কবি আদ্যনাথ ঘোষ পেশায় শিক্ষক। নেশায় কবি। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। প্রতি বছরই এক বা একাধিক কবিতার বই বেরিয়েছে। সর্বশেষ ‘বিধিলিপি মন’ বের হয়েছে এ বছর একুশে গ্রন্থমেলায়। এ গ্রন্থে তিনি নানাভাবে, নানা রঙে, নানা ঢঙে ধরতে চেয়েছেন সময়, সমাজ, মানুষ, প্রকৃতি, প্রেম, বিরহ, সুখ-দুঃখসহ যাপিত জীবনের বহুমাত্রিক অনুষঙ্গ। এ গ্রন্থে কবিতার সংখ্যা ৭৫টি। প্রথম কবিতা ‘আকাশে ডানা মেলে’ এবং শেষ কবিতা ‘একাকিত্ব’। এখানকার কবিতাগুলো পাঠে বোঝা যায় আদ্যনাথ ঘোষ মনের বৈচিত্র্যময় ভাবনা কবিতাছন্দে বাঁধতে চেষ্টা করেছেন।
সমাজে শ্রেণীবিভাজন সুস্পষ্ট। কেউ পাঁচতলায়, কেউ গাছতলায়; কেউ খেতে পায় না, কারও খেতে ইচ্ছে করে না। যাদের খেতে ইচ্ছে করে না তারা না-খেতে পাওয়া মানুষের কথা ভাবে না। বরং এসব প্রান্তিক মানুষের শোষণে ফুলেফেঁপে ওঠে ওদের সম্পদের আয়তন, সীমা-পরিসীমা। আদ্যনাথ এই শোষক ও শোষিত মানুষের কথা কবিতায় তুলে আনতে চেয়েছেন। শোষিতের প্রতি ইতিবাচক মানবিক অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে; সেইসঙ্গে শোষককে জবাবদিহিতার পরিসরে আনবার কথা বলতে চেয়েছেন। এই প্রকৃতির কবিতাকে মাক্সবাদী ধারার কবিতা বলা হয়ে থাকে। আদ্যনাথের কবিতায় এর প্রভাব সুস্পষ্ট। কবি আদ্যনাথ এ মানবিক ভাব-ভাবনাগুলো অনেকটা সহজ-সরল ভাষায় প্রকাশ করেছেন কবিতায়। দু’একটি কাব্যপঙক্তি নিম্নরূপ-
‘আমি সেই সব সর্বহারাদের কথা বলছি
যাদের ঘর নেই, চুলা নেই, এমনকি খাবারের ব্যবস্থাও নেই।’ (মে দিবসের কবিতা)
মানুষ মাত্রেই স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে। স্বপ্ন দেখার মধ্যেও সুখ আছে। আবার স্বপ্নভঙ্গে অনুরূপ দুঃখও আছে। আদ্যনাথও স্বপ্ন দেখেন কিন্তু স্বপ্নগুলো ঠাকুরমার গল্পের মতোই, বাস্তবে মেলা ভার, তার স্বপন ‘মহাশ্মশানের একমুঠো ছাই।’ (একাকিত্ব) ফলে নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব ও বিষণœতা কবিকে পেয়ে বসে। হয়ত কখনও কখনও কবি কান্নায় ভেসে যান, বাঁশির সুরেও তাকে বিষণœতায় পেয়ে বসে। গানের পাখিরা উড়ে যায়; দুঃখকষ্টগুলো শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। ‘বিবাগী মন’ কবিতায় পাচ্ছি-
‘গভীর আঁধারের জ্বালাময়ীÑদুঃসহ দুঃখমালা
শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে
ঝরছে অবিরত।’
কবির মধুময় কোন এক সাধ ছিল, সেটি ভেঙ্গে গেছে; বয়ে বেড়াচ্ছেন অনলযন্ত্রণা। তবে এটি স্বাভাবিক যে, মানুষ মাত্রেই ভাল কিছুর জন্য প্রতীক্ষা করে। জীবনের সব ব্যথাবেদনা, জ্বালাযন্ত্রণা, দুঃখকষ্টের অবসান হবে, একদিন সত্য সত্যই সুখের সন্ধান মিলবেÑএই আশা-প্রত্যাশাতেই মানুষ বেঁচে থাক। কবি আদ্যনাথের মধ্যেও সেই প্রত্যাশা সমানভাবেই বিরাজমান। এই কবিও অন্ধকার কেটে আলোর অভিমুখী; ইতিবাচক পরিবর্তন-প্রত্যাশায় প্রতীক্ষা করেন। ‘ভোরের প্রত্যাশায়’ কবিতায় এই রকম অভিব্যক্তি দেখতে পাচ্ছি। প্রাসঙ্গিক কাব্যরচণ-
কখন উঠবে গো ভোরের সূর্য
কখন কাটবে অন্ধকার
এ আশায় রাত জেগে
আঁধার পাড়ি দিতে থাকি
কূলের প্রত্যাশায়...
সমকালীন সমাজ ও সমাজব্যবস্থাপনায় দুঃখমুক্ত থাকাটা বেশ কঠিন। তবু এত দুঃখের মধ্যেও কবি আদ্যনাথ ঘোষের কাব্যপরিসরে প্রেমভাবনা বলা যায় সমভাবেই উপস্থিত। শুধু প্রেমপ্রণয় নয়, বরং রীতিমতো রোমান্স প্রকৃতির প্রণয়ভাবনা। তবে আদ্যনাথ প্রণয়ে সুখ পাচ্ছেন না, দুঃখই পাচ্ছেন, প্রেম তাকে প্রতারিত করছে, সব কিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে দিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে প্রেমকে তিনি সর্বনাশা ঝড়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন; জীবনকে নিষ্ফলা মাঠ মনে হয়েছে। কবি বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরেছেন-
‘সবশেষে জানিলাম-
যে আমারে বেঁধেছিল
সে আমার নয়।’ (হতাশার ধোঁয়া)
তার শব্দ নির্বাচন, বিষয়বিন্যাস ও উপস্থাপনে নিজস্বতা রয়েছে। বাংলা সাহিত্যাকাশে আদ্যনাথ ঘোষ বিচরণ করুকÑএটি পাঠকের প্রত্যাশা।