ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মীম নোশিন নাওয়াল খান

স্বপ্ন ॥ গল্প

প্রকাশিত: ০৬:২১, ২৪ আগস্ট ২০১৯

স্বপ্ন ॥ গল্প

আজকাল বুবনকে নিয়ে খুব সমস্যা হচ্ছে। স্কুল থেকে এসেই সে কোন রকম স্কুল ড্রেসটা খুলে একটু কিছু মুখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কয়েক ঘণ্টা ক্লাসের পর ক্লান্ত হয়ে ঘুমানোটা অস্বাভাবিক না। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, বাবা-মামণি যখন সন্ধ্যার পর বাসায় ফেরেন, তখনও এসে দেখেন বুবন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে! এর মধ্যে সারাদিনে বাবা-মামণি কেউ ফোন করলেও বুবন ধরে না। কখনও কখনও ফোন ধরে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে, মামণি, আমি ঘুমাচ্ছি। পরে কথা বলব। সারাদিন অফিস করে বাসায় ফেরার পর মামণির সবচেয়ে যুদ্ধ করতে হয় বুবনকে ঘুম থেকে তুলতে। কিছুতেই উঠতে চায় না সে। খাওয়া-দাওয়া, হোমওয়ার্ক, পড়াশোনা-কিচ্ছু না। সে শুধু ঘুমাবে। বাবা-মামণি অবশ্য বিষয়টা তেমন গুরুত্ব দেননি এতদিন। কিন্তু এই তো গত সপ্তাহে স্কুল থেকে বুবনের অলাস টিচার ফোন করেছিলেন। বলেছেন, বুবন নাকি আজকাল পড়ায় খুব অমনোযোগী। হোমওয়ার্ক করে না, ক্লাসে পড়া পারে না। পারফর্মেন্স দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এখন বাবা আর মামণি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। দুজন মিলে রীতিমতো ঝগড়াঝাটি করলেন সমস্যার সমাধান নিয়ে। শেষমেশ বুবনের ছোট চাচ্চু বাসায় বেড়াতে এসে ঘটনা শুনে সমাধান করে দিলেন। ছোট চাচ্চু বললেন, বুবনকে ডাক্তারের কাছে নেয়া দরকার। শুক্রবারে বাবা আর মামণির অফিস ছুটি। বুবনের স্কুলও ছুটি। তাই শুক্রবার সকাল সকাল বাবা আর মামণি বুবনকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার সব শুনে বুবনকে কিছুক্ষণ পরীক্ষা করলেন। গলা, কান, নাক, চোখ-সব। তারপর কিছু টেস্ট দিলেন। সব টেস্ট করে পরদিন সকালে আবার ডাক্তারের কাছে যাওয়া হলো। ডাক্তার বললেন, কোন সমস্যা নেই তো তোমার বুবন সোনা। তাহলে তুমি এত ঘুমাচ্ছ কেন? বুবন চুপ করে রইল। ডাক্তার আবার বললেন, আচ্ছা বুবন সোনা, তুমি কি রাতে অনেকক্ষণ জাগো? বুবন কিছু বলার আগেই মামণি বললেন, না তো। ও তো সারারাত বেঘোরে ঘুমায়। ডাক্তার কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, তুমি কি অনেক ফাস্টফুড খাও বুবন? বুবন না সূচক মাথা নাড়ল। মামণি বললেন, টিফিনও তো বাসা থেকে বানিয়ে দেই। ও তো বাইরের খাবার খুবই কম খায়। ডাক্তার ভ্র‍ু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর মামণি আর বাবাকে বললেন, ঠিক আছে। আপনারা একটু বাইরে অপেক্ষা করুন, আমি বুবনের সঙ্গে কথা বলি। তারা বেরিয়ে গেলে ডাক্তার বুবনের দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলেন, এখন বাবাও নেই, মামণিও নেই। তুমি আমাকে তোমার সমস্যাটা বলবে বুবন সোনা? তোমার তো কোন অসুখ নেই। তার মানে তুমি ইচ্ছে করেই এত ঘুমাচ্ছ। আমাকে বলো, কেন? তোমার কি অনেক ঘুম পায়, নাকি তুমি ইচ্ছে করেই ঘুমাও? বুবন চুপ করে রইল। ডাক্তার আবার বললেন, বল বুবন? বুবন একটু আমতা আমতা করে আস্তে আস্তে বলল, আমি ইচ্ছে করেই ঘুমাই আঙ্কেল। ডাক্তার হেসে বললেন, আচ্ছা। তাই? বেশ মজার তো! কেন ঘুমাও বুবন সোনা? বুবনের এবার চোখে পানি চলে এল। সে বলল, ঘুমালে সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখা যায় আঙ্কেল। ডাক্তার কিছুক্ষণ অবাক হয়ে বুবনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আট-দশ বছরের বাচ্চা, কিন্তু সবার চেয়ে খুব আলাদা। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, স্বপ্ন দেখার জন্য ঘুমাও? বুবন বলল, হ্যাঁ আঙ্কেল। স্বপ্ন অনেক সুন্দর। ডাক্তার বললেন, বাস্তবও তো অনেক সুন্দর। স্বপ্ন দেখে সময় পার করে দিলে বাস্তবটা কীভাবে দেখবে বুবন সোনা? বুবন এখন পুরোপুরি কেঁদে ফেলল। বলল, না। বাস্তব একটুও সুন্দর না। বাবা আর মামণি সারাদিন অফিসে থাকে। আমি স্কুল থেকে আসার পর থেকে সারাদিন বুয়ার কাছে থাকি। বুয়া আমার সঙ্গে কথাও বলে না, গল্পও করে না। শুধু দুপুরে আর বিকেলে খাবার খেতে ডাকে। আর বাকি সময় বসে বসে টিভি দেখে। বাবা আর মামণি আমাকে ছাদেও খেলতে যেতে দেয় না। আমার ভাললাগে না। বাসায় এসে বাবা আর মামণি ঝগড়া করে। আমার একটুও ভাললাগে না। কিন্তু স্বপ্ন সুন্দর। স্বপ্নে বাবা আর মামণি আমাকে নিয়ে বেড়াতে যায়। আমাকে ছাদে খেলতে দেয়। সারাদিন আমাকে একা থাকতে হয় না। স্বপ্নে থাকতে আমার খুব ভাললাগে। ডাক্তার এবার চুপ হয়ে গেলেন। কর্মজীবী বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে বাচ্চাদের এ রকম হতাশা আগেও দেখেছেন তিনি। কিন্তু এমন সমাধান কখনও দেখেননি। বেশ কিছুক্ষণ ভেবে ডাক্তার বললেন, কিন্তু বুবন, স্বপ্ন দেখতে তো ঘুমাতে হয় না। জেগে জেগেও তো স্বপ্ন দেখা যায়। বুবন চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, কীভাবে? ডাক্তার বললেন, তোমার কল্পনাশক্তি অনেক সুন্দর, বুবন। তাই তুমি ঘুমিয়ে সুন্দর স্বপ্ন দেখো। এই কল্পনাশক্তিটা কাজে লাগাও, তুমি জেগে জেগে এর চেয়েও সুন্দর স্বপ্ন দেখতে পারবে। একটু আগে তোমার মামণি বললেন তুমি খুব সুন্দর ছবি আঁকো। তুমি যদি ছবি আঁকতে ভালবাস, তাহলে তুমি ছবি আঁকবে আর ভাববে, এভাবে আঁকতে আঁকতে তুমি পিকাসো বা ভ্যানগগের মতো অনেক বড় শিল্পী হয়ে গেছো। সবাই তোমার আঁকা ছবি দেখতে আসছে। ভাবতে ভাবতে দেখবে, স্বপ্নের মতো এটাও তোমার চোখে ভাসবে। তুমি এই স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে যাবে। আর এই স্বপ্নটা তোমার ঘুমের স্বপ্নের চেয়েও বেশি সুন্দর। কেন জানো? কারণ এই স্বপ্নটা সত্যি করা যায়। একটু একটু করে ছবি আঁকতে আঁকতে তুমি একদিন সত্যিই অনেক বড় শিল্পী হতে পারবে। একটু একটু পড়াশোনা করতে করতে তুমি একদিন অনেক জ্ঞানী হবে। পড়াশোনা করতে ভাললাগে না আমি জানি। কিন্তু তুমি শুধু কল্পনা করতে থাকবে, অনেক পড়াশোনা করে তুমি অনেক বড় হয়েছ- ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বা বিজ্ঞানী। তখন দেখবে ওই স্বপ্ন সত্যি করার জন্য তোমার পড়তেই ইচ্ছে করবে শুধু! ডাক্তারের কাছ থেকে আসার এক মাসের মধ্যে বুবনের দিনকাল একদম পাল্টে গেছে। এখন বাবা-মামণি আর বাসায় এসে ঝগড়া করে না। ছুটির দিনে বুবনকে বেড়াতে নিয়ে যায়। পার্কে বুবন ছোটাছুটি করে বাবা আর মামণির সঙ্গে। বুবনের ঘরজুড়ে এখন বইখাতা আর ছবি আঁকার সরঞ্জাম। সে এখন মন দিয়ে পড়ে আর ছবি আঁকে। একটা কম্পিটিশনে সেকেন্ড প্রাইজও পেয়েছে ছবি আঁকায়। বুবন এখনও স্বপ্ন দেখে, বড় একজন শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন, অনেক জ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন। ঘুমের স্বপ্নের চেয়ে জেগে জেগে দেখা স্বপ্নই তার এখন বেশি পছন্দ। এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী
×