ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সিতেশ রঞ্জন পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার

প্রাণী সেবাই যার ধ্যানজ্ঞান

প্রকাশিত: ০৮:২৫, ৫ অক্টোবর ২০১৯

 প্রাণী সেবাই যার ধ্যানজ্ঞান

সিতেশ রঞ্জন দেব। শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার তথা সিলেট বিভাগের একজন অতি পরিচিত বন্যপ্রাণী বান্ধব। প্রাণীরাই তার ধ্যান-জ্ঞান। দিবানিশি প্রাণীদের নিয়ে তার বসবাস। প্রাণী সেবা করতে গিয়ে পেয়েছেন সিলেট বিভাগীয় সম্মাননাসহ অসংখ্য পুরস্কার। সিতেশ রঞ্জন দেব প্রাণীদের ভালবেসে তার বাগান বাড়িতে গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন। এ ফাউন্ডেশনে বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধারকৃত ও আহত বন্যপ্রাণীদের সেবা-শুশ্রুষা করে বনে ফিরিয়ে দেবার মহান দায়িত্ব পালন করে থাকে। দেশের মানুষ এটিকে সিতেশ রঞ্জন দেবের মিনি চিড়িয়াখানা হিসেবে চেনে। কিভাবে বন্যপ্রাণীদের প্রতি তার অগাধ ভালবাসা জন্ম নিল এ প্রসঙ্গে সিতেশ রঞ্জন দেব জানান, তার পিতা প্রয়াত শিরিস রঞ্জন দেব এক সময় দুর্ধর্ষ শিকারী ছিলেন। শিকারের নেশায় তিনি মাসের পর মাস কাটিয়ে দিয়েছেন বনে জঙ্গলে। তিনি সব ধরনের পশু ও পাখি চিনতেন এবং তাদের অনেকের ভাষাই তিনি বুঝতেন। প্রকৃতি পাগল শিরিস রঞ্জন দেব সখের বশে প্রকৃতিকে ভালোবেসে স্বাধীনতার পূর্বে তার শহরতলীর ইছবপুরস্থ বাড়ির আঙ্গিনায় গড়ে তুলেন একটি মিনি চিড়িয়াখানা। প্রয়াত পিতার সঙ্গে সিতেশ রঞ্জন দেবও পশু-পাখিদের লালন পালনের কাজ শুরু করেন। পিতার সঙ্গে শিকারেও যেতেন। ১৯৮৬ সালে পিতা শিরিস রঞ্জন দেব মৃত্যুবরণ করার পর পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সিতেশ রঞ্জন দেবও শিকারে মত্ত হয়ে ওঠেন। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধ্যাদেশ ১৯৭৩ সালের পিও নং ২৩ এর শর্তাবলী মেনে সিতেশ রঞ্জন দেব সংসার ত্যাগী এক শিকারীতে পরিণত হন। তিনি তার শহরের মিশন রোডস্থ বাসভবনের আঙ্গিনায় গড়ে তুলেন একটি মিনি চিড়িয়াখানা। এ চিড়িয়াখানা দেখতে দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটন আসতে থাকেন তার বাসায়। পরবর্তীকালে তার ভাড়াউড়া এলাকায় অবস্থিত বাগান বাড়িতে এটিকে স্থানান্তর করেন। সরকারের বন্যপ্রাণী আইনানুযায়ী এটিকে রূপান্তর করেন বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনে। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সিতেশ রঞ্জন দেব জানান, সখের বশে এক সময় শিকার করলেও এখন প্রাণী সংরক্ষণে প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বন্যপ্রাণী রক্ষা করতে হবে আগামী প্রজন্মের জন্য। তার শিকার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা সম্পর্কে সিতেশ রঞ্জন দেব জানান, ১৯৯১ সালের জানুয়ারি মাসে জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা বাগানে বন্য শুকরের অত্যাচারে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এলাকাবাসী বন্য শুকরের হাত থেকে তাদের রক্ষায় সিতেশ রঞ্জন দেবের সহায়তা কামনা করেন। ওই বছরের ১৪ জানুয়ারি ভোর রাতে সিতেশ রঞ্জন দেব বন্য শুকরের খোঁজে পাত্রখোলা চা বাগানের গভীর ছন বাগানে প্রবেশ করেন। ওই সময়ে ছন বাগানে শুয়ে ছিল একটি মানুষ খেকো প্রায় ৮ ফুট লম্বা বিশালাকৃতির ভাল্লুক। গভীর ছন বাগানে ভাল্লুকের উপস্থিতি বুঝতে পারেননি সিতেশ দেব। অলক্ষ্যে তার পা পড়ে ভাল্লুকের গায়ের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভাঙ্গা ভাল্লুক সিতেশ দেবকে আকস্মিক আক্রমণ করে বসে। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল সিতেশ দেব হাত দিয়ে প্রথমে ভল্লুকের আক্রমণ প্রতিহত করেন। সঙ্গে সঙ্গেই ভাল্লুকটি সিতেশ দেবের চোখে-মুখে থাবা বসিয়ে দেয়। থাবায় সিতেশ দেবের মুখের ডান পাশের চোখসহ পুরো অংশ চোয়ালসহ ঝুলে পড়ে। এরপরও ভল্লুকটি গুরুতর আহত সিতেশ দেবের ওপর আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করে। রক্তাক্ত ও মারাত্মক আহতাবস্থায়ও সিতেশ দেব জ্ঞান হারাবার পূর্বেই ভল্লুকের গায়ে গুলি করেন। গুলিতে ভাল্লুকটি প্রাণ হারায়। পরে বাগান কর্তৃপক্ষ গুরুতর আহতাবস্থায় সিতেশ রঞ্জন দেবকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে। সেখান থেকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে প্রায় এক মাস চিকিৎসা গ্রহণ করেন তিনি। এ সময়ে তার মুখে ৭ বার অপারেশন করা হয় এবং মোট ২৯ ব্যাগ রক্ত দিতে হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানো হয়। এ স্মৃতি মনে হলে এখনও সিতেশ দেব মনের অজান্তে আঁৎকে ওঠেন। বর্তমানে সিতেশ রঞ্জন দেবের বাগান বাড়িতে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের কথা বলতে গিয়ে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. আতিয়ার রহমানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। তিনি জানান, ড. আতিয়ার রহমান তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে প্রথমে ১ লাখ টাকা অনুদান প্রদান করে এ কর্মকে সামনে এগিয়ে দেন। তিনি দেশের আগামী প্রজন্মের স্বার্থে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রাণীদের সেবা প্রদানের মাধ্যমে বন্যপ্রাণীদের বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস চালিয়ে যেতে চান আমৃত্যু পর্যন্ত। -চৌধুরী নীহারেন্দু হোম, শ্রীমঙ্গল থেকে
×