ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বকাপে টাইগারদের সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান

প্রকাশিত: ০৯:৩৬, ১০ জুলাই ২০১৯

বিশ্বকাপে টাইগারদের সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান

কেবলমাত্র এই একটি খেলা নিয়ে বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষ একাট্টা। সফলতায় সবখানে আনন্দ উল্লাসে মাতে, সবমনে বাজে বিজয়ের সুর ঠিক ব্যর্থতায়ও দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কাঁদে এ জাতি একসঙ্গে। অসম্ভব পাগলপরা অন্তপ্রাণ বাঙালীর প্রিয় খেলা ক্রিকেট। একথা ঠিক ক্রিকেট আমাদের আনন্দ লাভের পাশাপাশি দিয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদা ও গৌরব। তাইতো জিতলে হাসে এ জাতি, হারলে কেঁদে দুয়ো দেয় খেলোয়াড়দের। আলোচনা, সমালোচনার ঝড় ওঠে সোস্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে অফিসে-আড্ডায়। ক্রিকেটভক্ত বাংলাদেশের মানুষ বড় সংবেদি-হৃদয়গ্রাহীও বটে। তাই, সবসময় বিচার, বিবেচনা বোধও কখনও কার্যকরী, কখনওবা অকার্যকর বা হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। মোট দাগে বাংলাদেশের ক্রিকেট আজ অবধি যতদূর পৌঁছ গেছে তার থেকে আমাদের আশা ও স্বপ্ন আরও উঁচুতে তাই হোঁচট সহ্য করতে পারি না আমরা। খেয়ালে, অখেয়ালে অভিজ্ঞতার অভাব থেকে অন্যায় আবদার করে থেকেছি যেন এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ সেমিতে খেলবে কিংবা কাপটাই জিতে নেবে। ওয়ানম্যান আর্মি হিসেবে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের পারফর্মেন্স ছিল তাক লাগানোর মতো। তার এই জাদুকরী মেজাজ আর সবার থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করেছে। যদিও কুলীন প্রাক্তন ক্রিকেটার, বিশ্লেষক, পর্যবেক্ষকদের অনেকেই বিশ্বকাপের শুরুতে বাংলাদেশকে নিয়ে খুব বেশি দূর আলোচনায় যায়নি। কিন্তু প্রথম রাউন্ডে আট খেলায় ৬০৬ রান আর ১১ উইকেট নিয়ে সাকিবকে আর সবার থেকে আলাদা বলেই অভিষিক্ত করেছে আইসিসি থেকে শুরু করে ক্রিক্রেটের রথি, মহারথীরা। হুট করে সাকিব আল হাসানের এমন পারফর্মেন্স হয়নি। অভিষেক হওয়ার পর থেকে তার মেজাজ, আচরণ, অনুশীলন, মেধা-মনন ও অভিজ্ঞতা তাকে বিশ্বসেরা বানিয়েছে অনেকদিন আগেই। কেবলমাত্র এই একজন কিক্রেটারের মধ্যে প্রফেশনালিজমের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়, তাই তো সাকিব আল হাসান শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেটের পোস্টারবয় নয় তিনি বিশ্বক্রিকেট মঞ্চেরও ফেনোমেনন। ইংল্যান্ড-ওয়েলস বিশ্বকাপে শুরু দিকে টিম টাইগার্স যেভাবে একট্টা হয়ে দলীয়ভাবে লড়াই করেছে তাতে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। যদিও টপ অর্ডার অর্থাৎ ওপেনিং ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকার উল্লেøখ করবার মতো কোন কার্যকর ইনিংস খেলতে পারেননি। তাই আটটি ম্যাচের কেবলমাত্র তিনটিতে জয় আর সব পরাজয় থেকে এই কথা বলা যায় যে, সার্বিকভাবে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ মিশন পুরোপুরি ব্যর্থ বলা চলে না আবার সফলও নয়। ঠিক মাঝখানে পেন্ডুলামের মতো ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। দশ দলের মধ্যে টাইগারদের অবস্থান আটে। শেষদিকে বাজে পারফরমেন্সের কারণেই আরও উপরে ওঠা হয়নি। অনেকের মতে, এর চেয়ে ২০১৫ বিশ্বকাপে টাইগারদের পারফরমেন্স ভাল ছিল। সেবার ইংল্যান্ডের মতো দলকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল লাল-সবুজের দেশ। সেই তুলনায় এবারের দলটি ছিল আরও বেশি অভিজ্ঞ, পরিপক্ব, তারকায় ভরপুর। কিন্তু প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির যোগফলটা শেষমেশ মেলেনি। ক্রিকেট দলীয় খেলা। দলের সাংগঠনিক অবস্থা ও ভিত্তির ওপর নির্ভর করে। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং এর সঙ্গে মানসিক শক্তি সহ সব বিভাগে একত্রে ভাল না করলে সেই দল কখনই সেরা চারে পৌঁছাতে পারে না। আর চ্যাম্পিয়ন হতে হলে এসবের উন্নতির চেয়ে বেশি জরুরী মনোবল আর প্রফেশনালিজম। সেইটা লক্ষ্য করা গেছে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে জিততে জিততে হেরে যাওয়া, অস্ট্রেয়িলার সঙ্গে, ভারতের সঙ্গে। আর সবশেষে পাকিস্তানের সঙ্গে শোচনীয় পরাজয় এই মনে করিযে দেয় বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা দীর্ঘ একমাসের খেলায় মনোবল ধরে রাখতে পারেনি যার প্রভাব মাঠে লক্ষ্য করা গেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে খেলার দিনতো একমাত্র সাকিব ছাড়া সবার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল অপরিণাম দর্শিতার মতো। ক্যাচ ফেলেছে ভারতের সঙ্গে, পাকিস্তানের সঙ্গে। পাকিস্তানের সঙ্গে খেলার দিনে অনেকের ফিটনেসে সমস্যা ছিল। মাহমুদুল্লাহর ইনজুরিও ছিল কিছুটা। এই দিনের খেলায় বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের বালকসুলভ আচরণে হতাশ হয়েছে ক্রিকেটপাগল বাঙালী জাতি! হুড়মুড় করেন ভেঙ্গে পড়া যেন আমাদের অতীত অভ্যাস। হাতুরি সিংহের হাল ধরবার পর থেকে বদলে যেতে থাকে বাংলাদেশের ক্রিকেট। এরপর ইংলিশ কোচ স্টিভ রোডস দায়িত্ব নেন, প্রত্যাশার পারদও উঁচুুতে উঠতে থাকে। যার প্রমাণ বাংলার টাইগাররা দিতে থাকে। দুইবার এশিয়া কাপের ফাইনালে কেবলমাত্র চাপ নিতে না পারার জন্য ব্যথ্য হয়। কিন্তু চাঙ্গা ভাবটা ঠিকই ধরে রাখে। মাশরাফি বিন মুর্তজার দেশাত্ববোধক দায়িত্ব ও অভিজ্ঞতায় সত্যিই টিম টাইগাররা বদলে গেছে যার প্রমাণ আয়ারল্যা-ের প্রথমবারের মতো ত্রিদেশীয় সিরিজ জেতা। এই সিরিজটা থেকে ষোল কোটি মানুষ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেমি ফাইনাল খেলার সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে। ক্রিকেট বিশ্লেষক থেকে শুরু করে অনেকেই আগাম অনুমান করে বলেছিল ইংল্যান্ড, ভারত, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে টিম বাংলাদেশ সেমিতে উঠতে পারে। সেই পথে যাচ্ছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে প্রথম জয় তুলে নেয়। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপেও তিন শতাধিক রান তোলে আগে ব্যাটিং করে। এরপর নিউজ্যিলান্ডের সঙ্গে লড়াই করে হেরে যায়। শ্রীলংকার সঙ্গে ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়ে পয়েন্ট ভাগ নিয়ে হতাশ হয়ে ওয়েস্ট উ-িজের সঙ্গে প্রথম বারের মতো তিন শতাধিক রাত তাড়া করে ৪১.৫ ওভারে পরাজিত করে সেমির আশা ভালভাবে বাঁচিয়ে রাখে। সেই থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেট বিশ্ব ক্রিকেটের শক্তি হয়ে ওঠে। সকলের প্রশংসায় ভেসে যেতে থাকে বাংলার টাইগাররা। পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে হারতো এখনও সবার চোখে দগদগে। এরপর আফগানিস্তানকে ভালভাবে রুখে দিতে পেরেছে। মোটাদাগের ব্যবধানে হারিয়েও বাংলাদেশ ঠিকঠাকমতো চলছিল। সেমিতে উঠতে হলে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে জিততে হতো। ভারতের সঙ্গে লড়তে লড়তে হারলেও, পাকিস্তানের কাছে শোচনীয় হার কোনভাবেই কেউ মেনে নিতে পারছে না। এই ম্যাচে ব্যর্থতার পোস্টমর্টাম করতে শুরু করে সবাই। বিশ্বকাপের শুরুতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্বপ্ন ছিল সেমিতে খেলার। মানুষের স্বপ্ন তার চেয়ে অনেক উঁচু হয়। আর স্বপ্ন্ কখনও সত্য হয় না। সত্য হতে হলে লড়াই করেই জিততে হয়। ত্রিদেশীয় সিরিজ জেতার পর থেকে বাংলাদেশকে নিয়ে অনেকে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। পুরো জাতি এই একটা মাস অপেক্ষায় থাকে কোনদিন বাংলাদেশের খেলা থাকে। অধীর আগ্রহ নিয়ে মানুষ যূথবদ্ধ হয়ে খেলা দেখে। ভারতের সঙ্গে হারলেও পাকিস্তানের সঙ্গে জিতে অন্তত পয়েন্ট টেবিলের পাঁচে থেকে মিশনটা শেষ করার স্বপ্ন নিয়ে জেগে ছিল বাঙালী। কিন্তু উল্টোরথে উঠে বসে টিম টাইগার। আবারও ব্যর্থ। আর ব্যর্থতা মানে এই নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেট পিছিয়ে পড়েছে এমনটি নয়। একথা ঠিক পেসবোলিং ডিপার্টমেন্টে বাংলাদেশে বরাবর দুর্বল। একমাত্র বিশ্বমানের পেস বোলার কাাটার মোস্টার মোস্তাফিজুর রহমান ছাড়া তরুণ পেস বোলিং অলরাউন্ডার সাইফুদ্দিন আর অভিজ্ঞ বীর মাশারাফি ছিল আমাদের ভরসার জায়গা। অথচ মাশরাফি ৮ ম্যাচে মাত্র ১ উকেট নিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। মোস্তাফিজ ৮ ম্যাচে ২০ উকেটে নিলেও রান খরুচে ছিলেন, সাইফুদ্দিন ১৩ উইকেট নিয়েছেন কিন্তু তিনিও মিতব্যয়ী নয়। মিস্টার ডিপেনডেবল মুশফিকুর রহমান আর পঞ্চ-প্-াবের মাহমদুল্লাহর ঝলক উঠেছে মাত্র দুই একবার। আর এতে করে সেমির টিকেট পাওয়া সম্ভব ছিল না। হঠাৎ ঝলক দেখিয়েছে লিটন দাস ওয়েস ই-জের সঙ্গে ৯৪ রান করে। মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ধারাবাহিক ছিলেন না। মোটামুটি ব্যর্থ ছিল মোহাম্মদ মিঠুন ও সাব্বির। রুবেল হোসেন মাত্র দুই ম্যাচে বেধড়ক মার খেয়েছে। তার পেসের ধার কমেছে অভিঙ্গতার নির্যাস দেখানোর আগেই নিভে গেছে তার ঝলক। একটি দলের মূল জায়গা হলো টপ অর্ডার। উদ্বোধনী জুটিতে বরাবর ছিল বিশ্বমানের ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল। তার সঙ্গে সৌম্য সরকার ও লিটন দাস। তামিম ইকবালের অভিজ্ঞতা, মেধা অন্য দুজনের থেকে ঢের বেশি। তিনি দায়িত্ব নিয়ে বড় ইনিংস খেলতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। আর সৌম সরকার ব্যটিং এ ঠিকঠাক ক্লিক না করলেও পার্টটাইম মিডিয়াম পেস বোলার হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তিনটি ও ভারতের সঙ্গে একটি মোট ৪ উইকেট নিয়ে দুর্বল পেস অ্যাটাকের একজন সহযোগী সদস্য হিসেবে বেশ কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন। এবারই ক্রিকেটের পরাশক্তি হওয়ার সম্ভাবনা জাগিয়েও হতে না পারা মানে এই নয় যে, বাংলাদেশের ক্রিকেটে মেধা বা শক্তির অপ্রতুলতা রয়েছে। শুধু দায়িত্ব নিয়ে খেলা, লড়ে যাওয়া, আর শরীরীভাষা ঠিক রেখে শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার মানসিকতার অভাব ছিলো টিম টাইগার্সের মধ্যে। ভারত ও পাকিস্তানের ম্যাচের মধ্যে এই ভারসাম্যহীনতা চোখে পড়বার মতো ছিল। শুধু কাপ নিলেই যে বড় দল হয় এমন নয়, খোদ ক্রিকেটের জনক ইংল্যান্ড থেকে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপটা নিতে পারেনি। কিন্তু তারা সকলেই ক্রিকেটের পরাশক্তি। ওয়ানম্যান আর্মি হিসেবে সাকিব আল হাসানের মতো অন্তত তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহীম, মাহমুদাল্লাহ, মুস্তাফিজ, সাইফুদ্দিনকে আরও দায়িত্ববান হতে হবে। তবেই সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারবে বাংলাদেশ। আর একজ লেগ বা রিস্ট স্পিনারের অভাবও দেখা গেছে। তাই একজন লেগিরও দরকার টিম টাইগারদের।
×