ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৪ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

সকালে মোবাইল হাতে নেওয়া কি সত্যিই ক্ষতিকর? গবেষণা কী বলছে?

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ৪ জুলাই ২০২৫

সকালে মোবাইল হাতে নেওয়া কি সত্যিই ক্ষতিকর? গবেষণা কী বলছে?

ছ‌বি: প্রতীকী

আমরা অনেকেই দিন শুরু করি মোবাইল হাতে নিয়ে। চোখ মেলে সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল, মেসেজ চেক বা নিউজ দেখতে দেখতে। এটাকে এখন স্বাভাবিক অভ্যাস বলেই ধরা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সকালে ঘুম থেকে উঠেই মোবাইল দেখা কি আমাদের শরীর ও মনের জন্য ভালো? গবেষণা এবং মনোবিজ্ঞানীরা এ নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। চলুন দেখি, বিজ্ঞানের চোখে বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

ঘুম থেকে ওঠার পর আমাদের শরীর এবং মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে জেগে ওঠে। মস্তিষ্ক তখনো পুরোপুরি সক্রিয় হয় না। এই সময়টা খুব স্পর্শকাতর। নিউরোসায়েন্সের ভাষায়, এটি “হাইপোন্যাগোজিয়া” স্টেজ, মানে ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি সময়। এই সময় যদি আমরা হুট করে মোবাইলে নানা রকম তথ্য, রঙিন ছবি, বিজ্ঞাপন বা নানা রকম মেসেজ দেখতে থাকি, তখন মস্তিষ্ক একধরনের তথ্য-আক্রমণের শিকার হয়। এটি মস্তিষ্কের ওপর একধরনের চাপ তৈরি করে।

অনেক গবেষক বলছেন, ঘুম থেকে উঠেই মোবাইল দেখা মানে ব্রেইনকে এমন সময়েই উত্তেজনায় ফেলা, যখন সেটি ধীরে ধীরে কাজ শুরু করার কথা। এতে করে দিনের শুরুতেই দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, বা মনোযোগের অভাব তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে যদি মেসেঞ্জারে কোনো খারাপ খবর থাকে, কাজের ইমেইলে চাপের কথা লেখা থাকে, বা সোশ্যাল মিডিয়ায় কারও নেতিবাচক পোস্ট চোখে পড়ে—তাহলে পুরো দিনের মন-মেজাজ খারাপ হয়ে যেতে পারে।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সকালে ঘুম থেকে উঠেই ৩০ মিনিটের মধ্যে ফোন চেক করেন, তাদের মধ্যে উদ্বেগের মাত্রা বেশি থাকে। তারা সারাদিন মনোযোগ কম পান, কাজের মধ্যে মন বসাতে পারেন না। বিশেষ করে যারা ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক বা টিকটকের মতো অ্যাপ ব্যবহার করেন, তারা অন্যদের জীবনের চমৎকার মুহূর্ত দেখে নিজের জীবনের সঙ্গে তুলনা করতে থাকেন। এতে আত্মবিশ্বাসে ভাটা পড়ে, এবং দিনের শুরুটাই নেতিবাচক ভাবনায় রঙিন হয়ে ওঠে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্ক্রিনের আলো। স্মার্টফোনের স্ক্রিনে থাকা নীল আলো আমাদের মস্তিষ্ককে ভুল বার্তা দেয়। ঘুম থেকে ওঠার পরে প্রাকৃতিক আলো ধীরে ধীরে শরীরকে সক্রিয় করে তোলে, যা স্বাভাবিক এবং স্বাস্থ্যকর। কিন্তু মোবাইলের নীল আলো একধরনের কৃত্রিম জাগরণ তৈরি করে, যা শরীরের ঘড়িকে (বায়োলজিকাল ক্লক) বিঘ্নিত করতে পারে। এতে করে সারাদিন ক্লান্তি, ঝিমুনি এবং মাথাব্যথার মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

অনেকেই বলেন, “আমার তো সময় নেই! সকালে অফিসের আগে একটু খবর দেখি, মেইল চেক করি।” এটা একেবারে ভুল নয়। তবে গবেষকরা পরামর্শ দিচ্ছেন, ঘুম থেকে উঠে অন্তত ৩০ মিনিট মোবাইল থেকে দূরে থাকা ভালো। এই সময় আপনি পানি খেতে পারেন, হালকা স্ট্রেচিং করতে পারেন, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সূর্যের আলো নিতে পারেন, অথবা নীরবে নিজের দিনটা কীভাবে কাটাতে চান, সেটা ভেবে নিতে পারেন।

এই ছোট্ট সময়টুকু যদি মোবাইল ছাড়া কাটানো যায়, তাহলে মন ও শরীর দুটোই ধীরে ধীরে প্রস্তুত হয় সারাদিনের জন্য। আপনার মনও থাকে শান্ত, মনোযোগ বাড়ে, এবং কাজের ফোকাস অনেক ভালো হয়।

বিশ্বখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ড. অ্যান্ড্রু হাবারম্যান বলেন, “সকালে প্রথম যে কাজটি আপনি করেন, সেটি পুরো দিনের মুড ও ফোকাস নির্ধারণ করে দেয়।” তাই দিনের শুরুটা যেন আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকে, ফোনের নয়, সেই চেষ্টাটা করা উচিত।

মোবাইল আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ— তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে কোন সময় এটি ব্যবহার করব, তা যদি একটু সচেতনভাবে ভাবা যায়, তাহলে উপকার পাওয়া সম্ভব। বিশেষ করে সকালটা যদি মোবাইল ছাড়াই শুরু হয়, তাহলে শরীর, মন এবং পুরো দিনটাই হতে পারে আরও ইতিবাচক ও স্বস্তিদায়ক। বিজ্ঞানও তাই বলছে, সকালের প্রথম আলো যেন আসে প্রকৃতি থেকে, না যে স্ক্রিন থেকে।

এম.কে.

×