ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ বিজয় আল্লাহ্র দান

প্রকাশিত: ০৯:০৯, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ বিজয় আল্লাহ্র দান

বিজয়ের নানামাত্রিক দিক আছে। প্রকৃত বিজয় আসে আল্লাহ্র রহমতে, আল্লাহ্র অনুগ্রহে। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : ‘ওয়া উখরা তুহিব্বুনাহা, নাসরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন কারিব’ আর তোমাদের পছন্দনীয় আরও একটি অনুগ্রহ হচ্ছে আল্লাহর সাহায্য ও আসন্ন বিজয়। (সূরা সাফ : আয়াত-১৩)। আমরা জানি, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বেশ কয়েকটি যুদ্ধের মোকাবেলা করতে হয়। সব যুদ্ধেই বিজয় অর্জিত হয়েছে। একমাত্র ওহুদের যুদ্ধে সাময়িক সঙ্কট সৃষ্টি হলেও শেষমেশ সে যুদ্ধেও বিজয় এসেছে। কুরআন মজিদের ৪৮ নম্বর সূরার নাম ফাতহ। ফাতহ শব্দের অর্থ বিজয়। এই সূরা ফাতহ বা বিজয় সূরাটি নাজিল হওয়ার প্রেক্ষাপট বা শানেনুযুল থেকে জানা যায়, এই সূরাটি নাজিল হয় ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পাদনের পর পরই। ষষ্ঠ হিজরী মোতাবেক ৬২৮ খিস্টাব্দের শাওয়াল মাসে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নে দেখলেন, তিনি সাহাবায়ে কেরামের একটি কাফেলা নিয়ে মক্কা মুকাররমায় তাশরিফ নিয়ে এসেছেন এবং বায়তুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করছেন, বায়তুল্লাহ শরীফের অভ্যন্তরেও প্রবেশ করেছেন। উল্লেখ্য, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৬২২ খ্রিস্টাব্দের রবিউল আওয়াল মাসে জন্মভূমি মক্কা মুকাররমা থেকে মদিনা মনওয়ারায় হিজরত করে আসেন। মক্কায় যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরাও হিজরত করেন। দেখতে দেখতে ছয়টি বছর মদিনা মনওয়ারায় অতিবাহিত হয়েছে। জন্মভূমি ছেড়ে আসার সময় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাঁদছিলেন আর বলছিলেন : হে আমার জন্মভূমি মক্কা! আল্লাহর জমিনে তুমি আমার কাছে প্রিয়তম স্থান। ছয় বছর জন্মভূমি থেকে বহু দূরে থাকায় স্বাভাবিকভাবেই তাঁর অন্তরে মক্কায় যাওয়ার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠল এবং বায়তুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করার ইচ্ছাও জাগ্রত হলো। তাই তিনি সেই শাওয়াল মাসের পরের মাসে জিলকদে তিন হাজার চার শ’ সাহাবার এক কাফেলা নিয়ে মক্কার উদ্দেশে রওনা হলেন। যুলহুলায়ফা নামক স্থানে এসে উমরার নিয়তে ইহরাম বাঁধলেন, সাহাবায়ে কেরামও ইহরাম বাঁধলেন। ওদিকে মক্কার কাফির-মুশরিকদের কাছে খবর পৌঁছল যে, হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার দিকে আসছেন। তাঁর সঙ্গে কয়েক হাজার সহচর রয়েছে। তারা এই কাফেলার গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য একটি অশ্বারোহী বাহিনী মোতায়েন করল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার নিকটবর্তী হুদায়বিয়া নামক স্থানে এসে একটি কূপের নিকট অবস্থান গ্রহণ করলেন। কূপটিতে সামান্য পানি ছিল, যে কারণে তিন হাজার চার শ’ সাহাবীর জন্য তা নেহায়েত কম ছিল। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর তীরের খাপ (তূণী)-এর মধ্য থেকে একটি তীর বের করে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত বারাআ ইবনে আযিব রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর হাতে দিয়ে বললেন, এই তীরটি ওই কূপের ভেতরে নিক্ষেপ কর। সাহাবী নির্দেশ অনুযায়ী তীরটি কূপের ভেতর নিক্ষেপ করার সঙ্গে সঙ্গে কূপটি কানায় কানায় পানিতে ভরপুর হয়ে গেল। এটা ছিল প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক অনন্য মোজেযা। মক্কার কাফির-মুশরিকদের পক্ষ থেকে বুদায়ল ইবনে ওয়ারাকা খুযায়ী প্রিয় নবী (সা)-এর সামনে এসে মুসলিমদের আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে প্রিয় নবী (সা) ইহরাম পরিহিত সাহাবীগণকে এবং কোরবানির জন্য সঙ্গে আনা উটগুলো দেখিয়ে বলেন : এগুলো দেখে কি তোমরা বুঝতে পারছ না আমরা কেন এসেছি? বুদায়ল নগরীতে ফিরে গিয়ে সব জানালে কুরাইশ কাফির-মুশরিক নেতারা অনুধাবন করল- এই কাফেলার আগমনের উদ্দেশ্য কেবল বায়তুল্লাহ শরীফ জিয়ারত করা। তবুও তাদের কেউ কেউ মুসলিমগণকে মক্কায় প্রবেশ করতে দিতে রাজি হলো না। তারা একদল তরুণকে কাফেলাটি আক্রমণ করতে পাঠাল। তাদের আটকানো হলো। কিন্তু প্রিয় নবী (সা) তাদের ছেড়ে দিতে বললেন। একপর্যায়ে বিষয়টি বুঝিয়ে বলার জন্য হযরত উসমান রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুকে নগরীতে পাঠানো হলো। তিনি মক্কা নগরীতে গিয়ে সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, আমরা কেবল বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করতে এসেছি। কিন্তু তাঁর কথায় কেউ কর্ণপাত না করে সাময়িকভাবে তাঁকে আটকিয়ে রাখল। হযরত উসমান রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু ফিরছেন না দেখে সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এমনও গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে, কুরাইশ মুশরিকরা হযরত উসমানকে (রাদি) হত্যা করেছে! এমন অবস্থায় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি গাছের নিচে কাফেলার সকল সাহাবায়ে কেরামকে সমবেত করে প্রত্যেকের কাছ থেকে জান কোরবান করার অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন। ওই অঙ্গীকার বায়াতুর রিদওয়ান নামে অভিহিত হয়েছে। কুরআন মজিদে ওই অঙ্গীকার সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে : লাকাদ রাদিয়াআল্লাহু আনিল মুমিনিনা ইয্ ইউবায়ি উনাকা তাহতাশশজারাতি ফায়ালিমা মা ফি কুলুবিহিম ফাআনযালাস সাকিনাতা আলাইহিম ওয়া আছাবাহুম ফাতহান কারিবা- (হে রাসূল), আল্লাহ তো মুমিনদের ওপর সন্তুষ্ট হলেন যখন তারা বৃক্ষতলে আপনার নিকট বায়াত গ্রহণ করল, তাদের অন্তরে যা ছিল তা তিনি অবগত ছিলেন, তাদের তিনি দান করলেন প্রশান্তি এবং তাদের পুরস্কার দিলেন আসন্ন বিজয়। (সূরা ফাতহ : আয়াত ১৮)। চলবে... লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ
×