর্মের মাধ্যমেই মানুষের সকল সুকুমার প্রবৃতির প্রকাশ পায়। একজন শিল্পীর মনোনিবেশ থাকে পাঠক যেন তার আপনসত্তার বিকাশ ও উপলব্ধিতে নির্মল আনন্দ পায়। যে শিল্পী মানুষের সত্তার বিকাশ ও উপলব্ধিতে সত্য ও সুন্দরের অন্বেষণে যত বেশি আনন্দে উদ্ভাসিত করতে পারেন সেই শিল্পীই তত বেশি সার্থক। তবে হাসতে গিয়ে হাসির উপাদানের মর্মাথ হৃদয়ঙ্গম করেই হাসতে হবে। বেকুবের হাসিকে কেউ মূল্য দেয় না; ইহা পাঠকের অজ্ঞতাকে অন্যের সামনে আরও প্রকট করে তুলে, লেখকের শুভ ইচ্ছাকে নস্যাত করে ফেলে। পরিশেষে বলা যায় ইচ্ছামত মন খুলে হাসুন; অন্যকেও হাসতে সাহায্য করুন। তবে জেনে, বুঝে শুনে হাসুন এবং অন্যকেও নির্মল বিনোদন দিন। নির্মল হাসি শরীর ও মন দুটোর জন্যই স্বাস্থ্যকর। ইতিহাসের শিক্ষা হোল হাসি দিয়ে যেমন বিশ্ব জয় করা যায় তেমনই ক্লিওপেট্রার ভুবন মুহিনি হাসি একদিকে যেমন তার নিজের আত্মাহুতির কারণ হয়েছিল, তেমনি প্রাচীন মিসর ও রোমান সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত করেছিল।
×